প্রকাশিত: ১৯/১১/২০১৯ ১:৩৯ পিএম

আবু তাহের, কক্সবাজার
রাখাইন রাজ্যের মংডু জেলার দক্ষিণ বড়ছড়া এলাকার জয়নাল আলী প্রকাশ জানে আলমের ছেলে আবদুল হাকিম বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিল টেকনাফের পুরান পল্লানপাড়া এলাকার পাহাড়ে। এরপর গোপনে সেখানে গড়ে তুলেছে বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী। এই রোহিঙ্গাই এখন ‘হাকিম ডাকাত’, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তালিকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী। তার সন্ত্রাসী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চাকমারকুল ক্যাম্প-২১ থেকে ক্যাম্প-২৭ জাদিমুড়া পর্যন্ত। তার কথার বাইরে পা ফেলার সুযোগ নেই রোহিঙ্গাদের। খুন থেকে গুম, মাদক পাচার থেকে আদম পাচার- এমন কোনো অপরাধ নেই হাকিম ডাকাত এবং তার লোকজন করে না। টেকনাফের আলোচিত নুরুল কবির হত্যা, সিএনজি ড্রাইভার মো. আলী হত্যা, নতুন পল্লানপাড়ার সিরাজ মেম্বার ও মুন্ডি সেলিম হত্যা, আবদুল হাফিজ, তোফায়েল হত্যাসহ বহু হত্যা মামলার আসামি এই হাকিম ডাকাত।

শুধু হাকিম ডাকাত নয়, এ রকম আরও কয়েকটি সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। টেকনাফের নয়াপাড়ার আনসার ক্যাম্পে হামলা করে এক আনসার কমান্ডারকে খুন এবং অস্ত্র লুটের ঘটনা ঘটিয়েছিল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নুরে আলম বাহিনী। তাকে আটক করে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করেছিল র‌্যাব। পরে এক বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় নুরে আলম। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নুরে আলম বাহিনীর নেতৃত্ব হাতে নিয়েছে অন্য এক দুর্ধর্ষ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী জকির আহমদ।

রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় আরও কয়েকটি বাহিনীর তথ্য রয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে। এর মধ্যে সেলিম বাহিনী নামে সন্ত্রাসী গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে কয়েকটি ক্যাম্পে।

হাকিম ডাকাত, জকির ও সেলিম গ্রুপের রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ধরতে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে অনেকগুলো অভিযান পরিচালনা করেছে র‌্যাব। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় সন্ত্রাসীদের বেশ কয়েকটি আস্তানা। তবে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের শীর্ষ কেউ ধরা পড়েনি। একটি সূত্র জানিয়েছে, র‌্যাবের অভিযানে পাহাড়ে বেশ কিছু আস্তানা গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর হাকিম ডাকাত এখন কুতুপালং এলাকায় আত্মগোপন করেছে। বিশাল এই ক্যাম্পে লুকিয়ে থেকে তার সন্ত্রাসী বাহিনীর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। সম্প্রতি কুতুপালং ক্যাম্পে কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করেছে পুলিশ। একটি অভিযানে হাকিম ডাকাতকে প্রায় কাছাকাছি পাওয়া যায়। শেষ মুহর্তে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় সে।

টেকনাফে র‌্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, সাম্প্রতিক অভিযানে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের শীর্ষ কাউকে আটক করা না গেলেও অনেক সাফল্য এসেছে। অনেক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে।

উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্পে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বিশাল এই রোহিঙ্গা গোষ্ঠীকে পরিচালিত করতে পারে এমন কোনো সংগঠন বা নেতৃত্ব তাদের মধ্যে নেই। কিছু ক্যাম্পে মাঝি এবং হেড মাঝিরা নিয়ন্ত্রণ করলেও বেশির ভাগ ক্যাম্পে সন্ত্রাসী গ্রুপ রোহিঙ্গাদের ওপর কর্তৃত্ব করছে। অনেক রোহিঙ্গা স্বীকার করেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ব্যবসায়-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ এবং চাঁদাবাজি করে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হচ্ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। তাদের এই অবৈধ ব্যবসায়-বাণিজ্যের কারণে সাধারণ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনবিরোধী হতে বাধ্য করছে।

রোহিঙ্গাদের অনেকে জানিয়েছে, তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে চায়। তবে সন্ত্রাসীদের ভয়ে তারা তাদের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করতে পারে না। স্বদেশে ফেরার কথা বললে তাদের হত্যা করার হুমকি দেওয়া হয়। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গত দুই বছরে অর্ধশত খুন হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকে স্বদেশে ফিরে যেতে আগ্রহ দেখিয়েছিল। ফলে স্বদেশে ফেরার আগ্রহ দেখাতেও ভয় পায় সাধারণ রোহিঙ্গারা।

টেকনাফ সদর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্প। মিয়ানমারের অনুমোদন দেওয়া প্রত্যাবাসন তালিকায় এই ক্যাম্প থেকে ৯৩৩ পরিবারের তিন হাজার ৪৫০ জনের নাম রয়েছে। তাদের প্রায় সবাই ইতোমধ্যে ইউএনএইচসিআর এবং বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের প্রতিনিধিদের কাছে মতামত জানিয়েছে। এই রোহিঙ্গারা জানায়, তাদের অনেকেই নিজ দেশে ফিরতে আগ্রহী। কিন্তু সন্ত্রাসীদের ভয়ে সাহস পাচ্ছে না। ক্যাম্পে মাঝিরা হুমকি দিচ্ছে। তারা জানায়, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ইশারায় চলে ক্যাম্পের বেশির ভাগ মাঝি।

কর্মকর্তাদের কাছে সাক্ষাৎকার দেওয়ার পর দশ দিন পালিয়ে থেকে নিজ ঘরে ফিরে এসেছেন বদু আক্তার (২৫) নামে এক রোহিঙ্গা নারী। তার মতো অনেকে নিজ দেশে ফিরতে চায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক রোহিঙ্গা জানায়, ফিরতে চাইলেও তাদের পাশে দাঁড়াবে এমন কোনো রোহিঙ্গা নেতা নেই। বরং হুমকি দেওয়ার নেতা ও মাঝির সংখ্যাই বেশি ক্যাম্পে।

বালুখালী ১২ নং ক্যাম্পে এক রোহিঙ্গা মাঝি বলেন, মিয়ানমার সেনা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ আছে এমন কিছু লোক ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের চলাফেরার ওপর নজর রাখে। আসলে তারা চায় না রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাক। দেশি-বিদেশি ত্রাণ সহায়তাকারী কিছু সংস্থা মাঝিদের প্রত্যাবাসনবিরোধী ভূমিকা রাখতে মদদ দিচ্ছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনবিরোধী করতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী গোপনে কাজ করছে। ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মধ্যে সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি করেছে। দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা গোপনে এই কাজে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে। কেউ মিয়ানমারে ফিরতে চাইলে তাকে হত্যা করছে। সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো রোহিঙ্গাদের ভাসানটেকে না যাওয়ার জন্যও প্রচারণা চালাচ্ছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা বলেন, ৩২টি ক্যাম্পে যেসব মাঝি ও হেড মাঝি রয়েছে, তাদের রদবদল করা প্রয়োজন। এরা এখন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তিনি বলেন, ক্যাম্প প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকবে এমন লোকজনকে মাঝি করা হলে তাদের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনমুখী করা সম্ভব।

কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের অতিরিক্ত কমিশনার মো. শামসুদৌজ্জা বলেছেন, প্রত্যাবাসনে রোহিঙ্গাদের মনোভাব জানার জন্য কিছুদিন ধরে সাক্ষাৎকার নেওয়া হচ্ছে। এতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তারা বলছে, মিয়ানমারে তাদের নিরাপত্তা ও বাড়িঘরে যেতে দেওয়া হলেই তারা ফিরে যাবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কিছু সন্ত্রাসী বাহিনীর অস্তিত্ব রয়েছে স্বীকার করে ওই কর্মকর্তা বলেন, বিশাল ক্যাম্পে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষে কঠিন। নানা সমস্যার মধ্যে থেকেও তাঁরা এই দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও একই কথা বলেছেন। উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, দিনের আলোয় যেমন-তেমন, রাত হলেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে। রোহিঙ্গাদের কারণে পাঁচটি ইউনিয়নের প্রায় দুই লাখ মানুষ এখন চরম বিপদে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বলেছেন, যতই দিন যাচ্ছে, রোহিঙ্গারা বিভিন্ন অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। অনেক রোহিঙ্গা মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে যাচ্ছে। গত এক বছরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মাদক পাচারের অভিযোগে শতাধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলায় দুই শতাধিক রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিশাল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনেক সমস্যা। এরপরও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ধরতে প্রতিনিয়ত অভিযান চালাচ্ছে। সুত্র; সমকাল

পাঠকের মতামত