
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। এই সৈকত মানে মুক্ত বাতাস আর অনন্ত নীলের শান্তি। কিন্তু এটি পরিণত হয়েছে দখল, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক বাণিজ্যের খোলা মঞ্চে। আদালতের নিষেধাজ্ঞা, সরকারি গেজেট, প্রশাসনিক অভিযান, উচ্ছেদের নির্দেশ– সবকিছুকেই যেন বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলছে সৈকত দখলের মহোৎসব।
গত ২০ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে সৈকতের সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্টে বালিয়াড়িঘেঁষে রাতারাতি বসে যায় শতাধিক নতুন দোকান। চা, ফুচকা, ঝিনুক, ফিশ ফ্রাইসহ নানা পণ্য সেগুলোতে। সব দোকানের রং ও নকশা একই রকম। সামাজিক মাধ্যমে ছবিগুলো ছড়িয়ে পড়তেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন স্থানীয় লোকজন, পরিবেশবাদী এবং পর্যটকরা।
রাজধানী থেকে বেড়াতে আসা আবদুর রব বললেন, সৈকতে এসে এখন নিঃশ্বাস ফেলারও জায়গা নেই। বালিয়াড়ি দখল হয়ে গেছে দোকান, চেয়ার, বাইক, লকারে। কক্সবাজার এখন জঞ্জালের শহর।
১৯৯৯ সালে সরকার কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার উপকূলকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। আইন অনুযায়ী, জোয়ার-ভাটার সীমারেখা থেকে ৩০০ মিটার পর্যন্ত এলাকা নো ডেভেলপমেন্ট জোন। তবু সেই সীমার ভেতরেই তৈরি হচ্ছে শত শত স্থাপনা। ২০১১ সালে হাইকোর্ট সৈকতের সব স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেন। ২০২২ সালে প্রশাসন ৫০০টির বেশি স্থাপনা উচ্ছেদ করলেও অল্প সময়ের মধ্যেই সেগুলো আবারও গজিয়ে ওঠে। এবার প্রশাসনের অনুমতিতেই সেই দখল আরও বড় আকারে ফিরে এসেছে।
২৩ সেপ্টেম্বর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় বালিয়াড়ি সৈকতে বসানো সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেয় জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে।
একই সঙ্গে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) দুই সচিবসহ আট সরকারি কর্মকর্তাকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছে। কিন্তু এখনও কোনো অভিযান হয়নি, বরং প্রশাসনের অভ্যন্তরে চলছে নতুন বরাদ্দের গুঞ্জন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), আমরা কক্সবাজারবাসী ও কক্সবাজার সোসাইটিসহ কয়েকটি সংগঠন ঘোষণা দিয়েছে, প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আন্দোলনে নামবে তারা।
স্থানীয়রা জানান, সৈকতের পর্যটন সেলের ‘কার্ড’ এখন কক্সবাজারের সবচেয়ে দামি কাগজ। দোকান বসাতে চাইলে জেলা প্রশাসনের বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দিতে হয়– এটাই নিয়ম। কিন্তু স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘কার্ড পাওয়ার নিয়ম ভিন্ন। চাইলে তিন লাখ টাকায় ভাড়া নেওয়া যায় কার্ড। নিজের নামে নিতে চাইলে দিতে হবে আরও টাকা।’
জেলা প্রশাসনের হিসাব বলছে, সৈকতে সাম্প্রতিক দোকান অনুমোদন পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, কিছু সাংবাদিক ও স্থানীয় প্রভাবশালী।
সূত্র জানায়, কেবল লাবনী থেকে কলাতলী পর্যন্ত এক কিলোমিটার অংশে আগেই ছিল ৮৩০ দোকান, এক হাজার ছাতা-চেয়ার, শত শত ফটোগ্রাফার ও বাইক। সেখানে নতুন করে আরও ৪০০ দোকান ও ৬০০ ছাতা-চেয়ার বসানোর অনুমতি দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
স্থানীয় পরিবেশ আন্দোলনের নেতা করিম উল্লাহর অভিযোগ, বিদায়ী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন সৈকতের দোকান বরাদ্দের নামে প্রায় ৯ কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন। প্রতিটি কার্ড বিক্রি হয়েছে গড়ে তিন লাখ টাকায়। রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালী মহলের মধ্যে ভাগ গেছে প্রায় ৯০ লাখ টাকা। এ বিষয়ে বিদায়ী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনের বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আজিম খান বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনেই দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অনুমতি না দিলে অনেকে জোর করে বসত। আমরা চেষ্টা করেছি শৃঙ্খলার মধ্যে রাখতে।’ তবে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. শাহেদুল আলম স্বীকার করেছেন, রাতারাতি সৈকত দখল হয়ে যাবে এটা তারা কল্পনাও করেননি। এখন বিব্রতকর অবস্থায় আছেন।
অন্যদিকে ট্যুরিস্ট পুলিশের ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, বালিয়াড়িতে দোকান বসানো পরিবেশ আইনের লঙ্ঘন। প্রশাসন ব্যবস্থা না নিলে আমরা নিজেরা উচ্ছেদ করব।
লাবনী পয়েন্ট থেকে কলাতলী পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি বালিয়াড়িতেই দোকান বসেছে। বিজিবির ঊর্মি রেস্টহাউসের পাশ থেকে শুরু করে সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত সারিবদ্ধ খাবারের দোকান, ঝিনুকের দোকান, ছাতা-চেয়ার, ওয়াটার বাইক, এমনকি শিশু পার্কও আছে। মাঝে মাঝে সামান্য কিছু ঝাউবন এখনও বেঁচে আছে, কিন্তু সেগুলোও ঘিরে ফেলছে দোকান আর স্থায়ী কাঠামো। সৈকতের নরম বালিয়াড়িতে চলছে বিচ বাইক, আর ঢেউয়ের সঙ্গে লড়ছে ওয়াটার বাইক।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এই দখলের পেছনে রয়েছে একটি বড় দলের সিন্ডিকেট। তারা অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে রাতারাতি দোকান বসিয়েছে।
সুগন্ধা ঝিনুক মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জয়নাল উদ্দিন প্রশ্ন তুলেছেন, বৈধ অনুমতি থাকলে রাতে কেন দোকান বসাতে হবে? এটা স্পষ্ট দখল। অভিযোগে নাম এসেছে স্থানীয় দুই প্রভাবশালী ব্যক্তি– জাকির হোসেন ও নূরুল হুদা ওরফে গুরামিয়ার। তারা নতুন করে ৭৪টি কার্ড কিনে দোকান বসিয়েছেন। তবে দুজনই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজার (টুয়াক) আহ্বায়ক মিজানুর রহমান মিল্কী বলেন, বালিয়াড়ি দখল করে দোকান বসানোয় সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে এবং পর্যটকরা ভোগান্তিতে পড়ছেন। তিনি বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন উচ্ছেদের বদলে দোকান বসানোর অনুমতি দিচ্ছে, যা পরিবেশ ও পর্যটনের জন্য ক্ষতিকর। তাঁর দাবি, ইসিএ ঘোষিত এলাকায় সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সৈকতের প্রাকৃতিক রূপ ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন।
কক্সবাজার সৈকতে স্থাপনা উচ্ছেদ আজ শুরু
কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, সুগন্ধা পয়েন্টে দিয়ে কক্সবাজার সৈকতে নামতেই দেখা যায়, বালিয়াড়িতে নির্মাণ করা হয়েছে অন্তত ৫৫০টি দোকান। এর উত্তর পাশে আরও ১১০টি টং দোকান নতুন করে বসানো হয়েছে। দক্ষিণ পাশে কলাতলী পয়েন্টে বসেছে শতাধিক দোকানসহ কয়েকটি রেস্তোরাঁ। এ ছাড়া লাবনী থেকে কলাতলী পয়েন্ট পর্যন্ত দুই কিলোমিটার বালিয়াড়ির সমুদ্রঘেঁষে উত্তর-দক্ষিণে সারিবদ্ধভাবে বসানো হয়েছে ছাতাসহ হাজারো চেয়ার। এ ছাড়া লাবনী পয়েন্টে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ওয়াটার বাইক আর বিচ বাইক।
শুধু সুগন্ধা, লাবনী, কলাতলী পয়েন্ট নয়; দরিয়ানগর, হিমছড়ি ও ইনানী এলাকায়ও বালিয়াড়ি দখল করে এভাবে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। পরিবেশবাদী ও পর্যটকদের অভিযোগ, এসবের কারণে একদিকে যেমন সৈকতের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে, অন্যদিকে বিপন্ন হচ্ছে সৈকতের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ।
সৈকতের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় বালিয়াড়িতে নির্মিত এসব স্থাপনা উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আজ রোববার থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযানও শুরু হবে। গতকাল শনিবার কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনী, ট্যুরিস্ট পুলিশ, জেলা পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা।
বৈঠকে ট্যুরিস্ট পুলিশের কক্সবাজার অঞ্চলের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক আপেল মাহমুদ বলেন, সৈকতের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা এবং বালিয়াড়ি অক্ষুণ্ণ রাখতে বিভিন্ন আলোচনা হয়েছে। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাহিদুল আলম বলেন, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সৈকতের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় জেলা প্রশাসন কাজ করছে। এরই ধারাবাহিকতায় রোববার থেকে সৈকতে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে। অবৈধ স্থাপনা নিজ উদ্যোগে সরিয়ে নিতে শনিবার বিকেল থেকে মাইকিং করা হয়েছে।
এর আগে গত ২৩ সেপ্টেম্বর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে সৈকতে বসানো অবৈধ দোকান ও স্থাপনা উচ্ছেদ করতে জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এদিকে দোকান মালিকরা জানিয়েছেন, সি-বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির অনুমতি নিয়ে তারা এসব দোকান বসিয়েছেন। পদাধিকার বলে সি-বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক ও সদস্য সচিব পর্যটন হোটেল শৈবালের ব্যবস্থাপক।
সি-বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব রায়হান উদ্দিন বলেন, বালিয়াড়ি থেকে সব স্থাপনা সরিয়ে নেওয়া হবে, এটা নিশ্চিত থাকেন

পাঠকের মতামত