প্রকাশিত: ১৫/০১/২০২২ ৭:৩৩ এএম

মাদকের ভয়াল থাবায় জর্জরিত কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে আলোর পথ দেখাচ্ছেন কিছু নারী। অল্প পুঁজি নিয়ে তাদের কেউ হাঁস-মুরগি পালন করে, কেউ সেলাই কাজ করে, কেউ ক্ষুদ্র ব্যবসা করে সাবলম্বী হয়েছেন। শক্ত হাতে হাল ধরেছেন সংসারের। আর তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হচ্ছেন অন্য নারীরাও।

সীমান্তবর্তী টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম আলী আকবর পাড়া। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ বিজিবির সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন এ গ্রামের বাসিন্দা ইয়াবা কারবারি মাহমুদুর রহমান। মাদক অধ্যুষিত এই এলাকাটিতে এখনও অনেকেই মাদক ব্যবসায় লিপ্ত। তবে সম্প্রতি সেখানে আলোর পথ দেখাচ্ছেন কিছু নারী। এমনই একজন ১৮ বছর বয়সী নুর জাহান। এনজিও থেকে পাওয়া সেলাই প্রশিক্ষন ও অল্প পুঁজিকে কাজে লাগিয়ে হাল ধরেছেন সংসারের।

গ্রামের রাস্তার কাছে পাহাড়ের ঢালুতে নুর জাহানদের কুড়ে ঘর। সেই ঘরের ছাউনি জুড়ে শিম লতার ছড়াছড়ি। ঘরের বারান্দায় বসে সেলাই কাজে মগ্ন নুর জাহান। এসময় কথা হয় তার সাথে।

তিনি জানান, করোনা মহামারী চলাকালে পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। দিনমজুর পিতার কাজ জুটত না ঠিকমত। এমন অবস্থায় প্রায় দেড় বছর আগে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়াল্ড ভিশন থেকে সেলাই প্রশিক্ষন এবং ১৫ হাজার টাকা পেয়েছিলেন তিনি। সেই টাকা দিয়ে একটি সেলাই মেশিন ও প্রয়োজনীয় কাপড়, সুতা ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিক উপকরণ কিনেন। শুরু করেন মাস্ক সেলাইয়ের কাজ। প্রথম দিকে তার তৈরী প্রতিটি মাস্ক বিক্রি হতো ১০০ টাকা। সেই সময় বিক্রিও হয়েছে বেশ। পরে মাস্কের বাজারদর কমতে থাকে। ক্রমে মাস্ক তৈরির কাজ কমিয়ে সালোয়ার কামিজ, ব্লাউজ, পেটিকোট, শার্ট, প্যান্ট সেলাই করা শুরু করেন। তাতে স্বচ্ছলতা ফিরতে শুরু করে সংসারে।

নুর জাহান বলেন, আমি এখন প্রতিদিন কাপড় সেলাই করে ৩০০ টাকার বেশি আয় হয়। মাসে আয় হয় ১০ হাজার টাকার বেশি। এই অর্থ দিয়ে আমি আমার দরিদ্র পিতার পাশে দাঁড়াতে পারছি। ভাইবোনদের পাশে দাঁড়াতে পারছি। এতেই আমার শান্তি। আমাদের সংসারে অনেক স্বচ্ছলতা এসেছে এখন।

তিন বোন ও এক ভাইয়ের সংসারে নুর জাহান সবার বড়। সেই হিসেবে দায়িত্ববোধটাও যেন তার বেশি। সেই কথাই জানালেন দিনমজুর পিতা মফিজুল আলম। তিনি বলেন, করোনা মহামারীর সময় খুব আর্থিক সংকটে দিন কেটেছে। কাজ পাওয়া যেত না। এমন অবস্থা মেয়ে সেলাই কাজ করে আমার পরিবারের হাল ধরেছিল। আমার এখন গর্ব হয় তাকে নিয়ে। তার জন্য এখন আমার অন্য তিন ছেলে-মেয়ে লেখাপড়া করতে পারছে।’

শুধু নুর জাহান নন, এই গ্রামের অনেক নারীই এখন সাবলম্বী হচ্ছেন নিজেদের অদম্য প্রচেষ্টায়। উখিয়া-টেকনাফের প্রত্যন্ত এলাকায় ইউএসএআইডির আর্থিক সহযোগীতায় ওয়ার্ল্ড ভিশন ‘জরুরি খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি’র বাস্তবায়ন করছে। ওই কর্মসূচির আওতায় এই নারীরা পেয়েছেন প্রশিক্ষন ও নগদ ১৫ হাজার টাকা। তা দিয়েই তাদের ভাগ্যবদল শুরু।

হাঁস-মুরগী ও কবুতর পালন করে ভাগ্য বদলের গল্প জানালেন একই গ্রামের আরেক নারী শাকেরা বেগম। ৪০ পেরোনো এই নারী ২০টি মুরগী কিনে বাড়ির আঙিনায় ছোট পরিসরে ফার্ম শুরু করেছিলেন। ক্রমে সেটির আকার কিছুটা বেড়েছে। আঙিনার আরেক পাশে তিনি পালন করছেন কবুতর। বাড়ির পেছনে নতুন করে আরও একটি মুরগীর খামার গড়ে তোলার কাজে হাত দিয়েছেন সম্প্রতি।

শাকেরা বেগম জানান, দিনমজুর স্বামী নুর কবিরের সীমিত আয়ে ৯ সদস্যের সংসার চালানো কঠিন ছিল। চার ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে রবি আলম এখন টমটম চালায়। তিনি হাঁস-মুরগী পালন শুরু করার পর সংসারে স্বচ্ছলতা এসেছে। বর্তমানে তার খামার থেকে প্রতিমাসে ২০টির বেশি মুরগী এবং দশ জোড়ার বেশি কবুতর বিক্রি হয়। তাতে ভালোই চলে সংসার।

প্রায় একই গল্প এই গ্রামের ছেনুয়ারা আকতারের। তিনি জানান, তার স্বামী হাছর আলীও পেশায় দিনমজুর। চার ছেলে ও দুই মেয়ের সংসারে খুব কষ্টে দিনাতিপাত করতে হতো। ১৫ হাজার টাকা পুঁজি পেয়ে ৩০টি মুরগী কিনেছিলেন তিনি। তা পালন করে লাভের মুখ দেখেছেন। এখন প্রতিমাসে তিনি ২০টির বেশি মুরগী বিক্রি করেন। প্রতিটা মোরগ ৭০০ টাকায় এবং প্রতিটা মুরগী ৫০০ টাকার বেশি দামে বিক্রি হয়। সেই অর্থ দিয়ে ভালোই চলছে সংসার।

রাস্তার পাশে নিজের এক টুকরো জমিতে মুদির দোকান খুলেছেন গৃহবধূ সনজিদা বেগম। স্বামী-স্ত্রী মিলে সেই দোকান চালান। তিনি বলেন, দেড় বছর আগের নিজের জমানো কিছু টাকা নিয়ে দোকান খুলেছিলাম। এসময় ওয়াল্ড ভিশন আমাদের ব্যবসা সম্প্রসারনের জন্য প্রশিক্ষন দেয় এবং ১৫ হাজার টাকাও দেয়। তা দিয়ে দোকানের জন্য মালামাল কিনি এবং পুরোদমে ব্যবসা শুরু করি। শাক-সবজি চাষের প্রশিক্ষন ও বীজ পেয়ে পেয়ে বাড়ির আঙিনায় আমি শাক-সবজি চাষ করেছি। এখন আগের তুলনায় আমরা খুব সুখে আছি।

তিনি বলেন, আমার দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে বড় ছেলেকে একটা টমটম কিনে দিয়েছি মানুষের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে। টমটম চালিয়ে যা আয় হয় তা থেকে ঋণ পরিশোধ করি এবং বাকিটা সংসারের জন্য খরচ করে। স্বামী-সন্তান নিয়ে এখন ভালোই আছি।

ওয়ার্ল্ড ভিশন এর জরুরি খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির মাঠ ব্যবস্থাপক মো: আব্দুল বারেক বলেন, জরুরি খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আমাদের ৫ হাজার ২২৯টি পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে ৪৪৫টি পরিবার আছে শর্তবিহীন। যাদের মধ্যে প্রতিবন্ধী, বিধবা, বয়স্ক রয়েছেন। তাদেরকে প্রতি মাসে ৫ হাজার ৬০০ টাকা করে শর্তবিহীন ভাতা দেওয়া হয়। বাকি ৯০ শতাংশ পরিবার অর্থাৎ ৪ হাজার ৭০৬ জন আইজিএ বা আয়বর্ধনমূলক কার্যক্রমের জন্য ১৫ হাজার টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এই টাকা দেওয়ার আগে তাদের প্রশিক্ষন দেওয়া হয়েছে, বিজনেস প্ল্যান ডেভেলপ করে দেওয়া হয়েছে। যারা ফলে তারা তাদের জীবন-মানের পরিবর্তন করতে পেরেছে বলে আমি মনের করি। এর বাইরে আমাদের কাজে বিনিময়ে টাকা কর্মূসচি, পারিবারিক শান্তি-সমৃদ্ধির জন্য ‘মেইল এঙ্গেজমেন্ট’ প্রোগ্রাম রয়েছে। পরিবারগুলোকে বিভিন্ন প্রকারের বীজ দেওয়া হয়েছে। যাতে তারা শাক-সবজি উৎপাদন করতে পারে। এছাড়াও ক্যাশন ফর ওয়ার্কের আওতায় ১১০টি স্কিম করা হয়েছে। যার মধ্য প্রায় ৩২ কিলোমিটার রাস্তা উন্নয়ন কাজ করা হয়েছে।

টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বলেন, একসময়কার ইয়াবা অধ্যুষিত এই জনপদে অভাবের তাড়নায় অনেকে অতীতে ইয়াবা পাচারে জড়ালেও সম্প্রতি মাদকের কারবার কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সাথে যারা কাজ করছেন তারা সর্বনাশা মাদকের থাবা থেকে নিজেদের দূরে রাখছেন। নিজেরা বিভিন্ন আয়বর্ধনমূলক কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। এতে তাদের দেখাদেখি ভালো হওয়ার অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন অন্যরাও।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পারভেজ চৌধুরী বলেন, টেকনাফের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার নানামুখি কার্যক্রমের কারনে পরিবর্তনের ছোঁয়া এসেছে। ভাগ্যবদল হচ্ছে অনেকের। যারা ক্ষুদ্র ব্যবসা করতে আগ্রহী তাদের প্রশিক্ষন, অর্থ সহায়তা এবং প্রয়োজনে ঋণও দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা থেকে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানোন্নয়নে কাজ করছে বর্তমান সরকার।

পাঠকের মতামত

মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এলেন আরও ৫৯ সেনা-বিজিপি সদস্য

আরাকান আর্মির হামলার মুখে ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিজিপি) সদস্যরা পালিয়ে বাংলাদেশের ঘুমধুম সীমান্ত ফাঁড়ির ...