প্রকাশিত: ২৫/০৪/২০১৭ ৭:৫৬ এএম

নিউজ ডেস্ক ::

মঞ্চে বলীদের শক্তি আর কৌশলের লড়াই। চারপাশে হাজারো দর্শকের উল্লাস। এই চিরচেনা ছবি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলী খেলার। এবারও প্রস্তুত লালদীঘি ময়দান। যেখানে আজ বসছে প্রতিযোগিতার ১০৮ তম আসর। বলী খেলাকে কেন্দ্র করে মেলা বসেছে লালদীঘির আশপাশের দেড় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। তবে গত কয়েকদিনের বৈরী আবহাওয়া দূরদূরান্ত থেকে আসা দোকানিদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। বিক্রির জন্য নিয়ে আসা পণ্যসামগ্রী কতোটা শেষ পর্যন্ত বিক্রি করা যাবে, তা নিয়ে সন্দিহান তারা। আবদুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও বৈশাখী মেলা কমিটির সভাপতি কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী জানান, আজ বিকেল সাড়ে তিনটায় চট্টগ্রাম নগর পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার এই বলীখেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। জহর লাল হাজারী বলেন, বলী খেলা আমাদের লোকজ সংস্কৃতির অংশ। জব্বারের বলী খেলায় চট্টগ্রামের বলীদের সংখ্যাই বেশি। তবে কক্সবাজার, টেকনাফ, রামু, উখিয়া, চকরিয়া, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালীসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার বলী খেলোয়াড়রা বলী খেলায় অংশ নিতে ছুটে আসেন। এবারও বলী খেলায় অংশগ্রহণের জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ৭০/৮০ জন খেলোয়াড় নিবন্ধন করেছেন। খেলা শুরুর আগ পর্যন্ত নাম নিবন্ধন করার সুযোগ থাকায় আরো নাম অন্তর্ভুক্ত হতে পারে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন এ আয়োজন চট্টগ্রামের শত বছরের ঐতিহ্য। তবে প্রকৃতির বৈরিতা সম্পর্কে তিনিও চিন্তিত। তেমন হলে উপরে ত্রিপল জাতীয় কিছু দেয়া হবে বলেও জানান তিনি।
অন্যান্য বছর দেখা যেত বলী খেলার একদিন বা দুইদিন আগে থেকেই বৈশাখী মেলা জমজমাট হয়ে উঠত লালদীঘি ও সন্নিহিত এলাকায়। কিন্তু এবার বৃষ্টির কারণে এ চিত্র দেখা যায়নি। দূরদূরান্ত থেকে অনেকে পণ্য নিয়ে এলেও দোকানে পশরা সাজিয়ে বসতে পারেননি। দেখা যায়নি সেই চিরচেনা ভীড়ও। গতকাল সকালে মেলায় কিছু লোকজন এলেও দুপুরের বৃষ্টিতে আবার সব ফাঁকা হয়ে যায়। এ সময় অনেক ব্যবসায়ী তাদের দোকান গুটিয়ে নেন, তখন তাদের চোখেমুখে ফুটে ওঠে একধরণের অসহায়ত্ব। তবে রাতে বৃষ্টি না থাকায় মেলা কিছুটা ফিরে পায় তার চেনা রূপ।
প্রসঙ্গত, বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং একই সঙ্গে বাঙালি যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা এবং শক্তিমত্তা প্রদর্শনের মাধ্যমে তাদের মনোবল বাড়ানোর উদ্দেশ্যে আন্দোলনের কৌশলী সংগঠক চট্টগ্রাম নগরীর বদরপাতি এলাকার সওদাগর আবদুল জব্বার ১৯০৯ সালে বলী খেলার সূচনা করেন। সেই বলী খেলাই এখন প্রধান এক সামাজিক উৎসব। দেশের ঐতিহ্যবাহী লোকজ উৎসবগুলোর মধ্যে জব্বারের বলী খেলা এখনো তার জৌলুশ পুরোপুরি ধরে রেখেছে। নগরায়ণের থাবায় লোকজ রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান লোপ পেলেও জব্বারের বলী খেলা বিলুপ্তির হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছে। শতাব্দী-পুরনো এ মেলা চট্টগ্রামের জনসাধারণের বর্ণিল জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।
আবদুল জব্বার স্মৃতি কুস্তি প্রতিযোগিতা ও বৈশাখী মেলা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও আবদুল জব্বারের নাতি শওকত আনোয়ার বাদল বলেন, খেলাটি আসলে এখন আর আমাদের পারিবারিক বিষয় নয়। সাধারণ মানুষের ভালোবাসার কারণেই এ খেলা এখনো সগৌরবে টিকে আছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ৭০ থেকে ৮০ জন বলী প্রতি বছর এই বলী খেলায় অংশ নেন। সর্বশেষ গত বছরের বলী খেলায় শিরোপা জেতেন উখিয়ার শামছু বলি। তিনি ১৫ বারের শিরোপাজয়ী (১০বার একক ও পাঁচবার যুগ্ম) রামুর দিদার বলীকে পরাজিত করেন। এবারও সমস্ত নজর থাকবে এই দুই শীর্ষ বলীর দিকে। ইতিমধ্যে সাহাবউদ্দিনের বলী খেলায় শামছুকে মাত্র ১ মিনিট ৭ সেকেন্ডে উড়িয়ে দিয়ে শিরোপা জেতা দিদার বলী যে নতুনভাবে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন।
চট্টগ্রামে জব্বার মিয়ার বলী খেলা ও মক্কারঅ বলী খেলার সাথে শারীরিক কসরত প্রদর্শনে গত পাঁচ বছর ধরে সিআরবির শিরিষ তলায় আয়োজিত হয়ে আসছে সাহাবুদ্দীনের বলী খেলা। এছাড়াও পটিয়ার বড় উঠানের মিঞারহাটের বলী খেলা, ভাটিখাইনের বারেকের বলী খেলা, আমজুর হাটের বলী খেলা, সাতবাড়িয়ার কৃষ্ণ নাজিরের বলী খেলা, ইলিশ্যার বঙ্গ হামিদের বলী খেলা, পরান সিকদারের বলী খেলা, তুফান আলী মুন্সীর বলী খেলা, ফতেপুরের বলী খেলা, মাদার্শার বলী খেলা, আমিরাবাদের বলী খেলার কথা বলতে হয়, যেগুলো হারিয়ে গেছে।
আঞ্চলিকতার একটি টান রয়েছে এ খেলায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম জেলা ও বিভাগের বলীরাই বাহুবল, গায়ের জোর ও কৌশলের মধ্য দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখার চেষ্টা চালান। এ খেলাকে ঘিরে এক সময় চট্টগ্রামের আঞ্চলিকতা থাকলেও বর্তমানে দেশব্যাপী এ বলী খেলার প্রচার থাকায় বিভিন্ন এলাকা থেকেও বলীরা এতে অংশ নেন। বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই শহরের সর্বত্র শুরু হয়ে যায় বলী খেলার আলোচনা। আজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লালদীঘি ময়দানে জড়ো হতে থাকবেন বলীরা। সকলেই খুব সুঠাম দেহের অধিকারী হবেন এমন নয়। প্রতিবছরই এ দৃশ্যটি চোখে পড়ে। খেলোয়াড় হিসেবে যারা অংশ নিতে আসেন, তাদের অনেকে নিয়মিত খেলেন না। তবে প্রেমটি আছে। সে প্রেমই তাদের অনুপ্রেরণার উৎস।
জব্বারের এ বলী খেলাকে ঘিরে গ্রামীণ কুটির শিল্পে তৈরি পণ্য ও তৈজসপত্র নিয়ে মেলার আয়োজন হয়। খেলনা ব্যবসায়ী কলিম উল্লা জানান,‘আমরা প্রতি বছর চট্টগ্রামের এই মেলায় যোগ দিই। এখানে বিক্রি বেশ ভালো- লাভও হয়। এবারও বেচা-বিক্রি ভালো হবেই আশা চিল। কিন্তু বৃষ্টির জন্য শেষপর্যন্ত মূল টাকা উঠবে কিনা বুঝতে পারছি না।
সড়কের পাশে জেল গেটের সামনে বসে মাটির টব সাজাচ্ছিলেন সুবোধ পাল। সাভার থেকে আসা এ তরুণ মৃৎশিল্পী জানান, তিনি গত ৩ বছর ধরে এ মেলায় আসছেন। তার বাবা অমর কৃষ্ণ পাল প্রায় এক যুগ ধরে এখানে ব্যবসা করছেন। সুবোধ জানালেন গত ছয় মাস ধরে তারা এ মেলায় আসার প্রস্তুতি নিয়েছেন। এবার বিক্রিতে কেমন প্রত্যাশা? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান- প্রতি বছর ভালো বিক্রি হয়, কিন্তু এবার আকাশের অবস্থা ভালো নয়, বৃষ্টিতে বেশ কিছু টব নষ্ট হয়ে গেছে। দেখা যাক, শেষ পর্যন্ত কী হয়।
তবু জব্বারের বলী খেলা আর বৈশাখী মেলা বলে কথা; তাই ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, মানুষের ঢল নামবেই। দেখা যাবে সেই চির চেনা দৃশ্য-ছেলে বুড়ো সকলের হাতে কিছু না কিছু আছে। কারো হাতে পাখা, কারো বা মাটির ব্যাংক, খেলনা, মুড়ি মুড়কি। মিষ্টি খাবার থেকে মাটির জিনিসপত্র, হাল আমলের মুখোশ থেকে ব্যাটম্যান কিংবা মিকি হাউসের পুতুল, তরমুজ থেকে চিপস, আইসক্রীম, ফুলঝারু কিংবা শীতল পাটি; বাচ্চাদের পাশাপাশি বুড়োদের হাতেও বাঁশি, মাথার লাইট জ্বালানো শিং কিংবা ঢোল।
জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলাকে ঘিরে লালদীঘি ও আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। নিয়মিত টহলের পাশাপাশি গতকাল লালদীঘি ও আশপাশের সাত পয়েন্টে দেড় শতাধিক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আজ ও আগামীকাল দুই শতাধিক অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হবে। পাশাপাশি থাকবে পর্যাপ্ত সাদা পোশাকধারী পুলিশ ও গোয়েন্দা।

পাঠকের মতামত

চট্টগ্রামে ছাত্রদল ও যুবদলের সঙ্গে শিবিরের সংঘর্ষ, গুলিবিদ্ধসহ আহত ২০

চট্টগ্রামে এক যুবককে থানায় নেওয়াকে কেন্দ্র করে ছাত্রদল ও যুবদল নেতা-কর্মীদের সাথে শিবিরের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ ...

কক্সবাজারসহ পাঁচ জেলায় পদযাত্রায় নামছে এনসিপি, হামলার শঙ্কা

চট্টগ্রামসহ পাঁচ জেলায় পদযাত্রা নামছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। আগামীকাল শনিবার (১৯ জুলাই) কক্সবাজারে পদযাত্রার ...