প্রকাশিত: ০৪/০২/২০২১ ৩:২০ পিএম

জেনোসাইডের অভিযোগের জবাব দেওয়ার বদলে সেই অভিযোগ গ্রহণের বৈধতা ও আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের (আইসিজে) বিচারিক এখতিয়ার নিয়েই কিছুদিন আগে প্রশ্ন তোলে মিয়ানমার। সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ১১ দিন আগে গত ২০ জানুয়ারি সু চির সরকার আইসিজেতে এক আবেদনে ওই প্রশ্ন তোলে। আদালত সেই আবেদন গ্রহণ করে রোহিঙ্গা জেনোসাইড মামলার বাদীপক্ষ গাম্বিয়াকে এ বিষয়ে লিখিতভাবে মতামত বা পর্যবেক্ষণ দিতে বলেছে। একই সঙ্গে আদালতের বিধি অনুযায়ী, ওই মামলার ‘মেরিট’ (গ্রহণযোগ্যতা) নিয়ে শুনানি স্থগিত হয়ে গেছে।

এখন সামরিক বাহিনী কিভাবে ওই মামলা নিয়ে কাজ করবে সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী যদি আদালত থেকে সরেও আসে, তবু মামলা চলবে।
জানা গেছে, মিয়ানমারে গত জানুয়ারি মাসের শুরুর দিক থেকেই অং সান সু চির সরকারের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর টানাপড়েন চলছিল। নির্বাচন নিয়ে সামরিক বাহিনীর অসন্তুষ্টির পাশাপাশি রোহিঙ্গা জেনোসাইড ঠেকাতে আইসিজের অন্তর্বর্তী আদেশ পালনের ব্যাপারে নজরদারি বাড়ছিল। মিয়ানমার আইসিজের আদেশ মেনে চলছে বলে যে প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করেছিল তা পর্যালোচনার জন্যও আইসিজে একটি ‘অ্যাডহক’ কমিটি করে দেয়। তা ছাড়া গত নভেম্বর মাসে মিয়ানমারে জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে রোহিঙ্গাদের পুরোপুরি বাইরে রাখাও জেনোসাইডের প্রমাণ হিসেবে আইসিজেতে গৃহীত হতে পারে বলে বিশ্লেষকরা জানাচ্ছিলেন।

জেনোসাইডের অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইসিজের বিচারপ্রক্রিয়া যখন চলছে, তখনই দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। তবে তার আগেই মিয়ানমার আইসিজেকে তার বিচারিক এখতিয়ার ও গাম্বিয়ার মামলাকে আমলে নেওয়ার বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। গত ২৮ জানুয়ারি (মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের তিন দিন আগে) আইসিজের প্রেসিডেন্ট আবদুলকাবি আহমেদ ইউসুফ এক আদেশে মিয়ানমারের আপত্তির বিষয়ে মতামত লিখিতভাবে উপস্থাপনের জন্য আগামী ২০ মে পর্যন্ত গাম্বিয়াকে সময় বেঁধে দিয়েছেন।

২০১৯ সালে আইসিজের অন্তর্বর্তী আদেশের আবেদনের শুনানি পর্বে মিয়ানমার তার বিরুদ্ধে জেনোসাইডের অভিযোগে গাম্বিয়ার মামলা খারিজ করে দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছিল। তবে শুনানি শেষে গত বছরের ২৩ জানুয়ারি আইসিজে অন্তর্বর্তী আদেশের আবেদন গ্রহণ করেন। আইসিজে সেদিন রাখাইন রাজ্যে অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য মিয়ানমারকে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেন। ওই আদেশে চারটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ছিল। সেগুলো হলো—রাখাইনে বসবাসরত সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সেনাবাহিনীর লাগাম টেনে ধরতে হবে। সেনাবাহিনী কিংবা অন্য যেকোনো ধরনের নিরাপত্তা বাহিনী যাতে গণহত্যা না চালায় কিংবা উসকানি না দেয় সে জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
রোহিঙ্গা জেনোসাইডসংক্রান্ত যেসব অভিযোগ এসেছে, সেসংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ সংরক্ষণ করতে হবে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য মিয়ানমার কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে সেসংক্রান্ত প্রতিবেদন পরবর্তী চার মাসের মধ্যে আইসিজের কাছে জমা দিতে হবে। এরপর প্রতি ছয় মাসে একটি করে প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। এসব প্রতিবেদন গাম্বিয়ার কাছে তুলে ধরা হবে।

মিয়ানমার পরিস্থিতিতে নজর রাখেন এমন বিশ্লেষকরা অভিযোগ করে আসছেন, মিয়ানমার আইসিজের আদেশ মানছে না। আইসিজেতে রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে। বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর জোট ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষ থেকে গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জেনোসাইড প্রতিরোধবিষয়ক সনদ লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০১৯ সালে মামলা করে। ওআইসির সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশ একে সমর্থন ও সহযোগিতা করছে। কানাডা ও নেদারল্যান্ডসও এরই মধ্যে ওই মামলার প্রতি সমর্থন জানিয়েছে।

নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট, সংক্ষেপে আইসিসি) কৌঁসুলির দপ্তরও মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের গণবাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আসার মধ্য দিয়ে সংঘটিত আন্তর্জাতিক অপরাধগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। সেখানে গুরুতর অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিবিশেষের বিচার হতে পারে। মিয়ানমারের শীর্ষ জেনারেল ও সামরিক অধিনায়করা জেনোসাইডে উসকানিদাতা ও বাস্তবায়নকারী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন। তবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও বিগত অং সান সু চির সরকার আইসিসির বিচার এখতিয়ার আগেই অস্বীকার করেছে। কারণ মিয়ানমার আইসিসির সদস্য নয়। বাংলাদেশ আইসিসির সদস্য হওয়ায় এ দেশে আসা রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত কিছু অপরাধের বিচারিক এখতিয়ার আইসিসির আছে।

মিয়ানমারে গত সোমবার সামরিক অভ্যুত্থানের পর আইসিজে ও আইসিসিতে চলমান বিচার ও জবাবদিহি প্রক্রিয়ায় কী প্রভাব পড়তে পারে তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে জল্পনা-কল্পনা আছে। সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, আইসিজে ও আইসিসিতে মিয়ানমারের অপরাধের যে জবাবদিহি নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে তা পুরোপুরি আইনি বিষয়। মিয়ানমারে সরকার পরিবর্তন হয়েছে কি না তা তাদের বিবেচনায় আসবে না।

তিনি বলেন, মিয়ানমারে জেনোসাইড হয়েছে কি না সেটিই আদালতের বিবেচ্য একমাত্র ইস্যু। সরকার পরিবর্তনের তিন বছর আগে জেনোসাইড হয়েছে এটি বলে পার পাওয়া যাবে না। সু চির চেহারা দেখানোর কারণে পশ্চিমাদের সহানুভূতি পাওয়ার সুযোগ যদি কিছুটা থাকত তার সুযোগও এখন আর থাকবে না। কারণ এখন সামরিক কর্তৃপক্ষ দেশ চালাবে।

এদিকে রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিষয়ে সোচ্চার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ফোরটিফাই রাইটসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ম্যাথু স্মিথ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সামরিক অভ্যুত্থান রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের সবার জন্য ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। আইসিজেতে এটা কতটা প্রভাব ফেলবে তা অস্পষ্ট। আইসিজেতে মামলায় মিয়ানমার দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি। তিনি এখন বন্দি। সামরিক বাহিনী কিভাবে এই মামলা নিয়ে কাজ করবে তা স্পষ্ট নয়। আইনি দল আগেরটাই থাকবে কি থাকবে না তা-ও বোঝা যাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের উচিত আদালতের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা। তবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী যদি আদালত থেকে সরে আসে তবু মামলা চলবে।’

ফোরটিফাই রাইটস বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন রোহিঙ্গা নিপীড়নের জবাবদিহি নিশ্চিত করার দায়িত্ব আইসিসিকে দেওয়ার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে। কারণ আইসিসি ও আইসিজেতে চলমান উদ্যোগের বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। নিরাপত্তা পরিষদ চাইলে মিয়ানমার পরিস্থিতি তদন্তের দায়িত্ব আইসিসিকে দিতে পারে। এতে মিয়ানমার আইসিসির সদস্য না হলেও এর ওপর আইসিসির পূর্ণ বিচারিক এখতিয়ার প্রতিষ্ঠিত হবে।

পাঠকের মতামত

বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের ব্ল্যাকলিস্ট, তালিকায় এক ডজন দেশ

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের জন্য বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ ও ভিসা পাওয়া আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ...

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে আসিয়ান

রাখাইন রাজ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় মিয়ানমারের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে আসিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। পাশাপাশি ...

ফিলিস্তিনপন্থি গ্রুপকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে ভোট দিয়েছেন টিউলিপ

যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে প্রো-প্যালেস্টাইন কর্মসূচির সংগঠন ‘প্যালেস্টাইন অ্যাকশন’কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবে ...