প্রকাশিত: ২৭/১১/২০১৬ ৭:৩৪ এএম

তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজার   ::

025550rohingya-02_kalerkantho_picমিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে দেশি-বিদেশি গোষ্ঠী ও স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ব্যবসা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। টাকার বিনিময়ে অনুপ্রবেশে সহায়তা, এলাকায় ঘর তুলে ভাড়া দেওয়া, বিদেশ থেকে তহবিল আনার সঙ্গে এসব মহল জড়িত। কোনো কোনো গোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে দেশে জঙ্গিবাদ প্রসারের চেষ্টা করছে। এসব কারণে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ব্যাপারে এসব গোষ্ঠীর এক ধরনের ইন্ধন আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত রবিবার কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের নাফ নদের তীরের নাইটংপাড়ার বাসিন্দা শামসুল আলমকে টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে সহায়তার অভিযোগে এক মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

গত কয়েক দিনে প্রায় এক হাজার অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা পরিবার নাফ তীরের হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে, যেখানে আগে থেকেই রয়েছে কমপক্ষে ১৭-১৮ হাজার রোহিঙ্গা। শিবিরটি গড়ে তোলা হয়েছে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় করে। তার পাশেই বন বিভাগের সামাজিক বনায়নের জমিতে তৈরি করা হচ্ছে নতুন বস্তি। এসব বস্তি বা শেড অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের কাছে ভাড়া অথবা বিক্রি করে দেওয়া হবে।

স্থানীয় লোকজন জানায়, এসব শেড নির্মাণ করছেন মুসলিম এইড নামের একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) সাবেক নিরাপত্তা কর্মকর্তা (সিকিউরিটি সুপারভাইজার) মুফিজ আলম ও তাঁর ভাই মোহাম্মদ আলম। তাঁরা স্থানীয় লেদা গ্রামের বাসিন্দা।

তাঁদের মধ্যে মোহাম্মদ আলম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা তালিকাভুক্ত একজন ইয়াবা পাচারকারী। মুফিজ আলম অস্ত্র, ডাকাতিসহ আরো বেশ কয়েকটি মামলায় মাত্র কয়েক দিন আগে কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। তাঁরা লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরটি নিয়ন্ত্রণ করেন।

জানতে চাইলে মুফিজ আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বনভূমিতে শেড নির্মাণ করছি ঠিক, তবে সেখানে গাছ ছিল না। তাও নির্মাণ করছি নিজের ব্যবহারের জন্য।’ পাশের অনিবন্ধিত শিবিরের শেড বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব শেডের প্রতিটি কক্ষ মাসে ৪-৫ শ টাকা করে রোহিঙ্গাদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়।

সরকারি বনভুমিতে রোহিঙ্গাদের জন্য শেড নির্মাণ প্রসঙ্গে টেকনাফের সহকারী বন সংরক্ষক সরওয়ার আলম বলেন, ‘আমি সংবাদ পেয়ে সেখানে আমার লোক পাঠিয়েছি। এসব আমি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে উচ্ছেদ করে দেব।’

টেকনাফের সাগরপারের ইউনিয়ন বাহারছড়ায়ও বস্তি তৈরি করা হচ্ছে। ইউনিয়নের শামলাপুর বাজার এলাকায় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বস্তি গড়ে তোলা হয়েছে। নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে আরো নতুন বস্তিও তৈরি করা হচ্ছে। বাহারছড়ায় বর্তমানে ১৫ হাজারের বেশি অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। খোদ বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আজিজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তিনিও রোহিঙ্গাদের কাছে শেড ভাড়া দেন বলে জানা যায়। টেকনাফ উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের কর্মীরা সম্প্রতি চেয়ারম্যানের এ রকম বস্তি উচ্ছেদ করে দিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সদস্যদের সঙ্গে গোপন বৈঠকের অভিযোগে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলাও রয়েছে।

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং এলাকায় বন বিভাগের কয়েক শ একর জমিতে রয়েছে রোহিঙ্গা শিবির। এই শিবিরে রয়েছে কমপক্ষে ৬০ হাজার অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা। কুতুপালং অনিবন্ধিত শিবিরটি নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মৌলভী বখতিয়ার আহমদ। তিনি রোহিঙ্গা শিবিরকে পুঁজি করে তৈরি করেছেন বিশাল মার্কেট। এখানে রয়েছে কয়েক শ দোকান। শিবিরে রোহিঙ্গাদের যেকোনো সালিস-বিচারও সম্পন্ন করেন তিনি।

মৌলভী বখতিয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার নিজের জমিতেই দোকানপাট করেছি। তবে এসব দোকানপাটে স্থানীয়দের সঙ্গে রোহিঙ্গারাও কেনাবেচা করে, এটা সত্যি। আমি কোনো অবৈধ কাজে জড়িত নই।’

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার লেদা, বাহারছড়া ও কুতুপালং এলাকায় এভাবে আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে একটি গোষ্ঠী ‘ব্যবসায়িক ফায়দা’ লুটছে বলে মনে করে স্থানীয় অনেকেই। আর সে জন্য কারণে-অকারণে সারা বছর ধরেই অব্যাহত রয়েছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা। স্থানীয় এসব ব্যক্তি ছাড়া রোহিঙ্গাদের উল্লেখযোগ্য পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয় সৌদি আরবভিত্তিক এনজিও রাবেতা আল আলম ইসলামীর মাধ্যমে। ১৯৭৮ সালে মিয়ানমার থেকে আসা তিন লক্ষাধিক রোহিঙ্গার জন্য এই সৌদি এনজিও ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। সেই সময়ই কক্সবাজারের রামু উপজেলার ধোয়া পালং এলাকায় সরকারি ১০ একর জমি নিয়ে এনজিওটি স্থাপন করে একটি হাসপাতাল। এই হাসপাতালে রোহিঙ্গাদের জঙ্গি প্রশিক্ষণের অভিযোগ থাকায় ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এনজিওটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়।

পরবর্তী সময়ে রোহিঙ্গাদের সেবার নামে সীমান্ত এলাকায় আসে নিষিদ্ধ ঘোষিত এনজিও ইসলামী আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা (আইআইআরও), ইসলামী রিলিফ ওয়ার্ল্ডওয়াইড (আইআরডাব্লিউ), আল হারামাইন, ইত্তেহাদুল মুসলেমিন, ওয়ামি, মুসলিম এইডসহ আরো অনেক এনজিও। পরবর্তী সময়ে এসব এনজিওর বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদের অভিযোগ থাকায় রোহিঙ্গা শিবিরে তাদের কার্যক্রম সরকার নিষিদ্ধ করে দেয়। এরপরও ‘রোহিঙ্গা সেবকদের’ তৎপরতা থেমে নেই। পাকিস্তান, সুদান. সৌদি আরব, চীন, আফগানিস্তান, তুরস্ক ও মালয়েশিয়া থেকে নানা এনজিওর নামে প্রতিনিধিদল সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে আসে। বাস্তবে বিদেশি এনজিও রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে সাহায্যের হাত বাড়ালেও ‘রোহিঙ্গা ব্যবসায়ী’রা সেই সাহায্য নানা কৌশলে হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

এমনই একটি ঘটনার বিবরণ দিয়ে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী জানান, এ বছরের ৪ জুলাই টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে টাকা বিতরণকালে পাঁচ চীনা নাগরিকসহ সাতজনকে আটক করেছিলেন বিজিবি সদস্যরা। এ সময় উদ্ধার করা হয়েছিল ১৫ লাখ টাকা ও পাঁচটি মোবাইল ফোনসেট। চীনা নাগরিক ছাড়া আটক দুই বাংলাদেশি হলেন টেকনাফ গোদারবিল আনাস বিন মালিক মাদ্রাসার পরিচালক মৌলভি মো. শফিউল্লাহ ও চট্টগ্রামের বেসরকারি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জামিল তাহের।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ব্যবসায়ী চক্র পাঁচজন চীনা মুসলমান নাগরিককে গত রমজান মাসে বাংলাদেশে নিয়ে আসে। রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্ব দেখিয়ে তাদের মাঝেই নগদ টাকা বিতরণের কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয় রোহিঙ্গা শিবিরে। এ সময় তাদের কাছে ছিল দেড় কোটি টাকা। স্থানীয় কয়েকজন, যারা রোহিঙ্গাদের নিয়ে নানা ‘ব্যবসায়’ জড়িত তারা তাদের হাতে টাকা দিতে বলে ওই চীনা নাগরিকদের। এতে রাজি না হওয়ায় রোহিঙ্গা শিবিরে টাকা বিতরণের সময় পরিকল্পিতভাবে গোলযোগ বাধিয়ে টাকা লুট করে নিয়ে যায় তারা। আগে থেকে তারাই বর্ডার গার্ড (বিজিবি) সদস্যদের খবর দিয়েছিল যে অবৈধভাবে শিবিরে টাকা বিতরণ করা হবে। ঘটনার সময় বিজিবি সেখানে অভিযান চালিয়ে চীনা ওই পাঁচ নাগরিক ও তাদের স্থানীয় দুই সহযোগীকে আটক করে।

এ ঘটনার ব্যাপারে টেকনাফ থানার ওসি আবদুল মজিদ জানান, বিদেশি এনজিও বা ব্যক্তির এ রকম টাকা বিতরণে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি থাকতে হয়। কিন্তু তা না থাকায় বিজিবি তাঁদের শিবির থেকে আটক করে থানায় নিয়ে এসেছিল।

প্রতিবছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার সময় কক্সবাজার সীমান্তের রোহিঙ্গাদের জন্য কোটি কোটি টাকার তহবিল পাঠানো হয়। বিভিন্ন মুসলিম দেশের এনজিও ও ব্যক্তিগতভাবে পাঠানো এসব তহবিল রোহিঙ্গাদের দেওয়ার ব্যাপারে সরকারি অনুমোদন থাকে না। এ কারণেই সীমান্তের রোহিঙ্গা শিবির নিয়ন্ত্রক হিসেবে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি যাঁরা কাজ করেন তাঁরা এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) নেতারা এই তহবিলের টাকা পেয়ে থাকেন। সরকারের অনুমতি ছাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে ব্যক্তিগতভাবে কোরবানির গরুর মাংস বিলি করতে গেলে ২০১২ সালের ২৯ অক্টোবর তুরস্কের একজন সাবেক পার্লামেন্ট সদস্যসহ ১৭ বিদেশি নাগরিককে আটক করা হয়েছিল।

গেল বছর টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আজিজ উদ্দিনকে ৯৯টি গরুসহ টেকনাফ থানা পুলিশ আটক করেছিল। তুরস্কের এনজিওর টাকায় রোহিঙ্গাদের জন্য তিনি এসব গরু কিনেছিলেন। তুরস্কের এনজিও প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিলি করতে এসে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য (সাবেক আরকান) বাংলাদেশের অংশ হিসেবে উল্লেখ করে আপত্তিকর ব্যানারও টানিয়েছিলেন।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে স্বার্থান্বেষী এসব মহলের তৎপরতার বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, “দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে যারা রোহিঙ্গাদের আর্থিক সুবিধার লোভে অনুপ্রবেশ করাচ্ছে তাদের তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে। তদুপরি ইতিমধ্যে এসব ‘রোহিঙ্গা ব্যবসায়ী’র বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ায়ও শুরু করা হয়েছে।”

জেলা প্রশাসক বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক দৃষ্টিকোণ রয়েছে আমাদের, কিন্তু নিজের দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে মানবিকতা কোনোভাবেই দেখানো হবে না।’  সুত্র: কালেরকন্ঠ

পাঠকের মতামত

কক্সবাজারে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র চালু, দৈনিক উৎপাদন ৩০ মেগাওয়াট

কক্সবাজার সদর উপজেলার বাঁকখালী নদীর খুরুশকুল উপকূলে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছেছবি: প্রথম আলো কক্সবাজার সদর উপজেলার ...

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে টার্গেট কিলিং!

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে চলছে ‘টার্গেট কিলিং’। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড ...

জান্নাতুলকে খুনের কথা আদালতে স্বীকার করলেন কক্সবাজারের রেজা

রাজধানীর পান্থপথে আবাসিক হোটেলে চিকিৎসক জান্নাতুল নাঈম সিদ্দিকা হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন ...

খাদ্য সংকটে সেন্টমার্টিন

হেলাল উদ্দিন সাগর :: বৈরী আবহাওয়ার কারণে গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন ...