বাংলাদেশের সীমান্তে মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলোর টাওয়ারের কারণে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় বড় ধরনের হুমকির সৃষ্টি হয়েছে। এসব টাওয়ার স্থাপিত হওয়ায় ভারত ও মিয়ানমারের ভেতরে প্রায় ৩০-৩৫ কিলোমিটার পর্যন্ত নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে। ফলে ওইসব অঞ্চল থেকে বাংলাদেশের যে কোনো স্থানে যেমন কথা বলা যাচ্ছে, তেমনি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে স্থানান্তর করা হচ্ছে চাহিদামাফিক অর্থ। এর মাধ্যমে পাচার হচ্ছে অর্থও। চোরাচালানের পণ্যের অর্থও পরিশোধ করা হচ্ছে। প্রমাণ পাওয়া গেছে মানবপাচারের অর্থ স্থানান্তরেরও।
সন্ত্রাসীরাও দেশে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা- সংঘটন করে সীমান্তের ওপারে পালিয়ে মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে অর্থ নিচ্ছে। একই সঙ্গে দেশের ভেতরে কথা বলে অপরাধমূলক কর্মকা- ঘটাচ্ছে। জঙ্গি কর্মকা-েও এসব মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহৃত হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি আলাদা প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে সীমান্ত অপরাধ প্রতিরোধ, প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে থাকা সন্ত্রাসীদের মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে নানা সুবিধা নেওয়া ও টাকা পাচার বন্ধে এসব টাওয়ারে কাঠামোগত পরিবর্তন আনার সুপারিশ করা হয়।
ব্যাংকগুলোর প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তাদের সংগঠন সিটিও ফোরামের সভাপতি তপন কান্তি সরকার বলেন, মোবাইল কোম্পানির টাওয়ার স্থাপনে সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সমঝোতার প্রয়োজন রয়েছে। সীমান্তে টাওয়ার স্থাপন করলে এর নেটওয়ার্ক সীমান্তের বাইরে অন্য দেশে চলে যাবে এটাই স্বাভাবিক। এটি থেকে দুষ্কৃতকারীরা যাতে কোনো সুবিধা নেওয়ার সুযোগ না পায় সেদিকে খেয়াল রেখে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন আনা উচিত। একই সঙ্গে এসব নেটওয়ার্ক যেসব কর্তৃপক্ষ ব্যবহার করে তাদের উচিত সব ধরনের সিকিউরিটি নিশ্চিত করা। অবৈধভাবে অবৈধকাজে নেটওয়ার্ক বা মোবাইল ব্যাংকিং যেন কেউ ব্যবহার না করতে পারে সেই বিষয়ে পূর্ব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। পরে এর একটি অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। ওখানে থেকে এটি পাঠানো হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। পরে এটি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকারের একাধিক গোয়েন্দা নানা ধরনের বৈঠক করে নিরাপত্তার ঝুঁকিগুলো শনাক্ত করে। এর ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কিছু সুপারিশ তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। যেগুলো নিয়ে এখন কাজ হচ্ছে।
মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দুটি জেলা এবং ভারতের সঙ্গে ২৮টি জেলার সীমান্ত আছে। ওইসব জেলার প্রতিটিতে মোবাইল অপারেটরগুলোর একাধিক টাওয়ার রয়েছে। ওইসব টাওয়ার থেকে সীমান্তের ওপারে ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বাংলাদেশের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। ফলে ভারত ও মিয়ানমারের বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো থেকে অবাধে দেশের ভেতরে কথা বলা যায়। একই সঙ্গে টাকা স্থানান্তর করাও যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা এ বিষয়ে বলেন, মোবাইল নেটওয়ার্ক বিস্তার ও দেশের বাইরে বসে এর অপব্যবহার নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংককে জানায়। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে যেন দেশের বাইরে এবং ভেতরে কোনো অবৈধ কাজের জন্য অর্থ লেনদেন না হয় সেই বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক রয়েছে। চট্টগ্রাম অফিসকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ওই অঞ্চলে ব্যাংকের শাখায় পরিদর্শন করার ক্ষেত্রে অন্তত একদিন সময় বেশি নিয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্টদের লেনদেন খতিয়ে দেখতে।
তিনি বলেন, আগে যেভাবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের কথা শোনা যেত এখন লেনদেন সীমা ও সিম বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশনের কারণে তা অনেক কমে গেছে। তবে সীমান্ত এলাকায় সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত লেনদেন করতে নেটওয়ার্ক বন্ধ করা উচিত। এটি বন্ধ করা সম্ভব কিনা তা বিটিআরসি ও সরকার খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিতে পারে। অথবা প্রযুক্তির মাধ্যমে সীমান্তের ওপারে যাতে দেশের কোনো মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া না যায় সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত কর্মকর্তারা বলেছেন, টেকনাফ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের আকিয়াব ও মডং এলাকায় বড় ধরনের বাজার রয়েছে। ওইসব বাজারে বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে। ফলে ওখান থেকে অবাধে যোগাযোগ করা যাচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে। এমনকি ওইসব বাজারে বাংলাদেশের নগদ টাকাও লেনদেন হচ্ছে। একই অবস্থা দিনাজপুরের হিলি, লালমনিরহাটের বুড়িমারী, যেেশারের বেনাপোলের ওপারের সীমান্ত এলাকাগুলোয়।
তারা জানান, সীমান্তের ওপারে গিয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা স্থানান্তর করে তা অন্য মুদ্রায় রূপান্তর করে নিজের প্রয়োজন মেটাচ্ছে। এতে করে দেশের টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এসব অর্থ সন্ত্রাসবাদী কর্মকা-সহ জঙ্গি অর্থায়নে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কাও করছেন তারা।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ের জন্য টেকনাফ ও বান্দরবানের মিয়ানমারের সীমান্তে বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে চোরাচালান, মানবপাচার, মাদক কেনাবেচা ইত্যাদি অবৈধ কারবারের এ প্রক্রিয়ায় অর্থ লেনদেন হচ্ছে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আমাদের সময়
পাঠকের মতামত