
এম বশিরুল আলম :
লামা-আলীকদমে ভূমি জালিয়াত চক্রের দৌরাত্ম বেড়ে চলেছে। মোটাংকের উপরির বিনিময়ে করা মিস মামলার মাধ্যমে ভূমি মালিকানা হারাচ্ছেন অনেকে। ভূয়া জাল দলিল সৃজন প্রতিযোগিতায় দালালদের খপ্পরে পড়ে সর্বশান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। খোদ জনপ্রতিনিধিরাও এ চক্রজালে আটকে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। জীবিতকে মৃত দেখিয়ে হেডম্যান-চেয়ারম্যানদের মিথ্যা সনদ তৈরি করে, অন্যে বাবার সন্তান পরিচয় দিয়ে ভূয়া ওয়ারিশ সেজে ভূমির মালিক হয়েছে অনেকে।
জেলায় ভূমি প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট অফিসসহকারি, নকল প্রস্তুতকারিসহ রেকর্ড রুমে দায়িত্ব পালনকারিদের সাথে বড় অংকের টাকার বিনিময়ে এসব জালিয়াতি হচ্ছে। সম্প্রতিক বছরগুলোতে ভূমি সংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে সামাজিক অস্থিরতা প্রকট আকার ধারণ করায় এ নিয়ে টনক নড়ে উঠে সকলের। ইতোমধ্যে লামা উপজেলার কয়েকটি সম্পুর্ন ভিত্তিহীন, অযৌক্তিক, সংশ্লিষ্টাত বিহীন, মিস মামলা মূলে সৃজিত রেকর্ড সংশোধন করার নির্দেশ দেয় জেলা প্রশাসক। এই নির্দেশের প্রেক্ষিতে কয়েকটি মিস মামলা রেকর্ড সংশোধন ও বাতিল হয়। আরো কিছু মামলা বাতিলের পক্রিয়া চলছে বলে জানাগেছে।
এই ধরণের জালিয়াতির শিকার আলীকদম উপজেলাস্থ্য চৈক্ষ্যং ইউপির এক প্রজা সামচুন নাহার সাম্পা খাতুন। ভূমিহীন প্রজা হিসেবে সাম্পা খাতুন ১৯৮০-৮১ সালে আলীকদমের ২৮৯ নং চৈক্ষ্যং মৌজায় সাড়ে চার একর ভূমির মালিক হয়। ৫৮১৭ নং বন্দোবস্তি মোকাদ্দমা মূলে সাড়ে তিন একর ২য় ও এক একর ৩য় শ্রেণির দু’চৌহদ্দিতে আর হোল্ডিং-১৬৫ এর মালিকানা লাভ করেন। সাম্পা খাতুনের স্বামী আ: রশিদ ১৯৮২ সালে ম্যালেরিয়া আক্রান্ত সহয়ে মারা যায়। এর পর সেড়ড় অন্য একজনকে স্বামী হিসেব গ্রহন করে দীর্ঘদিন সংসার করার পর ২০১৬ সালে সেও মারা যায় এবং এ সংসারে কোন সন্তান বেঁচে নেই। আগের সংসারের একমাত্র ছেলে ওসমান গনি ছাড়া আর কোন ওয়ারিশ নেই।
এদিকে সাম্পা খাতুনকে মৃত দেখিয়ে নুর হোসেন নামের একজন ভূমি দালাল সাম্পা খাতুন ও মৃত আ: রশিদের একমাত্র ওয়ারিশ সেজে বানোয়াট কাগজপত্র দিয়ে নামজারি মামলা চালু করে। মামলা নং-আক/৪৮/২০১৩ এর অনুবলে বান্দরবান জেলা প্রশাসকের আদেশমতে বিগত ১৮/৫/২০১৪ সালে আর/১৬৫ নং হোল্ডিং এর ওয়ারিশী মালিকানা প্রদান করা হয় মো: নুর হোসেনকে। জেলা রেকর্ড রুম থেকে সরবরাহকৃত জমাবন্দি নকল কপিতে উল্লেখ রয়েছে, ‘আর/১৬৫ নং হোল্ডিং এর প্রজা মৃত (!)সাম্পা খাতুন স্বামী মৃত আ: রশিদ মারা যাওয়ায় তার নামীয় চার একর পঁঞ্চাশ শতক ২য় ও তয় শ্রেণির জমি তার একমাত্র ওয়ারিশ মো: নুর হোসেন, পিতা- মৃত আ: রশিদ এর নামে ওয়ারিশ সূত্রে নামজারীর আদেশ হয়’।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানাযায়, মেজর জামানপাড়ানিবাসী বিধবা সাম্পা খাতুন এখনো জীবিত। তাঁর একমাত্র ছেলে (ওয়ারিশ) রয়েছে, তার নাম ওসমান গনি। ওসমান গনি একজন গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য। অপরদিকে ভুয়া ওয়ারিশ মো: নুর হোসেন-এর পিতা আ: রশিদ লামা উপজেলার রুপসিপাড়া ইউনিয়নের একজন বাসিন্দা, তিনি এখনো জীবিত। মো: নুর হোসেন ৯০’র দশক থেকে আলীকদম উপজেলা চৈক্ষ্যং ইউনিয়নে বসবাস করছে। আলীকদম উপজেলা ভূমি অফিসে দালালি ও ভূমি পরিমাপে একজন অভিজ্ঞ লোক হিসেবে এলাকায় পরিচিতি রয়েছে মো: নুর হোসেনের।
এদিকে প্রতারণা করে ওয়ারিশ সেজে সাম্পা খাতুনের সাড়ে চার একর ভূমি নিজের নামে নামজারী করিয়ে; নুর হোসেন ওই জমি অন্য জনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। ফলে বিধবা সাম্পা খাতুন ও তাঁর একমাত্র ওয়ারিশ ওসমান গনি এখন ভূমিহীন নি:স্ব। ওসমান গনির ৩ মেয়ে ১ ছেলে, মায়ের ওই সম্পদ টুকু ছাড়া তার আর কোন অবলম্বন নেই। সাম্পা খাতুন সন্তান ও নাতি নাতনী নিয়ে মেজর জামানপাড়ায় এক টুকরো খাস জমিতে বসবাস করছে। সোমবার (২ অক্টবর) সাম্পা খাতুন এই প্রতিনিধিকে জানান, মো: নুর হোসেন নামের কাউকে তিনি জীবনে দেখেনওনি। কিভাবে নুর হোসেন তার ওয়ারিশ সেজে এত বড় জালিয়াতি করতে পারলো! বিস্ময় প্রকাশ করেন বিধবা সাম্পা খাতুন। প্রতারক মো: নুর হোসেনের বিচার চেয়ে জমি ফেরৎ পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা কামণা করছেন সাম্পা খাতুন ।
অপরদিকে ভূয়া ওয়ারিশ মো: নুর হোসেন থেকে উক্ত সাড়ে চার একর জমি ক্রয় করেন স্থানীয় ৬নং ওয়ার্ড সদস্য মো: জাকির হোসেন। আলীকদম উপজেলা বায়না নামা দলিল নং-৯৩/১৬ মূলে বিক্রিত জমি বর্তমানে জাকির হোসেন মেম্বারের নামে মিউটেশন মামলা চালু করে সাব কবলা সম্পাদনের পর্যায় রয়েছে । বিরোধ এড়াতে উক্ত সাব কবলা দলিল বাতিল করার দাবী তুলেছে স্থানীয়রা।
সরেজমিন অনুসন্ধানে আরো জানাযায়, প্রতারক নুর হোসেন ভূয়া ওয়ারিশী সূত্রে মালিক হওয়া ১৬৫ নং আর/হোল্ডিং-এর জমিটি জাকির হোসেন মেম্বারের কাছে বিক্রি করে দখল বুজিয়ে দিয়েছে দেড় কি:মি: দূরের প্রজা এজাহার আহামদ-এর খাস দখলীয় (আবেদিত) ভূমি। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগি প্রজা এজাহার আহামদ বান্দরবান জেলা নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে বিচার প্রার্থী হলে, মিস.সি.আর মামলা-৫৩/২০১৬ সূত্রপাত হয়। গত ২৪ জানুয়ারি/১৭ তারিখে আলীকদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে মো: নুর হোসেন-এর জালিয়াতি পূবর্কক ওয়ারিশী নামজারী মামলা বাতিল ও জাকির হোসেন মেম্বারের সাথে সম্পাদিত সাব বিক্রয় নামা দলিল বাতিলের আরো একটি পিটিশন আবেদন দাখিল করেন।
এ ব্যাপারে আলীকদম উপজেলা নির্বাহী অফিসার নায়েরুজ্জামান বলেন, বিষয়টি সত্য প্রমানিত হলে প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে ওইসব দলিল বাতিলের জন্য জেলা প্রশাসনে প্রতিবেদন দেয়া হবে। ৪ অক্টোবর সাম্পা খাতুনের কাছে এসব জালিয়াতির কথা শুনে ইএনও বিস্ময় প্রকাশ করেন। একই সময় সাম্পা খাতুনের কাছ থেকে একটি লিখিত অভিযোগ গ্রহন করেন আলকিদম ইএনও।
চৈক্ষ্যং ইউপি চেয়ারম্যান ফেরদৌস রহমান জানান, সাবেক চেয়ারম্যান-এর কাছ থেকে কিভাবে মিথ্যা ওয়ারিশ সনদ নিয়েছে তা জানা নেই। তবে মৃত আ: রশিদের স্ত্রী সাম্পা খাতুন তার ইউনিয়নের একজন অসহায় বিধবা নারী এবং একজনমাত্র সন্তান ওয়ারিশ রয়েছে, যার নাম ওসমান গনি।
সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড সদস্য অলিউর রহমান জানান, সাম্পা খাতুন তার ওয়ার্ডের একজন নিরিহ বিধবা নারী। প্রতারণার বিষয়টি তিনি আগেও জেনেছেন; এ ব্যাপারে অভিযোগ করার পরামর্শও সাম্পা খাতুনকে।
সাম্পা খাতুনকে মৃত দেখিয়ে নুর হোসেনকে তার একমাত্র ওয়ারিশ হিসেবে কিভাবে সনদ দেয়া হয়েছে; এ বিষয়ে ২৮৯ নং চৈক্ষ্যং মৌজা হেডম্যান ঞোমং ও চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীনের সাথে একাধিকবার চেষ্টা করেও তাদের বক্তব্য নেয়া যায়নি।
৩ অক্টোবর দুপুরে রুপসিপাড়া বাজারে নুর হোসেন এর পিতা আ: রশিদ (৯২)এর সাথে আলাপ কালে সে জানান, তার ছেলে নুর হোসেন আলীকদম চৈক্ষ্যং ইউনিয়নে বসবাস করেন। একজন বিধবা দরিদ্র নারীর মিথ্যা ওয়ারিশ সেজে ভু-সম্পত্তি আত্মসাতের জন্য সেও দু:খ প্রকাশ করে এর বিচার দাবী করেছেন।
এদিকে সাম্পা খাতুন জানান, সে আলীকদম উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে ইতোপূর্বে বান্দরবান জেলা প্রশাসনের কাছে নুর হোসেন এর জালিয়াতি মিস মামলা বাতিলের আবেদন করেছিল। কিন্তু তার কোন সুরাহা সে পায়নি। এছাড়া জালিয়াতির মাধ্যমে জেলা প্রশাসক থেকে নেয়া নুর হোসেন-এর ওয়ারিশ সনদ বাতিলের জন্য সাম্পা খাতুন সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা কমণা করেন।
এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি ও গন্যমান্যরা প্রশাসনে নজর দাবী করেছে।
পাঠকের মতামত