ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ৩০/০৪/২০২৩ ৬:৪৫ এএম

সাহাদাত হোসেন পরশ, ঢাকা ও ইব্রাহিম খলিল মামুন, কক্সবাজার::
ইয়াবার চেয়ে কয়েক গুণ ক্ষতিকর মাদক ক্রিস্টাল মেথ বা আইসের বিশাল নেটওয়ার্ক এখন বাংলাদেশে। মূলত মিয়ানমার থেকে নানা কৌশলে দেশে ঢুকছে এই মাদক। ইয়াবার পাশাপাশি আইসের ব্যাপক বিস্তৃতির কারণে উদ্বিগ্ন সচেতন মহলও।

সমকালের তথ্যানুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, আইস-বাণিজ্য এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন মিয়ানমারের নাগরিক শীর্ষ মাদক কারবারি নবী হোসেন। গত কয়েক মাসে কক্সবাজারে জব্দ ভয়ংকর মাদকের চালানের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।

মিয়ানমারে বসেই বিশ্বস্ত সহযোগীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে মাদক পাচার করেন তিনি। মূলত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাঁর বড় ধরনের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। ছোট-বড় চালান ক্যাম্পে পৌঁছে দেওয়ার পর কৌশলে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়। সর্বশেষ ২৬ এপ্রিল উখিয়ার পালংখালী সীমান্তে অভিযান চালিয়ে ২১ কেজির সর্ববৃহৎ চালান জব্দ করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।

দেশের ইতিহাসে এটি ছিল আইসের সর্ববৃহৎ চালান। এর বাজার মূল্য শতকোটি টাকার ওপরে। আইস জব্দের ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে আবার সামনে এলো নবী হোসেনের নাম। বৃহৎ ওই চালানটিও তাঁর। বছরখানেক আগে তাঁকে ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল বিজিবি। বিভিন্ন জায়গায় পোস্টারিংও করা হয়। তবে নবী হোসেনের হদিস মেলেনি। উল্টো এখন ইয়াবার পাশাপাশি তাঁর হাত ধরে একের পর এক দেশে ঢুকছে আইসের চালান। পুরস্কার ঘোষিত শীর্ষ এই মাদক কারবারি এখন আইসের জগতেও ভয়ংকর হয়ে উঠেছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম চৌধুরী সমকালকে বলেন, আইসের চালানের সঙ্গে নবী হোসেনের সংশ্লিষ্টতা আমরা পাচ্ছি। সীমান্তের ওপারে দলবলসহ বসে অনেক দিন ধরে সে মাদক চক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাকে ধরিয়ে দিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল, সেটা এখনও বলবৎ রয়েছে। মিয়ানমারের নাগরিক হওয়ায় সেইভাবে নবীর ব্যাপারে তথ্য পাচ্ছি না।

ফলো করুন-
ভিডিও দেখতে সাবস্ক্রাইব করুন সমকাল ইউটিউব
মাদকবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক ইমদাদুল হক সমকালকে বলেন, এখন পাগলা ঘোড়ার মতো আইসের বিস্তৃতি বাড়ছে। এটা সমাজের জন্য উদ্বেগজনক। হয়তো এর পরও মাদকের অন্য কোনো ভার্সন আসতে পারে। এসব নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তরুণদের জন্য খারাপ সময় আসছে।

একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র সমকালকে জানায়, বালুখালীর রহমতের বিল ও আঞ্জুমানপাড়া দিয়ে নবী হোসেন আইসের চালান প্রায়ই ঢোকানোর চেষ্টা করেন। সর্বশেষ বিজিবি যে চালানটি জব্দ করেছিল, সেটির গন্তব্য ছিল উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। কয়েক বছর ধরেই ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের নানা কিছু উপহার দিয়ে আসছেন নবী হোসেন। রোজা ও ঈদে অনেক উপহার পাঠান। অনেক সময় তাঁর দেওয়া গরু ক্যাম্পে কোরবানি দেওয়া হয়। এসব কারণে ক্যাম্পে অনেকের কাছে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়।

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে দেশটির নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। ওই সময় বাংলাদেশে আসেন নবী হোসেন। তাঁর বাড়ি রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের ঢেকুবনিয়ায়। বাবার নাম মোস্তাক আহমদ। বালুখালী ক্যাম্পে আশ্রয় নেন তিনি। এপারে আসার কিছুদিন পরই মাদক কারবার শুরু করেন। মিয়ানমার থেকে ছোট-বড় চালান ক্যাম্পে নিয়ে আসেন। শুরুর দিকে ইয়াবার চালান আনতেন। এর পর আইসের ব্যবসা শুরু করেন। নবী হোসেন তাঁর নামে ক্যাম্পে একটি বড় সন্ত্রাসী বাহিনীও তৈরি করেছিলেন। ক্যাম্পে যত ধরনের মাদক ঢোকে তার ৮০-৯০ ভাগ তাঁর নিয়ন্ত্রণে মিয়ানমারকেন্দ্রিক বেশ কিছু সশস্ত্র গ্রুপ মাদকের অর্থের ভাগের বিনিময়ে নবীকে সহযোগিতা করে আসছে। আবার মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) সঙ্গে কয়েকবার নবীর বাহিনীর গোলাগুলি ও সংঘর্ষ হয়েছে।

স্থানীয় কারও কারও ভাষ্য, নবী হোসেন মাঝেমধ্যে ক্যাম্পে প্রবেশ করে বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন। টেকনাফের দুর্গম মিজ্জির পাহাড়ের আস্তানায় রাত কাটান। তাঁর বাহিনীর কাছে একে-২২ রাইফেলসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ রয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, নবী হোসেন ক্যাম্পে নেই। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বসেই তিনি মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন।

২১ কেজির চালানের জব্দের ঘটনায় তিনজনকে আটক করা হয়। তাঁরা হলেন– বুজুরুজ মিয়া, ইসমাইল ও ছৈয়দুল বাশার। গ্রেপ্তারকৃতদের তিন দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। নবী হোসেনের ওই চালানটি এপারে আসার পর দেখভালের দায়িত্ব ছিল বুজুরুজের। এতে অর্থলগ্নিও করেন তিনি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইসের চালানটি আনার পর অল্প অল্প করে তা রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দেওয়ার কাজটি সমন্বয়ও করার কথা ছিল বুজুরুজের। তাঁর বিরুদ্ধে মাদক প্রতিরোধ আইনে উখিয়া থানায় তিনটি মামলা রয়েছে।

উখিয়ায় নবী হোসেনের বাংলাদেশি সহযোগী বুজুরুজের নির্মাণাধীন বাড়ি

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, আইস চক্রে কারা রয়েছে, তা বের করতে গ্রেপ্তারকৃতদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এই ঘটনার কেউ পার পাবে না।

উখিয়া থানার ওসি শেখ মোহাম্মদ আলী সমকালকে বলেন, বুজুরুজ মিয়া ও তাঁর সহযোগীরা আইস কারবার নিয়ে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তদন্তের স্বার্থে এখনই সব বলা সম্ভব নয়।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৮ নাম্বার ক্যাম্পের অভ্যন্তরে অন্তত ১০ একর বনভূমি অবৈধভাবে দখল করে বুজুরুজ গড়ে তুলেছেন বাগানবাড়ি। সেখানে তাঁর ৩০টি দোকান রয়েছে। এ দোকানগুলো ভাড়া দিয়েছেন রোহিঙ্গাদের। ভাড়া দিয়েছেন দুটি এনজিওকে অফিস করতে। এ ছাড়া পূর্ব পালংখালীতে তাঁর রয়েছে নির্মাণাধীন একটি বাড়ি। রোহিঙ্গা এবং কয়েকজন বাংলাদেশি অসাধু ব্যক্তিকে নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন একটি অপরাধ সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের সদস্যরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসে স্বর্ণ, চোরাচালান, ইয়াবা ও আইস কারবার করছেন। সবকিছু মিলিয়ে বুজুরুজ মিয়া পালংখালী সীমান্ত এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক মাদক পাচার চক্রের বড় হোতা।

কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের বালুখালী বাজার থেকে পূর্বে এক কিলোমিটার মেঠোপথ পাড়ি দিলেই রাস্তার পাশে চোখে পড়ে বুজুরুজ মিয়ার নির্মাণাধীন বাড়িটি। এর পূর্ব-দক্ষিণ পাশেই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত। বাড়ির সামনে দাঁড়াতেই কাঁদতে কাঁদতে সামনে এলেন ২৫ বছর বয়সী এক নারী। তাঁর নাম রাবেয়া বসরী। তিনি বুজুরুজ মিয়ার বড় মেয়ে। রাবেয়া বসরীর দাবি, ‘তাঁর বাবা অন্যায়ের স্বীকার।’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) উখিয়া-টেকনাফের অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মোস্তফা কামাল সমকালকে বলেন, যে পথে মিয়ানমার থেকে দেশে ইয়াবার চালান ঢুকছে, সেই একই পথ দিয়ে আসছে আইস। যারা আইসের ব্যবসা করছে, তারাই মূলত ইয়াবা ব্যবসায়ী।

পরিসংখ্যানই বলছে, দেশে আইসের বিস্তৃতি বাড়ছে। ২০২১ সালে ৩৬ কেজি আইস জব্দ করা হয়। ২০২২ সালে জব্দ করা হয়েছে ১১৩ কেজি ৩৩১ গ্রাম। দেশের ইতিহাসে প্রথম ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মোহাম্মদপুর থেকে ৮ গ্রাম আইসসহ তিনজনকে আটক করা হয়। তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে ঢাকায় একটি ল্যাবের সন্ধান মেলে। এর পর ২০১৯ সালের ২৭ জুন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে ক্রিস্টাল মেথসহ একজন নাইজেরীয় নাগরিককে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। আইস গ্যাংয়ে বিদেশি নাগরিকদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার পর নিশ্চিত হওয়া যায়, বাংলাদেশকে এর রুট হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা চলছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক কর্মকর্তা দুলাল কৃষ্ণ সাহা সমকালকে বলেন, ইয়াবার তুলনায় কয়েক গুণ ক্ষতিকর আইস। ইয়াবায় এমফিটামিন থাকে ১০-১৫ ভাগ। আইসে এমফিটামিন প্রায় ৯৬ শতাংশ। তাই আইস মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর মাদক। সুত্র;সমকাল

পাঠকের মতামত

কুতুপালং পশ্চিমপাড়ায় পরিচয় যাচাইহীন রোহিঙ্গা ভাড়া, বাড়ছে শঙ্কা

মিয়ানমারের রাখাইনে আরাকান আর্মি ও সেনা জান্তার সংঘর্ষে প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। সীমান্ত ...

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মানবিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে ইউনাইটেড নেশন টিম

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন ইউনাইটেড নেশন ফোরাম বাংলাদেশ স্টাডি প্রোগ্রাম (BSP) এর ...

কক্সবাজারে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ধর্ম ও প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ

কক্সবাজারে বাল্যবিবাহ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হলো “বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে করণীয়” শীর্ষক আন্তঃধর্মীয় নেতৃবৃন্দের ...