
শাহীন মাহমুদ রাসেল, বিডিটোয়েন্টিফোর লাইভ ডটকম::
কক্সবাজারের রামু ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চোরাচালান চক্র। প্রশাসনের দুর্বল নজরদারির কারণে এই দুই উপজেলার সীমান্তে চোরাচালান চক্রের শক্তিশালী বলয় গড়ে উঠেছে। সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রতিনিয়ত মিয়ানমার থেকে নিয়ে আসছেন সিগারেট, অস্ত্র, স্বর্ণ, গরু, বিস্ফোরক ও মাদক। সেই সঙ্গে চলছে অর্থ পাচার।
সম্প্রতি গর্জনিয়ায় মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে আসা সিগারেট পাচারকারী চক্রের সদস্যদের সঙ্গে ডাকাতদলের সদস্যদের গোলাগুলিতে আবুল কাশেম নামের একজন নিহত হওয়ার পর ওই এলাকায় এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে চোরাচালান চক্র নিয়ে।
এই চক্র মূলত সিগারেট, ভাড়ায় অস্ত্র আনা-নেওয়া, সোনার বার ও গরু চোরাচালান করে থাকে। আর এই কাজে প্রধান সহযোগীর ভূমিকা পালন করে আসছে সীমান্তে বসবাসকারী কতিপয় জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক নেতারা।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি দল এবং বিরোধী দলের কতিপয় এইসব রাজনৈতিক নেতারা উৎকোচের বিনিময়ে চোরাচালান সিন্ডিকেটকে মদত দিচ্ছে।
গত রবিবার রাতে গর্জনিয়া সীমান্তে বিজিবির সঙ্গে গোলাগুলিতে নেজাম নামের এক ডাকাত ও চোরাকারবারি নিহত হওয়ার নেপথ্যে ছিল সিগারেট পাচারকে কেন্দ্র করে। বিজিবির দাবি, ডাকাত দলের সদস্য নেজাম বিজিবির টহল দলের উপর গুলি ছুড়ে। পরে আত্মরক্ষার্থে বিজিবি পালটা গুলি ছুঁড়লে নেজাম ডাকাত নিহত হয়। এরআগে চোরাকারবারির টাকা ভাগাভাগির দ্বন্দ্বে একাধিক সংঘর্ষ যেন গর্জনিয়া সীমান্ত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গর্জনিয়া সীমান্তের বিভিন্ন গ্রামে একাধিক চোরাচালান চক্র রয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী কতিপয় যুবক এই চোরাচালান সিন্ডিকেট পরিচালনা করে থাকে। দুই উপজেলার অন্তত ৯টি গ্রাম একেবারেই সীমান্ত ঘেঁষা হওয়ায় সেখান দিয়ে সিগারেট, অস্ত্র, বিস্ফোরক ও গরু পাচার করা হয়। গ্রামগুলোর মধ্যে রয়েছে, নাইক্ষ্যংছড়ির ফুলতলি, ভালুক্কায়া, বাইশারী, তুমব্রু, বাইশফাঁড়ি, আশারতলী, জামছড়ি, বম্বনিয়া এবং রামু উপজেলার হাজিরপাড়া ও মৌলভীরকাটা।
এর মধ্যে হাজিরপাড়া ও মৌলভীকাটা দিয়ে মিয়ানমারের সিগারেট ও অন্ত্র পাচার হয়ে থাকে। স্থানীয় প্রভাবশালী একাধিক ব্যক্তি সীমান্তের এই এলাকাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। তারা হলেন, কচ্ছপিয়ার ৭ নং ওয়ার্ডের হাজিরপাড়া গ্রামের মোহাম্মদের ছেলে মো এরশাদ উল্লাহ, মোস্তাক আহম্মদের ছেলে আনোয়ার হোসেন রাসেল, একই ইউনিয়নের দৌছড়ি দক্ষিণকুল গ্রামের মোজাফফর আহম্মদের ছেলে ফরিদুল আলম। মূলত এদের নেতৃত্বে দৈনিক কোটি কোটি টাকার মিয়ানমার থেকে সিগারেট আসছে বলে জানান স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা জানান, কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের তিতারপাড়া গ্রামের মৃত নুরুল ইসলাম সিকদারের ছেলে নাছির উদ্দিন সোহেল ওরফে সোহেল সিকদার, শাকিল মেম্বার, দক্ষিণ মৌলভীকাটার মোহাম্মদ ইলিয়াসের ছেলে ইয়াছিন আরাফাত রিসাদ, ফাক্রিকাটা এলাকার মোক্তার আহাম্মদের ছেলে নুরু, দক্ষিণ দৌছড়ী এলাকার মোচা আলীর ছেলে আব্দুর রহিম, হাজী পাড়ার মালেকু জামানের ছেলে নুরুল আলম ও একই গ্রামের মোরশেদের ছেলে আবু তালেব। এই ৭ জন চোরাকারবারি আলাদাভাবে অন্য একটি সিন্ডিকেট পরিচালনা করে।
জানা গেছে, মিয়ানমার সীমান্তবর্তী গর্জনিয়া ও কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের একাধিক গ্রামের কয়েকটি সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্র প্রকাশ্যে এসব পাচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যাদের মাধ্যমে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার মিয়ানমারের সিগারেট ঢুকছে বাংলাদেশে আর বাংলাদেশি পণ্য পাচার হচ্ছে মিয়ানমারে। এসব চোরাকারবার রাতে ও দিনে চলছে প্রতিনিয়ত। এককথায় চোরা কারবারিদের স্বর্গরাজ্য এখন গর্জনিয়া সীমান্ত।
তবে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে চোরাচালানের গরু জব্দ করলেও এরশাদ উল্লাহদের মত চোরাকারবারির মাস্টারমাইন্ড রয়েছে নাগালের বাইরে। প্রতি রাতেই কোটি কোটি টাকার সিগারেট চোরাই পথে মিয়ানমার থেকে আসছে। এসব সিগারেট রাতে এমনকি দিনের বেলায় প্রকাশ্যে পাচার করা হয় দেশের বিভিন্ন জায়গায়। বিশেষ করে সন্ধ্যার পরে রামু-গর্জনিয়া রাস্তা দিয়ে চোরাচালানের কাজে ব্যবহৃত শত শত গাড়ি চলাচল করায় গুরুত্বপূর্ণ এ রাস্তায় সব ধরনের যানবাহন ও জনচলাচল অসম্ভব হয়ে পড়ে।
সূত্র জানায়, চোরাচালানের মাধ্যমে আসা সিগারেটের মূল্য হুন্ডির মাধ্যমে চলে যায় মিয়ানমারের ব্যবসায়ীদের হাতে। তাদের মাধ্যমেই দুই দেশের চোরাকারবারিরা লেনদেন করে থাকে।
চোরাকারবারি চক্রের সাথে জড়িত একটি সূত্র বলছে, আটক বা জব্দ যা হয়, তা কেবল ‘আই ওয়াশ’। এক চালান জব্দ হলে, হাজার চালান ওই ফাঁকে ঢুকানো হয় দেশের অভ্যন্তর হয়ে বিভিন্ন ঠিকানায়। কারণ আটক, জব্দ না হলে, চোরাকারবারিরা সংশ্লিষ্টদের গুরুত্ব বুঝবে না, সে কারণে হেটম দেখাতে এমন ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, চোরাকারবারিদের ঠেকানো যাবে না, কারণ এ পথে তারাই সৃষ্টি করেছে যারা এ পথ রুখবে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে সিগারেট চোরাচালান চক্রের প্রধান অভিযুক্ত এরশাদ উল্লাহ বলেন, আমি দৈনিক ৪/৫ টি গরু এনে বিক্রি করি; একথা সত্য। তবে সিগারেট কারবারে আমি কোনোভাবেই জড়িত নয়। তবে সোহেল সিকদার ও শাকিল মেম্বার চোরাচালানে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
এ বিষয়ে রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু তাহের দেওয়ান বলেন, আমরা চোরাচালান প্রতিরোধে প্রতিদিন মাঠে তৎপর রয়েছি। গত কয়েকদিন আগে আমাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে চোরাকারবারিরা চোরাচালানে বেপরোয়া হয়ে উঠলে আমরা তা কঠোর হস্তে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছি।
পাঠকের মতামত