জসিম মাহমুদ, টেকনাফ ::
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সেনাবাহিনী ও নাডালা বাহিনী জ্বালাও পোড়াওসহ বিভিন্ন ধরনের নিযার্তন ও হত্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রাণে বাঁচতে স্ত্রী ও দুই জমজ সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বুধবার রাতে দেশ ছাড়েন রোহিঙ্গা নাগরিক মমতাজ উল্লাহ। নাফনদী পাড়ি দিয়ে আসার সময় কোস্টগার্ডের বাধার মুখে পড়ে মিয়ানমার জলসীমানা নাইক্ষ্যংদিয়া নামক এলাকায় কয়েক ঘন্টা অবস্থানকালে নৌকায় ১৫শিশু, ১৫ নারী ও ৯জন পুরুষসহ ৩৯জন রোহিঙ্গা নাগরিক ও একজন বাংলাদেশি নৌকার মাঝি ছিলেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে কোস্টগার্ডের টহল দলটি অবস্থান পরিবর্তন করলে আমাদের বহনকারী নৌকাটি পুনরায় যাত্রা শুরু করেন। সাগরে প্রবল ঢেউয়ের কবলে পড়ে শাহপরীর দ্বীপ মাঝেরপাড়া উপকূলের কাছাকাছি এসে সকাল সাড়ে আটটার দিকে নৌকাটি উল্টে ডুবে যায় বলে জানালেন মমতাজ উল্লাহ।
তিনি বলেন, সাঁতরে স্ত্রীসহ তিনি কূলে উঠতে পারলেও জমজ দুই ছেলে নিখোঁজ ছিলেন। মো. হাসান, মো. হোসেন ও স্ত্রী নছিমা খাতুনসহ চারজনের ছোট পরিবারটিকে নিয়ে যে উদ্দ্যেশ্যে জন্মভুমি ছেড়েছেন তা সফল হয়নি। নৌকায় থাকায় সকলের বাড়ি মিয়ানমারের খোয়াই সং গ্রামে। পেশায় তিনি একজন জেলে।
মমতাজ বলেন, নাফ নদী পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করার কিছুক্ষণ পরই প্রবল ঢেউয়ের কবলে পড়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকাটি ডুবে যায়। এরপর মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে তিনি ও স্ত্রী সাঁতরে উঠতে পারলেও জমজ দুই ছেলে নিখোঁজ ছিল। পরে বেলা ১১টার দিকে শাহপরীর দ্বীপ মাঝেরপাড়া সৈকতের পৃথক দুটি এলাকা থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০১০ সালের আগস্ট মাসের শেষের দিকে নছিমা খাতুনের সঙ্গে বিয়ে হয়। এরপর ছয় বছর ধরে কোন সন্তান হচ্ছিল না। অনেক চেষ্টার পর ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে এক সঙ্গে জোড়া দুটি ছেলে সন্তান জন্ম দেন স্ত্রী নছিমা খাতুন। তাদের দুজনের নাম রাখা হয়েছিল হযরত আলীর দুই ছেলের নামে হাসান ও হোসেন। তারা যেমন ফেরাউনের সঙ্গে যুদ্ধে করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন তারা তেমনি রাখাইনের সঙ্গে নাগরিকত্ব দাবী করায় আমাদের হত্যা করছে সেদেশে সেনা ও রাখাইনরা। কিন্তু তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব জন্য শহীদ হলেন। ছয়টি বছর অপেক্ষা করার পর এ দুই সন্তানকে পেলেও পালিয়ে আসলেও শেষ রক্ষা হয়নি।
মমতাজ উল্লাহ মতোই একই এলাকার আরেক রোহিঙ্গা নাগরিক গতকাল দুপুরের দিকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ মাঝেরপাড়া সাগর উপকূলে সৈকতে দুই বছরের মেয়ে খালেদা ও স্ত্রী আরেফা বেগমকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন।
এ সময় রহিম উল্লাহের সঙ্গে দেখা হয়। তিনি বলেন, নৌকা ডুবিতে স্ত্রী আরেফা বেগম ও মেয়ে খালেদাকে এভাবে হারাতে হবে জানলে দেশে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে শহীদ হতাম। আমি এখন স্ত্রী ও মেয়েকে হারিয়ে একা হয়ে পড়েছি।
তিনি বলেন, কিছুদিন আগে হঠাৎ করে গ্রামের লোকজনকে গণনা ও ছবি তোলার কথা বলে গ্রামবাসীকে জড়ো করেন ওগাটা (এলাকার আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকা রোহিঙ্গা মুসলিম চেয়ারম্যান)। ওই সময় তিনি মাছ ধরতে সাগরে থাকায় সেদিন তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। সেনা সদস্যরা গ্রামে এসে ৫৩জন পুরুষকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর ১৫-২০লাখ টাকা করে মিয়ানমারের মুদ্রা নিয়ে ১১জনকে ছেড়ে দিলেও আমার বাবা খলিলুর রহমান, ছোট ভাই আব্দুর রহমান ও কেফায়েত উল্লাহসহ বাকিদের আটকে রাখে। টাকা দিয়ে ফেরত আসা লোকজন বলেছেন, তাদের গুলি করে হত্যার পর খড় দিয়ে আগুনে পুঁড়িয়ে দিয়েছে। তখন থেকে আর কোন খবরাখবর পায়নি বাবা ও দুই ভাইয়ের। এতোদিনেও তারা ফেরত না আসায় মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে দিন কাটছিল তাঁর। গ্রামের লোকজন যখন নৌকায় করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন তখন আমরাও ওই নৌকায় উঠি। নৌকাডুবির পর থেকে মেয়ে ও স্ত্রীর এখনও নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের লাশ দুটি এখনও পায়নি।
পাঠকের মতামত