
সাগর-রুনি কি দেশদ্রোহী ছিল? নাকি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য পাচার করেছে? তাহলে সেটা আমাদের বলুন। প্রকৃত ঘটনাটি জানান। তারা দোষী হলে আর খুনের বিচার চাইব না। বছরের পর বছর আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি। আর তদন্তের নামে যেন ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলছে।’ সাংবাদিক সাগর সরোয়ারের মা সালেহা মনিরের বুকে জমা কষ্টগুলো এভাবেই ক্ষোভ হয়ে ঝরে পড়ে। বছরের পর বছর এমন চিত্র দেখে হতাশ মেহেরুন রুনির ভাই নওশের আলম রোমান বলেন, ‘বিচার চেয়েই যেন ভুল করেছি। আমাদের নিয়ে তামাশা হচ্ছে।’ স্বজনদের সঙ্গে হতাশ নিহত সাংবাদিক দম্পতির সহকর্মীরাও।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের আট বছর পূর্ণ হলো। তবে এতদিনেও চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। কারা, কেন তাদের হত্যা করে, সে প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা। এর মধ্যে ৭১ বার পিছিয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ। সর্বশেষ গতকাল সোমবার আবারও নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে ২৩ মার্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান সমকালকে বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন জমার তারিখ পেছানোর এই সংখ্যাটি আঁতকে ওঠার মতো। নিঃসন্দেহে এটি আমাদের ও ভুক্তভোগী পরিবারের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। চাঞ্চল্যকর যে কোনো মামলা গুরুত্ব ও দ্রুততার সঙ্গে দেখা উচিত। এ ঘটনায় হয়তো এমন শক্তিশালী কোনো পক্ষ জড়িত, যারা প্রভাব বিস্তার করছে পুরো বিষয়টির ওপর। প্রকৃত অর্থে কোনোদিন এ মামলার রহস্য উদ্ঘাটন হবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। তবে ন্যায়বিচার, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও সংবিধানের স্বার্থে এ হত্যাকাণ্ডের সুবিচার নিশ্চিত করা উচিত।’
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ফ্ল্যাট থেকে সাগর-রুনির ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সাগর ছিলেন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক। আর রুনি ছিলেন এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক। নৃশংস ওই হত্যাকাে র সময় বাসায় ছিল সাংবাদিক দম্পতির একমাত্র সন্তান মিহির সরোয়ার মেঘ। ওই সময় তার বয়স ছিল সাড়ে চার বছর।
সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, আট বছরে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা, তদন্ত সংস্থা ও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখই শুধু বারবার বদলেছে। তবে তদন্তে কোনো অগ্রগতি হয়নি। হত্যায় ব্যবহূত ছুরি, বঁটি, ছুরির বাঁট, সাগর-রুনির পরনের কাপড় ও সাগরের হাত-পা বাঁধা কাপড় ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছিল। হত্যায় সন্দেহভাজন কয়েক ব্যক্তির ডিএনএ নমুনাও বিদেশি ল্যাবে পাঠানো হয়। এসব পরীক্ষার প্রতিবেদন তদন্ত সংস্থার হাতে এসেছে। তবে তা দিয়ে আসামি শনাক্তের জন্য কার্যকর ক্লু মেলেনি। আরও নানা উপায়ে তদন্ত এগিয়ে নেওয়ার কথা শোনা গেলেও আজও চিহ্নিত হয়নি খুনি। কেন খুন হন তারা, সে রহস্যও ভেদ করা যায়নি। থানা পুলিশ ও ডিবির ব্যর্থতার পর এখন মামলাটি তদন্ত করছে র্যাব। তারাও কোনো সুখবর শোনাতে পারেনি। আদালতে জমা দেওয়া প্রতিটি প্রতিবেদনে শুধু ‘গুরুত্বসহ তদন্ত চলছে’ বলেই উল্লেখ করা হচ্ছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার শফিকুল আলম সমকালকে বলেন, তদন্তে বলার মতো কোনো অগ্রগতি হয়নি। এর আগে পাওয়া ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন হালনাগাদের জন্য আবারও বিদেশে পাঠানো হয়েছে। সেই প্রতিবেদন এখনও আসেনি।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে।’ এর দু’দিন পর তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার জানান, ‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি’ হয়েছে। তবে আট বছরেও সেই অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়নি। শেষ হয়নি সেই ‘৪৮ ঘণ্টা’!
জোড়া খুনের মামলাটির বাদী রুনির ভাই নওশের আলম রোমান সমকালকে বলেন, ‘আসলে কোনো তদন্তই হচ্ছে না। গত দুই-তিন বছরে কোনো অগ্রগতি হয়নি। ইদানীং আর কিছু বলেও না তদন্ত সংস্থা। আমরা হতাশ।’
সাগরের মা সালেহা মনির সমকালকে বলেন, ‘সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এতদিনে তদন্ত শেষ হতো। চাঞ্চল্যকর আরও অনেক মামলার বিচার হয়েছে না? তাহলে এ মামলার ক্ষেত্রে রহস্যটা কী? র্যাব বারবার সময় নিচ্ছে। তারা না পারলে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বা অন্য কোনো সংস্থাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হোক।’
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার ঘটনায় মামলা হয় রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায়। চার দিনের মাথায় তদন্তের দায়িত্ব পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। ৬২ দিন পর সংস্থাটি তদন্তে ব্যর্থতা স্বীকার করলে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল মামলাটি র্যাবে স্থানান্তর করা হয়। ওই বছরের ২৬ এপ্রিল পুনঃময়নাতদন্তের জন্য কবর থেকে দু’জনের লাশ তোলা হয়। তখন ভিসেরা আলামতসহ আরও কিছু নমুনা সংগ্রহ করা হয়। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই র্যাব বনানী থানার একটি হত্যা ও ডাকাতি মামলায় গ্রেপ্তার মিন্টু, বকুল মিয়া, কামরুল হাসান অরুণ, রফিকুল ইসলাম ও আবু সাঈদকে গ্রেপ্তার দেখায় এ মামলায়। এ ছাড়া ওই মামলায় বিভিন্ন সময় রুনির কথিত বন্ধু তানভীর রহমান, বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও দারোয়ান এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবিরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এরপর গত ১১ নভেম্বর হাইকোর্ট র্যাবের তদন্ত কর্মকর্তাকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তদন্ত শেষ হবে কবে? তদন্ত কি অনন্তকাল ধরে চলবে?’ তখন তদন্ত কর্মকর্তা জানান, এ মামলায় এখনও কোনো ক্লু খুঁজে পাওয়া যায়নি। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো চারটি নমুনার মধ্যে দুটির প্রতিবেদন এসেছে। এর সঙ্গে আসামিদের কারও মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। অন্য দুটি নমুনা পরীক্ষার জন্য এফবিআইতে পাঠানো হয়েছে। এ মামলায় সাতজন তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে বলেও তিনি জানান।
এরপর গত ১৪ নভেম্বর এক আদেশে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল না হওয়া পর্যন্ত নিম্ন আদালতে হাজিরা থেকে সন্দেহভাজন আসামি তানভীর রহমানকে অব্যাহতি দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তাকে ৪ মার্চ বা তার আগে তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা এবং অপরাধের সঙ্গে তানভীরের সম্পৃক্ততার বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন আদালত।
পাঠকের মতামত