
চলতি বছরের জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিয়ে রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় ধনী দেশগুলোর প্রতিশ্রæত অর্থ দেয়া, তৃণমূলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক, এসডিজি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে জোরালো আওয়াজ তুলেছে বাংলাদেশ।
এটি নতুন কিছু নয়, ভারতে হয়ে যাওয়া জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনেরই ‘ফলোআপ’ বলে মনে করছে বাংলাদেশ।
বহু ইস্যুতে নজর কাড়লেও কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ খুব একটা লাভবান হয়নি। প্রত্যাবাসনে চীন ও ভারতের সায় থাকলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একদম নেই। সব মিলিয়ে প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তি মিলিয়েই কেটেছে বাংলাদেশের জাতিসংঘ অধিবেশন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিশ্বে ‘পূর্ব-পশ্চিম মেরুকরণ’ এবং ‘উত্তর-দক্ষিণ বিভাজন’ স্পষ্ট থাকলেও চলতি বছরের জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দিয়ে বিশ্ব নেতাদের কাছ থেকে বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় মনোযোগ কেড়েছে বলে জানা গেছে। তবে এও ঠিক, জাতিসংঘ অধিবেশন থেকে মূলত কোনো প্রাপ্তিযোগ থাকে না। বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি কেড়ে নিয়ে নিজেদের বক্তব্য দেয়াটাই মূল কথা।
প্রসঙ্গত, গত ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের জাতিসংঘ অধিবেশন শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল শুরুর দিন থেকেই জাতিসংঘে যোগ দিয়েছে।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী ওয়াশিংটন যাওয়ার আগে একাধিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ও জাতিসংঘ অধিবেশনের সাইডলাইন বৈঠক করেন। একইসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনও একাধিক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকের ফল সুদূরপ্রসারী।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, জাতিসংঘ অধিবেশনে আমরা সব ইস্যু তুলে ধরেছি। বড় বড় দেশগুলোর প্রতিনিধিরা এসব ইস্যু শুনেছেন। মন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে উন্নত দেশগুলোকে তাদের ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রæতি পূরণের আহ্বান জানান। জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়াও, বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানি সংকট, রোহিঙ্গা সংকট, সন্ত্রাসবাদ এবং অন্যান্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে বাংলাদেশ কথা বলেছে।
এসবের বিনিময়ে প্রাপ্তি কি- এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, আগে তো বাংলাদেশ কথাই বলত না, আর বললেও বড়বড় দেশগুলো শুনত না। এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। জাতিসংঘে বলার আগে আমরা জি-২০তে বলে এসেছি। অবশ্যই বাংলাদেশ মুনাফা পাবে।
এদিকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসন বিষয়ে বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাংলাদেশ বলেছে, মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে আসার ছয় বছর পূর্ণ হয়েছে। সম্পূর্ণ মানবিক কারণে আমরা অস্থায়ীভাবে তাদের আশ্রয় দিয়েছি।
বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় এবং সেখানে তারা শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে আগ্রহী। আসুন আমরা এই নিঃস্ব মানুষকে তাদের নিজের দেশে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করি। কিন্তু মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করে প্রত্যাবাসনে নিরুৎসাহিত করেন।
এমনকি বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের কাজ দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এজন্য রোহিঙ্গাদের জন্য আরো ১১৬ বিলিয়ন ডলার অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সৌদি আরবও রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্য করেছে। তবে তারা জাতিসংঘের অধীনে ইউএনডিপি ও ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে অর্থ সাহায্য পাঠিয়েছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাবাসনে না করেছে। এর বিপরীতে তারা অর্থ সাহায্য বাড়িয়েছে। চীন ও ভারতের সায় থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের বাধার কারণে প্রত্যাবাসন কতদূর হবে বোঝতে পারছি না। তবুও আমরা চেষ্টা করে যাব।
এদিকে বাংলাদেশকে নিয়ে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে বাংলাদেশের সাফল্য ও অর্জন তুলে ধরতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
নিউইয়র্কে কুইনসে ‘সেন্টার ফর নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশি’ আয়োজিত ‘জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা এবং অনিবাসী বাংলাদেশিদের মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন সারাবিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বৃদ্ধিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশিদের আরো বেশি সম্পৃক্ত হতে হবে।
ড. মোমেন বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ও অভিন্ন মূল্যবোধের ক্ষেত্র আরো শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিদ্যমান সুসম্পর্ক আরো গভীর করতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশিদের আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে।
ড. মোমেন বলেন, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি নিপীড়ন, অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি সারাবিশ্বের কাছে সাহস, আত্মমর্যাদা ও আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
তিনি স্বাধীনতার পর দুর্ভিক্ষ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত বাংলাদেশ থেকে আজকের বাংলাদেশে রূপান্তরের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে বলেন, সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশকে পশ্চিমা বিশ্বের নেতারা তখন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু বর্তমান বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, একটি উদীয়মান অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। দারিদ্র্য হ্রাসসহ আর্থসামাজিক বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সালে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ৩ দশমিক ২ শতাংশ; আর বর্তমানে আমাদের জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
ড. মোমেন বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কথা উল্লেখ করে বলেন, শেখ হাসিনার কারণেই বাংলাদেশ আর্থসামাজিক বিভিন্ন সূচকে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে।
ড. মোমেন বলেন, ২০০১ থেকে ২০০৬ সময়কালে বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে বাংলাদেশকে উগ্রবাদ, জিহাদি এবং সন্ত্রাসের দেশে পরিণত করা হয়েছিল। সুখবর হলো সেই দিন এখন শেষ হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যার পর, সামরিক শাসন, কুখ্যাত ইনডেমনিটি আইন প্রণয়ন করে খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। তখন খুনিদের বিচার না করে বিদেশে বাংলাদেশ মিশনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করে পুরস্কৃত করা হয়।
ড. মোমেন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের ভূমিকা তুলে ধরে শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি বাংলাদেশের প্রতিশ্রæতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, এক কোটি ২০ লাখের বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি রেমিট্যান্স প্রেরণসহ বিভিন্নভাবে বাংলাদেশের উন্নয়নে অবদান রেখে যাচ্ছেন।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান, সেন্টার ফর এনআরবি এর চেয়ারপারসন এম এস শেকিল চৌধুরী, ইউ এস এম্বাসেডর অব পিস, ইউ এন অ্যান্ড এক্সপার্ট ডব্লিউএইচও ড. সিমা কারেতনয়া, নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল নাজমুল হুদা উপস্থিত ছিলেন। সুত্র: ভোরেরকাগজ
পাঠকের মতামত