
বাংলাদেশ সফরে এসে গণতন্ত্র, সংস্কার ও রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিক আন্তনিও গুতেরেস। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন-পরবর্তী ভূরাজনীতির গতিপ্রকৃতি যেমন নানা দিকে মোড় নিচ্ছে; সেখানে জাতিসংঘ মহাসচিবের এ সফরকে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রেও সফরটিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও কূটনীতি বিশ্লেষকরা।
জাতিসংঘ মহাসচিবের এই সফরকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও কূটনীতি বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতার মাত্রা কমিয়ে দিতে শুরু করেছে। আমরা দেখছি, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ইতোমধ্যে বৈদেশিক নানা সংস্থায় তাদের সহযোগিতা কার্যক্রম এবং অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছেন। এর ফলে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। সচরাচর যে ধরনের ত্রাণ দরকার তা পর্যাপ্ত আকারে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই আন্তনিও গুতেরেসের এই সফরের তাৎপর্য রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তার এ সফরের মাধ্যমে এখানে রোহিঙ্গারা কতখানি সংকটে রয়েছে, তাদের বাস্তব অব্স্থা কেমন তা যেমন পর্যবেক্ষণ করেছেন, তেমনি রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থা কী তা-ও যাচাই করতে পেরেছেন।’
আমরাও আমাদের সমস্যাগুলো তার কাছে সমাধানকল্পে উপস্থাপন করতে পেরেছি কি না তা সামনেই জানা যাবে বলে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘জাতিসংঘকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের হোমওয়ার্ক আমরা করে দিতে পেরেছি কি না তা হয়তো কদিন পর স্পষ্ট হবে। আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি, মার্কিন প্রশাসন নানা ক্ষেত্রে ছাঁটাই শুরু করেছে। এখন আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংস্থার প্রধান হিসেবে গুতেরেসের হয়তো এত ক্ষমতা নেই। কিন্তু তিনি অন্তত আমাদের থেকে একটি স্পষ্ট ধারণা নিয়ে যেতে পারবেন। যার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ সহজ হবে।’
বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পটপরিবর্তনের পর রোহিঙ্গা সংকট থেকে নজর সরে গিয়েছিল মন্তব্য করে রাজনীতি-বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হেল কাফী বলেন, ‘আন্তনিও গুতেরেসের এ সফরের পর আবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর রোহিঙ্গা সংকটের দিকে ফিরবে।’
তিনি বলেন, ‘ধারণা করি গুতেরেসের সফর রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত সমাধানের পথ সুগম করবে। যাতে তারা নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে মিয়ানমারে ফিরতে পারে।’ এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিবেরও দায়িত্ব রয়েছে বলে মন্তব্য করে ড. কাফী আরও বলেন, ‘আমরা তার প্রতি আহ্বান জানাব যেন তিনি নিজে এবং তার দপ্তর রোহিঙ্গাদের জন্য ক্রমশ কমে আসা মানবিক সহায়তা বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। একেবারে যেহেতু সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সফরটি হয়েছে, সেক্ষেত্রে অন্যান্য যারা আছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে শুরু করে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র, অন্যান্য যে দেশগুলো রয়েছেÑ জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্র, শরণার্থীদের বিষয়ে যাদের সহানুভূতি রয়েছে, সেখানে প্রভাব তৈরিতে তার এ সফর ভূমিকা রাখবে।’
রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী। তাদের উদ্বাস্তু হওয়া ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘গুতেরেসের এ সফরের মধ্য দিয়েই সমাধান আসবেÑ এমনটি নিশ্চিত করা যায় না। তবে এ সফরের মধ্য দিয়ে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে প্রত্যাশা তৈরি হলো, তাতে মিয়ানমারের ওপর অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক চাপ তৈরির সুযোগ তৈরি হবে। যার মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথ সুগম হবে।’
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকট এখন সারা বিশ্বের জন্যই একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মন্তব্য করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদুল আলম বলেন, ‘আন্তনিও গুতেরেস নিজেও একজন উদ্বাস্তু বিশেষজ্ঞ। তাই জাতিসংঘ মহাসচিবের সফর এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে তার অবস্থানকে বিচার করলে দেখব মহাসচিবের ব্যক্তিগত আগ্রহের জায়গা রয়েছে। তা ছাড়া তিনি জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক সংস্থারও সচিব ছিলেন। তবে এক্ষেত্রে জাতিসংঘ মহাসচিবের নিজেরও আগ্রহের একটি জায়গা রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আর এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানে এসেছেন। এক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার উদ্যোগকেও প্রশংসা করতে হয়। তিনি আন্তনিও গুতেরেসকে নিয়ে কক্সবাজার সফর ও সেখানকার লক্ষাধিক মানুষকে নিয়ে ইফতার করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ বছর সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গাদের নিয়ে একটি সম্মেলন আয়োজনের কথা আছে। তার আগে এমন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নতুন মাত্রা যোগ করবে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতার ক্ষেত্রে কিছুটা স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। এমনটি যেন না হয় সেজন্য কিছু উদ্যোগ নেওয়ার আছে।’
উল্লেখ্য, চার দিনের সফরে গত বৃহস্পতিবার বিকালে ঢাকা পৌঁছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস। এরপর শুক্রবার তিনি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাথে ‘সলিডারিটি ইফতার’ করেন। পরদিন শনিবার ঢাকার গুলশানে জাতিসংঘের নতুন ভবন উদ্বোধনসহ নানা কর্মসূচিতে যোগ দেন। দুপুরে রাজনৈতিক দল ও ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপ শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন। চার দিনের বাংলাদেশ সফরে জাতিসংঘ মহাসচিবের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল রোহিঙ্গাদের প্রতি তার সমর্থন ও সহমর্মিতা জানানো। তাই সফরের শেষ সংবাদ সম্মেলনে গুতেরেস রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিভিন্ন প্রশ্নের খোলামেলা জবাবও দিয়েছেন। গত শুক্রবার রোহিঙ্গাদের সাথে ইফতার অনুষ্ঠানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান।’ সুত্র: প্রবা
পাঠকের মতামত