প্রকাশিত: ২১/১০/২০১৭ ৯:০১ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ১১:৫৭ এএম

উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
রোহিঙ্গা সংকটে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ধর্ষণ। রাখাইনের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কোনো নারী বা বালিকা ধর্ষণ থেকে নিরাপদ নয়। এই ভয়াবহ সংকটে আক্রান্ত রোহিঙ্গারা ও তাদের নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা এমন কথা বলেছেন। জাপান টাইমসে প্রকাশিত থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন%ডেশনের এক প্রতিবেদনে এমন কথা বলা হয়েছে।
খবরে বলা হয়, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গার চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা। জাতিসংঘের ওইসব চিকিৎসাকর্মীরা জানিয়েছেন, পালিয়ে আসা নারী রোহিঙ্গাদের অনেকেই শিকার হয়েছেন ভয়াবহ যৌন হামলার।
পাশাপাশি থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে দেয়া কিছু সাক্ষাৎকারেও একই কথা জানিয়েছেন রোহিঙ্গা নারীরা। মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস %0 যৌন হামলা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ স্কাই হুইলার বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা নিধন অভিযানে পরিষ্কারভাবে ধর্ষণকে একটি ভয়াবহ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, ধর্ষণ ও অন্যান্য ধরনের যৌন হামলা ব্যাপক আকারে ও পদ্ধতিগতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি নৃশংস, লজ্জাকর ও মানসিকভাবে ক্ষতিকর। জাতিসংঘের দেয়া তথ্য অনুসারে, ২৫শে আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত আনুমানিক ৫ লাখ ৮০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। সেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস অত্যাচার চালাচ্ছে সেনাবাহিনী। জাতিসংঘ তাদের এসব কর্মকাণ্ডকে জাতি নিধন বলে আখ্যায়িত করেছে। এমনকি রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারকে গণহত্যার শামিল কিনা তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। তবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী জাতি নিধনের কথা অস্বীকার করেছে। তাদের ভাষ্যমতে, তারা রাখাইনে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। যারা ২৫শে আগস্ট রাতে সেনাবাহিনী ও পুলিশ ক্যাম্পে হামলা চালিয়েছিল। কিন্তু পালিয়ে আসা রাখাইনবাসীদের ভাষ্য মতে ঘটনা ভিন্ন। তারা বলছে, রাখাইনে সেনাবাহিনীর জন্য ধর্ষণ হচ্ছে একটি প্রাত্যহিক ব্যবহৃত অস্ত্র।
আমার তখন আর কিছুই করার ছিল না
এদিকে, বিভিন্ন সংস্থার ভাষ্য যাই থাকুক না কেন, ১৮ বছর বয়সী নুরশিদা ভালোভাবেই জানে তার সঙ্গে কি ঘটেছে। থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নুরশিদা বলেছে, তার পুরো ক্লাসকে (৩০ জন) গত মাসে বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ইউনিফর্ম পরিহিত সেনারা তাদের মুখের সামনে বন্দুক ধরে রেখে স্কুলের অডিটরিয়ামে তাদের ওপর চালায় পাশবিকতা। শিক্ষার্থীদের সবাইকে আতঙ্কিত অবস্থায় এক কোণায় জড়ো করা হয়। তারপর এক এক করে সবার ওপর চালানো হয় ভয়াবহ নির্যাতন। এমনকি এক এক সময় এক শিক্ষার্থীর ওপর পাশবিকতা চালিয়েছে কয়েকজন সেনা মিলে। নুরশিদার গায়ের রঙ ফর্সা। হয়তো এ কারণে সবার আগে তাকে দিয়েই দলবদ্ধ পাশবিক নির্যাতন শুরু করা হয়। পরিষ্কারভাবে শেভ করা, হাতে বন্দুক ও চাপাতি ধরা ছয় সেনা তাকে টেনে নেয়। চালায় অমানবিক অত্যাচার। নুরশিদা বলে, ‘ওদের একজন আমাকে শক্ত করে ফ্লোরে ধরে রাখে। আমি চিৎকার করা শুরু করি। কিন্তু এক সেকেন্ড পরেই এক সেনা তার হাত দিয়ে আমার মুখে আঘাত করে। আমার কাপড় খুলে নেয়। তারা যখন আমার ওপর পাশবিকতা চালায় আমি তখন চুপ ছিলাম। আমার তখন আর কিছুই করার ছিল না।’ এরপর তার দুই বান্ধবীকে ফ্লোরে চেপে ধরা হয়। তাদের সঙ্গেও চালানো হয় একই পাশবিক নির্যাতন। একদিকে তাদেরকে ধর্ষণ করা হচ্ছিল। অন্যদিকে একই সময়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল তাদের নাইসাপ্রু গ্রাম। পুড়তে থাকা বাড়িগুলো থেকে উপরে উঠতে থাকা ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল স্কুল থেকে। নুরশিদা বলে, ‘স্কুলের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। স্কুলজুড়ে তাদের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল।’ বর্তমানে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে নুরশিদা। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে তার বলা ঘটনার সঙ্গে আরো কয়েকজনের বলা ঘটনার মিল রয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন ল্যাফটেন্যান্ট কর্নেল রাশেদ হাসান বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত ধর্ষণের যেসব বর্ণনা শুনেছি তাতে মনে হচ্ছে, ধর্ষণকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।’ প্রায় সকল বয়সের নারী, শিশু, কিশোরী সবাই কম-বেশী যৌন হামলার শিকার হয়েছে। তাদের পরিবারকে হত্যা করা হয়েছে, কেউ সন্তান হারা হয়েছেন, কাউকে বাড়ি থকে জোর বের করে দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের সাবা জারিভ বলেন, ‘ধর্ষণ হচ্ছে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করার একটি কাজ। এটি বয়স, লিঙ্গ বা জাতিগতভাবে কোনো বাছবিচার করে না।’ জান্নাত নামের এক শরণার্থী জানান, তাকে মিয়ানমারে তার নিজ বাড়িতে ৯ মাসের গর্ভবতী থাকাকালীন ধর্ষণ করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমাদের গ্রামে হামলা চালানোর পাঁচদিন আগেই আমার স্বামীকে হত্যা করে সেনারা। এরপর থেকে আমি আমার তিন সন্তানকে আজ অবধি দেখিনি।’ পাঁচদিন আগে তিনি ফাতিমার জন্ম দেন এক ধানক্ষেতের ভেতরে। বর্তমানে ফাতিমাই তার পরিবারের একমাত্র জীবিত সদস্য। তিনি বলেন, ‘তারা দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। তারা দেখতে পেয়েছিল যে আমি গর্ভবতী। কিন্তু তারপরও তারা আমায় ধর্ষণ করে। আর তাদের পাশবিকতা শেষে আমায় কাপড়বিহীন, নির্যাতিত, সন্তানবিহীন অবস্থায় ফেলে চলে যায়।’ জান্নাত বলেন, ‘আমি আমার সন্তানদের জন্য চিৎকার করে কেঁদেছি। কিন্তু এখনো জানি না তারা কোথায় আছে। আমি সব হারিয়ে ফেলেছি। আমি আর মিয়ানমারে ফেরত যেতে চাই না।’
মিয়ানমারে এত অত্যাচার সহ্য করে নিরাপত্তার খোঁজে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে তারা। তবে নিরাপত্তা মরীচিকার মতো। এখানে এসেও দুঃস্বপ্নের শেষ নেই অনেকের জন্যে। ২০ বছর বয়সী পারভীনকে ত্যাগ করেছে তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন। কারণ, তার স্বামীকে শিরশ্ছেদ করে হত্যা করে তাকে গণধর্ষণ করেছে সেনারা। তাকে ধর্ষণ করার সময় সে ৫ মাসের গর্ভবতী ছিল। পারভীন জানান, তার জন্য তার শাশুড়ি সর্বশেষ যে কাজটি করেছিল তা হচ্ছে, ধর্ষিত হবার পর তাকে পরিষ্কার হতে সাহায্য করা। তিনি বলেন, ‘সেনারা আমাকে মেরে অজ্ঞান করে ফেলে চলে যায়। আমি আমার জনশূন্য গ্রামে চোখ খুলি। আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন আমাকে খুঁজছিল। আমি আমার ঘরের মেঝেতে কাপড়বিহীন অবস্থায় পড়ে ছিলাম। আমার শাশুড়ি আমায় পরিষ্কার হতে সাহায্য করে। এরপর তারা আমায় বলে যে তারা আর আমার দায়িত্ব নিতে চায় না।’ এখন পারভীনের বসবাস কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরের এক বাঁশের কুটিরে। তিনি বলেন, ‘আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছে। আমার আর কখনো বিয়ে হবে না। আমার এখন একা একা নিজের সন্তানকে বড় করে তোলা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। এখন আমার বেঁচে থাকার একমাত্র প্রেরণা এটি। আমি বাকি সব হারিয়ে ফেলেছি।’ সুত্র: মানবজমিন

পাঠকের মতামত

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এশিয়ার নেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান ড. ইউনূসের

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এশিয়ার নেতাদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ...

প্রকাশ্যে নামাজ পড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী গ্রেফতার

ভারতের উত্তর প্রদেশে মীরুটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা জায়গায় নামাজ আদায়ের অভিযোগে এক শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার ...

বাংলাদেশ হয়ে রাখাইন রাজ্যে সহায়তা পাঠাতে চায় জাতিসংঘ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সেখানে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি বাংলাদেশকে ...