প্রকাশিত: ১৫/০২/২০২০ ৯:০৫ পিএম

আহমদ গিয়াস :
এক কেজি কয়লা থেকে ৮ ইউনিট, আর এক কেজি ইউরেনিয়াম থেকে উৎপাদন করা যায় ২ কোটি ৪০ লক্ষ ইউনিট বিদ্যুৎ। বর্তমানে কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে ১২শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এবং পাবনার রূপপুরে ২৪শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন আরেকটি পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ চলছে। আমদানীকৃত কাঁচামাল নির্ভর এ দুটো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত দেশের দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও মহেশখালী কিংবা কুতুবদিয়া দ্বীপে গড়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন পরমাণু বিজ্ঞানীরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ২৯ মে এক সভায় দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ কোন দ্বীপে দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। বর্তমানে পাবনার রূপপুরে ২৫৪ একর জমির উপর দেশের প্রথম ও একমাত্র পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ১২শ মেগাওয়াট করে মোট ২৪শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ২টি ইউনিট রয়েছে। এগুলো ২০২৩ ও ২০২৪ সালে উৎপাদনে যাবে। অন্যদিকে মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে ১৪১৪ একর জমির উপর ১২শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। যেটি উৎপাদনে যাবে ২০২৬ সাল নাগাদ। আর এ উভয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহৃত হবে আমদানীকৃত কাঁচামাল। কিন্তু সম্পূর্ণ দেশীয় কাঁচামালের উপর ভিত্তি করে মহেশখালী কিংবা কুতুবদিয়া দ্বীপে দেশের দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি গড়ে ওঠে পারে বলে মনে করছেন পরমাণু বিজ্ঞানীরা।
দেশের প্রবীণ পরমাণু বিজ্ঞানী, পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক পরিচালক ড. মীর কাশিম বলেন, ১৯৬৮ সালে বাংলাদেশের ৫৫০ কিঃমিঃ দীর্ঘ উপকূলীয় অঞ্চলে ভারি খনিজ বালি অনুসন্ধানে চালানো ভূ-তাত্ত্বিক জরিপে ১৭টি স্তুপের মধ্যে ৮টি মূল্যবান খনিজ পদার্থ পাওয়া যায়। কক্সবাজার সৈকত ছাড়াও ইনানী, শাহপরীরদ্বীপ, মহেশখালী, কুতুবদিয়া ও কুয়াকাটা দ্বীপে এসব বালির স্তুপ রয়েছে।
গত ৯ জানুয়ারি বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল সায়েন্সডাইরেক্ট ডটকম-এ (গ্রাউন্ড ওয়াটার ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট এর মুখপত্র) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে কক্সবাজারের ভূ-গর্ভস্থ মাটিতে থাকা জিরকন ও মোনাজাইটে উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম থাকার তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। আর এ তেজস্ক্রিয় পদার্থটি ভূ-গর্ভস্থ পানীয় জলের সাথে মিশে ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরী করছে। ময়মনসিংহের ত্রিশালস্থ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের প্রফেসর, বিশিষ্ট ভূ-রসায়নবিদ ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকীর নেতৃত্বাথীন গবেষক দলে জাপান ও সুইডেনের বিজ্ঞানীরাও ছিলেন।
পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক ভূ-তত্ত্ববিদ ড. আশরাফ আলী সিদ্দিকী বলেন- সম্প্রতি কক্সবাজার সৈকতের ভূ-গর্ভস্থ মাটি ও পানি পরীক্ষা করে সেখানে পরমাণু চুল্লীর জ্বালানী বা ইউরেনিয়ামের উচ্চমাত্রায় অস্তিত্ব পাওয়া যায়। সৈকতের খনিজ বালিতে থাকা মোনাজাইটে প্রায় ১৬% পর্যন্ত রয়েছে ইউরেনিয়াম। কক্সবাজারের মতোই একই ভূ-বৈশিষ্ট মহেশখালী-কুতুবদিয়া ও কুয়াকাটায়। এটি ইঙ্গিত করছে, মহেশখালী-কুতুবদিয়ার বালিয়াড়িগুলোতে রয়েছে সেই মূল্যবান খনিজ। আর খনিজগুলো ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে পারলেই দেশীয় কাঁচামাল নির্ভর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে ওঠতে পারে।
গত কয়েক বছর আগে কক্সবাজারের ভূ-গর্ভস্থ পানীয় জলের নমুনা পরীক্ষা করে ১০ পিপিএম মাত্রার ইউরেনিয়াম এর অস্তিত্ব পান বিজ্ঞানী ড. আশরাফ। যা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বা হু নির্ধারিত সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৫ গুণ বেশি। হু নির্ধারিত সহনীয় মাত্রা হল ২ পিপিএম ( পার্টস পার মিলিয়ন বা ১০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ)। আর এ ফলাফলের পরই কক্সবাজারের মাটিতে উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম থাকার সম্ভাবনা থেকে তিনি সম্প্রতি ওই জরীপ চালান বলে জানান।
গবেষক ড. আশরাফ সিদ্দিকী জানান, তার গবেষণায় মোনাজাইটের মধ্যে অত্যন্ত উচ্চ মাত্রার (১৬%) ইউরেনিয়ামের অস্তিত্ব ধরা পড়ে।
ইউরেনিয়াম একটি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি ভারী ধাতু, যা ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ঘনীভূত শক্তির প্রাচুর্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। পৃথিবীর ভূ-ত্বকে টিন, টাংস্টেন এবং মলিবডেনমের মতোই সাধারণ একটি খনিজ ইউরেনিয়াম। সাধারণত: ২ থেকে ৪ ঘনত্বের পাথরেই ইউরেনিয়াম দেখা যায়। ইউরেনিয়াম সমুদ্রের পানিতে জন্ম নেয় এবং সেখান থেকেও আহরণ করা যায়। তবে ভূ-পৃষ্ঠের নীচে বা পানিতে; যেখানেই ইউরেনিয়াম থাকুক না কেন সেখান থেকে তেজস্ত্রিয়তা বের হয়। এতে উপাদানটি চিহ্নিত করা সহজ বলে জানান বিজ্ঞানীরা।
কক্সবাজার সৈকতের বালিতে মূল্যবান ভারী খনিজ পদার্থ থাকার কথা প্রথম জানা যায় ১৯৬১ সালে অষ্টেলিয় বিজ্ঞানীদের গবেষণায়। পরে ১৯৬৮ সালে দেশের ৫৫০ কিলোমিটার উপকূলজুড়ে চালানো ভূ-তাত্ত্বিক জরীপেও অষ্টেলিয় বিজ্ঞানীদের সহযোগিতা নেয়া হয়। জরীপে পাওয়া এসব বালির স্তুপে মোনাজাইট এর মজুদ ধরা হয় ১৭ হাজার ৩৫২ মেট্রিক টন। আর মোনাজাইটে গড়ে ১০% হারে ইউরেনিয়াম ধরা হলেও এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১ হাজার ৭৩৫ মেট্রিক টন। তবে মহেশখালী কিংবা কুতুবদিয়ায় এর বর্তমান মজুদ সম্পর্কে নিশ্চিত নন পরমাণু শক্তি কমিশনের কক্সবাজারস্থ খনিজ বালি আহরণ কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা।
এ কেন্দ্রের পরিচালক ও ভূ-রসায়নবিদ ড. মোহাম্মদ রাজীব বলেন, নানা কারণে অর্ধশতাব্দি আগের পাওয়া মজুদে হেরফের হয়েছে। ১৭টি বালির স্তুপের অধিকাংশই এখন বসতবাড়ি, হোটেলসহ নানা স্থাপনার নীচে চাপা পড়েছে।
তবে পরমাণু শক্তি কমিশনের সাবেক পরিচালক ও মরহুম পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সহপাঠী ড. মীর কাশিম মনে করেন এখনও যেটুকু সম্পদ অবশিষ্ট আছে তা যেন দেশের কল্যাণে কাজে লাগানো হয়। আর তাহলেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন, ওয়াজেদ মিয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে। সুত্র : দৈনিক কক্সবাজার

পাঠকের মতামত

কক্সবাজার সৈকতে ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিলো আমেরিকান সেনা ও বিমানবাহিনী

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে আমেরিকান সেনা ও বিমানবাহিনী। ১৮ মে থেকে ...

কক্সবাজারে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণের অনুমোদনে জেলাবাসীর আনন্দ-উচ্ছ্বাস

কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণের চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় ক্রয় কমিটি। এই খবরে ...