
বিশেষ প্রতিবেদক :: পর্যটন নগরীতে প্রস্তাবিত কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নানা সমস্যায় জর্জরিত। এখনও টার্মিনাল ভবন তৈরিসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজই বাকি।
অবকাঠামোগত এসব নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।
জানা গেছে, টার্মিনালের কাজ শেষ হতে আরও ৯ মাস লাগতে পারে। বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিমানবন্দর এলাকায় বসবাসরত ৩৩শ পরিবার।
নানা উদ্যোগ নিয়েও তাদের উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। এমনকী ৪ দশমিক ৬৪ একর জমি অধিগ্রহণ করাও আটকে আছে।
অন্যদিকে অবকাঠামো নির্মাণসহ অন্যান্য কাজের জন্য অতিরিক্ত খরচের প্রায় একশ কোটি টাকা বারবার তাগাদা দিয়েও সরকারের কাছ থেকে পাচ্ছে না বেবিচক কর্তৃপক্ষ।
আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ইন্টারন্যাশনাল সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটির (আইকাও) কাছ থেকে এখনও মেলেনি অনুমোদন।
এত সমস্যার মধ্যেও আগামী জুলাই থেকে এই বিমানবন্দর দিয়ে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু করার তোড়জোড় চলছে।
কিন্তু এ সময়কালের মধ্যে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করা যাবে কি না এ নিয়ে যারপরনাই সংশয়ে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তবে হাল ছাড়েননি বেবিচক চেয়ারম্যান।
এ জন্য গত ২১ এপ্রিল বেবিচক চেয়ারম্যান ফ্লাইট পরিচালনার বিষয়ে দায়িত্বশীলদের নিয়ে বিশেষ বৈঠক করেন।
এরই অংশ হিসেবে বিমানবন্দরটির সর্বশেষ পরিস্থিতি দেখতে সরকারের সব সংস্থার প্রতিনিধি সোমবার কক্সবাজারে যাচ্ছেন।
একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এ প্রসঙ্গে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, কক্সবাজার বিমানন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে গড়ে তোলার জোর চেষ্টা চলছে। আমরা আশা করি, দ্রুততম সময়ে এ বিমানবন্দর দিয়ে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারব।
জানা গেছে, সমুদ্রের নীলাভ জলরাশি ভেদ করে কক্সবাজারে অবতরণ করবে বিশালাকৃতির সব উড়োজাহাজ। বিমানবন্দরটি রিজিওনাল হাব হিসেবে গড়ে তোলাই মূল উদ্দেশ্য বেবিচকের।
প্রথমবারের মতো সমুদ্রের ভেতরে ব্লক করে রানওয়ে তৈরি করা হচ্ছে। লম্বা সময় ধরে কাজ হলেও পদে পদে আসছে বাধা। এসব বাধা উজিয়ে আগে বাড়তে পারছে না প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। এ জন্য তারাও ত্যক্ত-বিরক্ত। এরপরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বেবিচক কর্তৃপক্ষ।
সম্প্রতি বেবিচক কর্তৃপক্ষ সরকারের উচ্চপর্যায়ের কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে কক্সবাজার বিমানবন্দর দিয়ে গড়ে ২৫-৩০টি যাত্রীবাহী এবং ৬-১০টি পণ্যবাহী বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ করছে।
যাত্রীদের চাপ বেড়ে যাওয়ায় বিমানবন্দরটি রিজিওনাল হাব হিসেবে গড়ে তুলতে দিবা-রাত্রি পূর্ণ বোঝাই বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ নিশ্চিতকরণে ‘কক্সবাজার বিমানবন্দর রানওয়ে সম্প্রসারণ’ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে নানা বাধা আসছে।
বিমানবন্দরের আশপাশে বসতভিটা থাকায় সমস্যা তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া জমি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিমানবন্দরের অনুকূলে বন্দোবস্তকৃত ভূমি হতে পুরনো ঝিনুক মার্কেটে ১৪টি দোকান ও বস্তিসহ ৪২ পরিবার অপসারণ করা যাচ্ছে না।
বিমানবন্দরের অনুকূলে ঝিনুক মার্কেট এলাকায় অবশিষ্ট ০.০৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা যাচ্ছে না। বিমানবন্দরের ৪.৫৬ একর জমিতে অবস্থিত গণপূর্ত এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের স্থাপনা অপসারণ না হওয়ায় জমিটি অধিগ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিমানবন্দরের অপারেশনাল এলাকার অভ্যন্তরে সরকারের অন্য একটি সংস্থা কর্তৃক দাবিকৃত ৬.৫৭ একর জমির মধ্যে ৪.৬৪ একর ভূমিতে প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়নের বাধা প্রদান করায় ফায়ার স্টেশন ভবন, ড্রেনেজ, পেরিফেরিয়াল রোড, সিকিউরিটি বাউন্ডারি ওয়াল ইত্যাদি নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
সমুদ্রগর্ভে রানওয়ের কাজ ৯৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাঁধের কাজ শেষ হয়েছে ৯৪ শতাংশ। সমুদ্রগর্ভে ২২শ ফুট দীর্ঘ প্রিসিশন অ্যাপ্রোচ লাইট স্থাপনসহ মেইনটেন্যান্স স্ট্রিল ব্রিজ নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে ৮৩ শতাংশ।
রানওয়ের চারপাশে নিরাপত্তা সীমানা প্রাচীর ও নিরাপত্তা টহল রাস্তা নির্মাণ ২৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। আর রানওয়ের চারপাশে ড্রেনেজ সিস্টেম নির্মাণ করা হয়েছে ৫৫ শতাংশ।
বেবিচকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ যাত্রী চলাচল বৃদ্ধি পাবে। কার্গো ও যাত্রী বিমানের ফ্লাইট বেড়ে যাবে। বৈদেশিক বিনিয়োগের পাশাপাশি পর্যটন খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বৃদ্ধি পাবে।
বেবিচক সূত্র জানায়, প্রায় দশ বছর আগে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু স্থানীয় বসতভিটা উচ্ছেদ সংক্রান্ত জটিলতায় এটি দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এ অবস্থার মধ্যেও দ্বিতীয় পর্যায়ের অত্যাধুনিক রানওয়ে সম্প্রসারণের প্রকল্প নেওয়া হয়।
আঞ্চলিক হাব গড়ে তোলার পাাশাপাশি সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আকাশপথে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা থেকেই এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। সরকারের হাইকমান্ডের নির্দেশনা পেয়ে বেবিচক কক্সবাজার বিমানবন্দর রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়।
বিমানবন্দরের বর্তমান ৯ হাজার ফুট দীর্ঘ রানওয়েকে মহেশখালী চ্যানেলের দিকে আরও এক হাজার ৭০০ ফিট সম্প্রসারিত করে ১০ হাজার ৭০০ ফিটে উন্নতি করা হয়। সম্প্রসারিত হতে যাওয়া ১৭শ ফিট রানওয়ের ১৩শ ফিটই থাকবে সাগরের পানির মধ্যে। দেশে এই প্রথমবারের মতো সমুদ্রের ভেতরে ব্লক তৈরি করে রানওয়ে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।
বেবিচকের এক কর্মকর্তা জানান, কক্সবাজার সমুদ্রতীর ঘেঁষে অত্যাধুনিক এজিএল সিস্টেম তৈরি করা হবে। এতে করে রাতের অন্ধকারে উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণের সময় দেখা দেবে অনন্য এক নৈসর্গিক দৃশ্য। মনোমুগ্ধকর নির্মাণশৈলীতে সাজানো হয়েছে গোটা এয়ারপোর্টের নকশা।
এয়ার ফিল্ড লাইটিং সিস্টেম. সমুদ্রের জলাবদ্ধতা রক্ষা, সমুদ্র পুনরুদ্বার, নমনীয় ফুটপাত, সমুদ্রের যথাযথ পদ্ধতিতে আলোক ব্যবস্থার মতো দৃষ্টিনন্দন বস্তুর সমাহার থাকছে এখানে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটের পর কক্সবাজার হবে চতুর্থ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে ১০ হাজার ৫শ ফিট। কক্সবাজারের কাজ শেষ হলে ঢাকা হয়ে যাবে ২য় বৃহত্তম রানওয়ে। সমুদ্রে যতটুকু রানওয়ে যাবে সেখানে পানিতে ব্লক, জিওটিউবসহ অন্যান্যা সামগ্রী ব্যবহার করে বাঁধ তৈরি করা হচ্ছে।
বেবিচকের প্রকৌশলী বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ বোয়িং-৭৭৭-৩০০ ইআর, ৭৪৭-৪০০ ও এয়ারবাসের ৩৮০-এর মতো উড়োজাহাজ সহজেই ওঠা-নামা করতে পারবে। প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে এক হাজার ৭৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এর পুরোটাই অর্থায়ন করছে বেবিচক।
পাঠকের মতামত