

কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে জমে উঠেছে রাজনৈতিক মাঠ। এই আসনটিকে দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এবার এখানে হাইভোল্টেজ নির্বাচনী লড়াইয়ের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। চারবারের সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের সাবেক হুইফ শাহজাহান চৌধুরী পুনরায় বিএনপি থেকে মনোনয়ন পাচ্ছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
তার বিপরীতে মাঠে নামছেন জামায়াতে ইসলামী কক্সবাজার জেলার আমির ও হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী। এলাকাজুড়ে দুই প্রার্থীর জনপ্রিয়তা, সাংগঠনিক প্রস্তুতি এবং রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। বিশেষ করে জামায়াতের প্রার্থীর উত্থান এবং বিএনপির ঘাঁটিতে নিজ দলের বাইরে অন্য জোটসঙ্গীর প্রার্থী হওয়া ঘিরে বিএনপির ভিতরেও নানা মতামত তৈরি হয়েছে।
শাহজাহান চৌধুরী: ক্লীন ইমেজের অভিজ্ঞ রাজনীতিকঃ-
শাহজাহান চৌধুরী কেবল একজন সাবেক সংসদ সদস্যই নন, তিনি ছিলেন জাতীয় সংসদের হুইফ হিসেবেও দায়িত্বশীল পদে আসীন। স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে শুরু করে শিক্ষার মানোন্নয়নে তার অবদান রয়েছে বলেও দাবি করছেন স্থানীয় বিএনপি নেতারা। উখিয়া কলেজ, বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। উখিয়া উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব সোলতান মাহমুদ চৌধুরী বলেন, শাহজাহান চৌধুরী হলেন একজন পরীক্ষিত নেতা, তার ক্লীন ইমেজ এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। তিনি উখিয়া-টেকনাফের অপরিহার্য নেতৃত্ব। উখিয়া-টেকনাফে শাহজাহান চৌধুরীর বিকল্প নেই। তিনি চার বারের সংসদ সদস্য। জামায়াতের যিনি প্রার্থী হচ্ছেন তিনি একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাত্র। তার মতো অসংখ্য চেয়ারম্যান শাহজাহান চৌধুরী তৈরি করেছেন।
এটি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন নয়। জাতীয় সংসদের নির্বাচন। তাই এই নির্বাচনে অবশ্যই তরুণ প্রজন্ম অভিজ্ঞ লোককে বেছে নেবেন। আগামীতে যিনি প্রধানমন্ত্রী হবেন সেই তারেক রহমানও শাহজাহান চৌধুরীকে সম্মান করেন। সুতরাং একজন যোগ্য ও অভিজ্ঞ প্রার্থীকে জনগণ মূল্যায়ন করবেন।
জামায়াতের চ্যালেঞ্জ: নুর আহমদ আনোয়ারীর আগমনঃ–
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীর কক্সবাজার জেলা আমির ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে পরিচিতি পাওয়া নুর আহমদ আনোয়ারী জামায়াতের তরফ থেকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছেন আগেভাগেই। ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের অভিজ্ঞতা থাকলেও জাতীয় পর্যায়ে তার সরাসরি সম্পৃক্ততা নেই বললেই চলে। তবে স্থানীয় জামায়াত নেতাদের বিশ্বাস, জনগণ সৎ মানুষকে সংসদে দেখতে চায়, সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই আনোয়ারী জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। উখিয়া উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি সোলতান আহমদ বলেন, নিঃসন্দেহে নুর আহমদ আনোয়ারী একজন সৎ ও যোগ্য লোক। আমরা আল্লাহর আইন সৎ লোকের শাসন চাই।
আওয়ামী লীগ: হ-য-ব-র-ল অবস্থার ইঙ্গিতঃ-
এই আসনে একসময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থী দিয়েও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতো। যিনি বিতর্কিত কর্মকান্ড দিয়ে বিভিন্ন সময় হয়েছেন গণমাধ্যমের শীর্ষ সংবাদ। অবৈধ সম্পদ অর্জনের দুদকের মামলায় আব্দুর রহমান বদিকে তিন বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। এক সময় উখিয়া-টেকনাফের রাজনীতি, অর্থনীতি, বৈধ-অবৈধ ব্যবসা সবই তখন ছিল আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ আব্দুর রহমান বদির একক নিয়ন্ত্রণে। টেকনাফে-উখিয়ায় তার কথাই শেষ কথা। তার হুমকি-ধমকি আর মারধরের কারণে সরকারি কর্মকর্তারাও তার বাইরে কোন কথা বলতেন না। অভিযোগ রয়েছে, দেশের নিসর্গ সুন্দর সীমান্ত জনপদ উখিয়া-টেকনাফের চোরাচালান, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, অনিয়ম, দখল, ক্ষমতার দাপটের নজিরবিহীন সব কান্ড বদির জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। তার এবং তার পরিবারের কারণেই টেকনাফ এখনও মাদকের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন। তবে দলীয় সূত্র ও স্থানীয়দের বক্তব্যে উঠে এসেছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং জনভিত্তির সংকট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, দলের দুর্নীতি আর অমানবিক কার্যকলাপে সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে মাঠে আসতেও ভয় পাচ্ছে। তাদের সংগঠন কার্যত ভেঙে পড়েছে।নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত থাকায় তাদের ভবিষ্যৎ পথচলা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
রোহিঙ্গা ও মাদকের চ্যালেঞ্জ: কে হবেন কার্যকর?
উখিয়া-টেকনাফ আসনটি রোহিঙ্গা সমস্যা এবং মাদক চোরাচালানের কারণে জাতীয়ভাবে সংবেদনশীল এলাকা হিসেবে বিবেচিত। প্রায় ১২-১৩ লাখ রোহিঙ্গা এই অঞ্চলে বসবাস করছে। সীমান্ত ঘেঁষা এই এলাকার প্রধান সংকটগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাদক নিয়ন্ত্রণ। স্থানীয়রা মনে করছেন, এসব জটিল সমস্যা মোকাবেলায় প্রয়োজন একজন নির্লোভ, অভিজ্ঞ এবং গ্রহণযোগ্য নেতা। সেই জায়গায় শাহজাহান চৌধুরী এগিয়ে রয়েছেন বলে অনেকে মনে করছেন।
বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক: কৌশলী অবস্থানঃ-
যদিও বিএনপি ও জামায়াত পূর্বে একসঙ্গে রাজনৈতিক জোটে ছিল, তবে বর্তমানে নির্বাচনী বাস্তবতায় উভয় দল কৌশলগত দূরত্ব বজায় রাখছে। কেউ কারো বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও মাঠ পর্যায়ে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা স্পষ্ট। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই দ্বৈত লড়াই শেষ পর্যন্ত ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তৈরি করতে পারে, যা নির্বাচনের ফলকে জটিল করে তুলতে পারে। উখিয়া-টেকনাফের রাজনৈতিক লড়াই শুধু দুটি দলের মধ্যে নয়, এটি হচ্ছে অভিজ্ঞতা বনাম নতুন মুখের লড়াই, পরিচিত বনাম সম্ভাবনার লড়াই। আগামী জাতীয় নির্বাচনে এই আসনে যে নাটকীয়তা দেখা দিতে পারে তা নিয়ে এখন থেকেই স্থানীয় এবং জাতীয় রাজনীতিতে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। দেখার বিষয়, অভিজ্ঞ ও ক্লীন ইমেজের শাহজাহান চৌধুরী কি পুনরায় জয় ছিনিয়ে আনতে পারবেন, নাকি জামায়াতের নতুন মুখ আনোয়ারী এই আসনে চমক দেখাবেন?
পাঠকের মতামত