
কালেরকন্ঠ::
দেশে ২০১৬ সালে ইয়াবায় আসক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। আরেক মাদকদ্রব্য হেরোইনের বিস্তার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছুটা কমলেও গত বছর তা ইয়াবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে হেরোইনে আসক্ত রোগীর সংখ্যাও। গত বছর হেরোইনে আসক্ত রোগীই ছিল বেশি, ৩৬.২৬ শতাংশ। রাজশাহী এলাকায় বেশি বিস্তার হেরোইনের। গত বছর ইয়াবায় আসক্ত রোগীর হার ছিল ৩১.৬১ শতাংশ। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে পাওয়া তথ্য মতে, ওই বছর সারা দেশে যে পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে তার ৭৩ শতাংশই পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। বাড়ছে সহজলভ্য মাদকদ্রব্য গাঁজার প্রচলনও। অন্যদিকে গত বছর ফেনসিডিলের আসক্তি ও বিস্তার দুটিই কমেছে। শিরায় মাদকসেবীর সংখ্যা কমলেও বেড়েছে ওই ধরনের মাদকদ্রব্য উদ্ধারের পরিমাণ।
রোগীদের ওপর চালানো জরিপের ভিত্তিতে প্রতিবেদেনে বলা হয়েছে, মাদকাসক্তির সবচেয়ে বড় কারণ বন্ধুদের প্ররোচনা। গত বছর মাদকাসক্ত ৬৪.৪৪ শতাংশ রোগী বলেছে, তারা বন্ধুর মাধ্যমে মাদকাসক্ত হয়। এর আগের ছয় বছরের জরিপেও বন্ধুদের প্ররোচনায় মাদকাসক্তির হার বেশি দেখা যায়। মাদকাসক্ত ২০.৯০ শতাংশ রোগীর বয়স ২৬ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে।
ডিএনসির অতিরিক্ত পরিচালক এবং বার্ষিক প্রতিবেদন সম্পাদনা বোর্ডের সদস্য হাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বিভিন্ন সংস্থার জব্দ করা মাদকদ্রব্যের পরিমাণ, মামলার সংখ্যা, এলাকাভিত্তিক ধরনের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হওয়া রোগীদের ওপর জরিপ চালিয়ে বের করা হয় প্রবণতার হার। মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে প্রবেশের কারণে ইয়াবার কারবার সবচেয়ে বেশি চলছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের ভারত সীমান্ত দিয়ে হেরোইন ও ফেনসিডিল বেশি আসছে। কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলা দিয়ে আসছে গাঁজা।
ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার মাদকের আগ্রাসন ঠেকাতে সেসব এলাকায় বিশেষভাবে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানান ডিএনসির ওই কর্মকর্তা।
ডিএনসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম মহানগর এলাকা থেকে বেশি পরিমাণে ইয়াবা উদ্ধার হওয়ায় মামলার সংখ্যা কম, ১৭.৯ শতাংশ। ২৫.৭৩ শতাংশ ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ঢাকায়, মামলার হার ২৭.৪ শতাংশ। এ ছাড়া খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেটে ইয়াবা উদ্ধারের হার ২ শতাংশেরও কম।
বন্ধুই ভয়ংকর : প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের ৬৪.৪৪ শতাংশ রোগী প্রথম মাদক গ্রহণের অভিজ্ঞতা পায় বন্ধুদের প্ররোচনায়। কৌতূহলের বশে আসক্ত হয় ৩২.৮৪ শতাংশ। এ ছাড়া সহজলভ্যতা, শারীরিক সমস্যা, পারিবারিক সমস্যা, বিষণ্নতাসহ অন্যান্য কারণে গড়ে ১ শতাংশেরও কম রোগী আসক্ত হয়েছিল। ২০১৫ সালে বন্ধুদের মাধ্যমে আসক্ত হয় ৮৪.৯৩ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৬৮.১৫ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৬০.৬৪ শতাংশ, ২০১২ সালে ৬১.৪৭ শতাংশ এবং ২০১১ সালে ৫৫.২৯ শতাংশ।
বিপজ্জনক তারুণ্য : ডিএনসির জরিপে দেখা গেছে, গত বছর মাদকাসক্ত ২০.৯০ শতাংশ রোগীর বয়স ছিল ২৬ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। ২০.৬৫ শতাংশ রোগীর বয়স ছিল ১৬ থেকে ২০ বছরের মধ্যে। গত বছরের হিসাবে ১৮.৯৭ শতাংশের বয়স ছিল ২১ থেকে ২৫ বছর, ১৬.৩০ শতাংশের বয়স ছিল ৩১ থেকে ৩৫, ১১.৪৮ শতাংশের বয়স ছিল ৩৬ থেকে ৪০ বছর। ১৫ বছরের মধ্যে বয়স ছিল ২.৫৮ শতাংশ রোগীর। ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ছিল বাকি ৭ শতাংশের বয়স। ২০১৫ সালের হিসাবে দেখা গেছে, ২৮.৩০ শতাংশ রোগী ছিল ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী। ১৯.৪২ শতাংশ রোগীর বয়স ছিল ২১ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে।
রাজশাহীতে বাড়ছে হেরোইন : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাদকের ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলে’ অবস্থানের কারণে বাংলাদেশে হেরোইন আসছে। হেরোইনের মামলা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ভারত সীমান্তবর্তী রাজশাহী অঞ্চলে, ৫৭.৪ শতাংশ। ৭৩.২১ শতাংশ হেরোইন উদ্ধার করা হয়েছে সেখানে। ২৯.৬১ শতাংশ মামলা হয়েছে ঢাকায়, উদ্ধারের হার ১৫.৮৯ শতাংশ। খুলনায় উদ্ধার হয়েছে ৯.৬১ শতাংশ হেরোইন, মামলা ১১.৪১ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি হেরোইন পাওয়া গেছে রাজশাহী, চাঁইপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়া, কুষ্টিয়া, খুলনা, পাবনা, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ এলাকায়।
প্রতিবেদন মতে, আগের বছরগুলোতে হেরোইনের আগ্রাসন কমলেও ২০১৬ সালে আবার বেড়েছে। গত বছর হেরোইন আসক্ত রোগীর হার ছিল ৩৬.২৬ শতাংশ। ২০১৫ সালে এ হার ছিল ২০.১৮ শতাংশ, ২০১৪ সালে ২৪.২ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৩০.৭০ শতাংশ, ২০১২ সালে ৪৬.১৭ শতাংশ এবং ২০১১ সালে ৪২.৭৩ শতাংশ।
ডিএনসির রাজশাহী অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মজিবুর রহমান পাটোয়ারী কালের কণ্ঠকে বলেন, এ অঞ্চলে ভারতের সীমান্ত দিয়ে হেরোইন, ফেনসিডিলসহ মাদকদ্রব্য আসে। আগের চেয়ে এখন পরিমাণ কমেছে। এখন নিয়মিত অভিযান চালানোর কারণেই ধরা পরছে।
বেড়েছে বুপ্রেনরফিন উদ্ধার : প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর বুপ্রেনরফিন ইনজেকশন বা শিরায় প্রয়োগযোগ্য মাদকদ্রব্য উদ্ধার হয়েছে এক লাখ ৫২ হাজার ৭৪০টি। ২০১৫ সালে ৮৫ হাজার ৯৪৬, ২০১৪ সালে এক লাখ ৪৭ হাজার ৪৫৮, ২০১৩ সালে ৯৯ হাজার ৫০৯, ২০১২ সালে এক লাখ ৫৭ হাজার ৯৯৫ এবং ২০১১ সালে এক লাখ ১৮ হাজার ৮৯০টি উদ্ধার করা হয়েছিল। রোগীদের ওপর চালানো জরিপে দেখা গেছে, গত বছর ৫.১৭ শতাংশ ছিল শিরায় মাদকসেবী। এর হার ২০১৫ সালে ১১.৯৩ শতাংশ, ২০১৪ সালে ১১.৭৪ শতাংশ, ২০১৩ সালে ২০ শতাংশ, ২০১২ সালে ২৩.২২ শতাংশ এবং ২০১১ সালে ২৭.৫৬ শতাংশ ছিল। বুপ্রেনরফিন জব্দ ও মামলার দিক দিয়ে এগিয়ে ঢাকা। এখানে উদ্ধার হয় ৬৯.৮ শতাংশ বুপ্রেনরফিন, মামলার হার ৬৬.৬৭ শতাংশ। রাজশাহীতে উদ্ধার হয় ৩০.৬২ শতাংশ, মামলার হার ২৮.৭৯ শতাংশ।
বেড়েছে গাঁজাসংক্রান্ত মামলা : ডিএনসির প্রতিবেদন মতে, গত বছর মাদকদ্রব্যসংক্রান্ত যত মামলা হয়েছে তার ৪৯.৪৭ শতাংশই গাঁজা বা ভাংসংক্রান্ত। সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ঢাকায় ৩৬.৬৯ শতাংশ, উদ্ধারের হার ২৯.১৭ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি উদ্ধার চট্টগ্রাম জোনে ৩১.৯৯ শতাংশ, মামলা ১০.৭ শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, নাটোর, বগুড়া, পাবনা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, রংপুর, নওগাঁ, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা ও যশোরে গাঁজার ব্যবসা বেশি চলছে।
পাঠকের মতামত