সাঈদ মুহাম্মদ আনোয়ার, উখিয়া নিউজ ডটকম।
প্রকাশিত: ২৭/১২/২০২৩ ১০:০৩ এএম

দীর্ঘ ২ যুগ ধরে একটি কথা প্রচলিত হয়ে পড়েছে ভোটের রাজনীতিতে আবদুর রহমান বদি মানেই অজেয়! তিনি প্রার্থী হলে ওখানে আর কারও জেতার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে! কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনটিতে গেলবার নৌকার টিকেটে এমপি হয়েছেন আবদুর রহমান বদির সহধর্মিনী গৃহিণী শাহীন আক্তার। যিনি এমপি হওয়ার আগে কোনো ধরনের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্তই ছিল না। কিন্তু নৌকা প্রতীকের মনোনীত প্রার্থী শাহীন চৌধুরীর পক্ষে আবদুর রহমান বদির দৃঢ়চেতা মনোবল, বহুমাত্রিক পদচারণা ও রাজনৈতিক কারিশমার কারণে জেলা বিএনপির সভাপতি ও চার চার নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরীর মতো হেভিওয়েট প্রার্থীকে পরাজিত করে ঠিকই বিজয় চিনিয়ে নেন শাহিন আক্তার। এবারও নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন তিনিই। এবারও তাই সবাই ধরে নিয়েছেন হাজার বির্তক পরও জনপ্রিয়তায় অপ্রতিরোধ্য বদির প্রভাব ও পরিচিতি খাটিয়ে জয়ের মালা আবারও শাহীন আক্তারই পড়ে নেবেন। তবে সেক্ষেত্রে ভোটে জয়-পরাজয়ের নির্ধারণ হবে উখিয়া উপজেলা ভোটারদের ম্যান্ডেটের উপর।

স্থানীয় রাজনৈতিক বিজ্ঞজনদের তথ্য মতে, দীর্ঘ ৩ যুগেরও বেশি সময় ধরে উখিয়া-টেকনাফের ভোটের মাঠে বদি পরিবারের রাজত্ব চলছে। আবদুর রহমান বদির পিতা মরহুম এজাহার মিয়া কোম্পানি একাধিক বার টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়াও নির্বাচিত হয়ে ছিলেন টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানও। ভোটের রাজনীতিতে এজাহার মিয়া কোম্পানি কখনও পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করেননি।

এছাড়াও ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরীকে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অধ্যাপক মোহাম্মদ আলিকে ও ২০০১ সালে বিএনপি প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরীকে উখিয়া-টেকনাফ আসনের এমপি নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা ছিল এজাহার মিয়া কোম্পানির।

এজাহার মিয়া কোম্পানির বড় পুত্র আবদুর রহমান বদি সরাসরি ভোটের রাজনীতিতে আসার পর তিনি টেকনাফ পৌরসভার প্রথম প্রশাসক ও চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ২০০৮ ও ২০১৪ সালে নৌকা প্রতীক নিয়ে টানা ২বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বদি। তিনি তার চাচা মো: ইসলামকে টেকনাফ পৌর সভার মেয়র, তার ছোট ভাই মুজিব রহমানকে টেকনাফ পৌর কাউন্সিল, তার শ্যালক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীকে উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, তার সম্বন্ধি অধ্যাপক হুমায়ুন কবির চৌধুরীকে জেলা পরিষদের সদস্য ও তার চাচা শ্বশুর অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরীকে উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসাবে নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি।

দুদুক এর একটি মামলায় ৩ বছর সাজা হওয়ায় আইনি জটিলতায় পড়ে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচন অংশ নিতে পারেননি আবদুর রহমান বদি। কিন্তু থেমে থাকেনি আবদুর রহমান বদির রাজনৈতিক ম্যাজিক। রাজনীতির মাঠে অখ্যাত ও অপরিচিত এবং ১০০% গৃহিণী তার স্ত্রী শাহিন আক্তারকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন ও নৌকা প্রতীক পায়ে দিয়ে চমকে দেন সবাইকে। তখন নৌকা প্রতীকের মনোনীত প্রার্থী শাহীন চৌধুরীর পক্ষে আবদুর রহমান বদির দৃঢ়চেতা মনোবল, বহুমাত্রিক পদচারণা, রাজনৈতিক কারিশমা, কৌশল ও ম্যাজিকের কারণে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন শাহিন আক্তার। প্রথম বারের মতো উখিয়া-টেকনাফবাসী পান একজন নির্বাচিত নারী এমপি। তবে শাহীন আক্তার এমপি হিসেবে কোন চমক বা সফলতা দেখাতে পারেননি। বলতে গেলে পুরো ৫ বছরই তিনি এলাকায় অনুপস্থিত ছিলেন। ছিল না তার কোনো জনসম্পৃক্ততা। তার অনুপস্থিতে পুরো ৫ বছরই এলাকার সব কিছুই দেখভাল করে গেছেন শাহীন আক্তারের স্বামী সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি। এছাড়াও বদির পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়েছেন।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের ১১ জন হেভিওয়েট নেতা দলীয় মনোনয়ন চেয়ে ছিলেন। ২০১৮ সালের মতো এবারও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি দলীয় মনোনয়ন পাননি আইনি জটিলতার কারণে। তাই এবার সবার ধারণা ছিল নতুন কোনো প্রার্থীই পাবেন নৌকা প্রতীক। কিন্তু এবারও নতুন দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের বাধা হয়ে দাড়ালেন সেই আবদুর রহমান বদি। তার এক বিলকিতে বা ধাক্কায় কপোকাৎ হয়ে গেছেন দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী সকল নেতাই। ফলে এবারও নৌকার মাঝি হলেন আবদুর রহমান বদির স্ত্রী শাহিন আক্তার।

এদিকে খাকি মাঠেই গোল দেবেন শাহিন আক্তার ? বিষয়টা একেবারে তা না। এই আসনে এবার তার প্রতিদ্বন্ধিতায় নেমেছেন আরও ৬ প্রার্থী। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর শাহীন আক্তারসহ মনোনয়ন দৌড়ে টিকে আছেন ওই ৭ জন। এরা হলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. নুরুল বশর (ঈগল), আওয়ামী লীগের প্রার্থী বর্তমান সংসদ সদস্য শাহীন আক্তার (নৌকা), জাতীয় পার্টির নুরুল আমিন চৌধুরি ভুট্টো (লাঙল), ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) ফরিদুল আলম (আম), তৃণমূল বিএনপির মুজিবুল হক মুজিব (সোনালী আঁশ), ইসলামি ঐক্যজোটের মোহাম্মদ ওসমান গনি চৌধুরি (মিনার), বাংলাদেশ কংগ্রেসের মোহাম্মদ ইসমাইল (ডাব)।

তবে শাহীন আক্তার ছাড়া নির্বাচনের দৌড়ে থাকা ৬ জনের মধ্যে ৫ জনেরই তেমন কোন এলাকায় পরিচিতি নেই। বরং অখ্যাত রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন নিয়ে তারা মাঠে এসেছেন। মাঠে আসা এই নেতাদের মধ্যে ইসলামি ঐক্যজোটের প্রার্থী নিজেদের রাজনৈতিক পরিচিতির কারণে কিছুটা ভোটের ময়দানে থাকতে পারলেও অন্য কারো ভোটের মাঠে প্রভাব ফেলার মতো কোন সম্ভাবনা নেই। নতুন রাজনৈতিক দল, যাকে ‘কিংস পার্টি’ বলে পরিচয় পেয়েছে, সেই তৃণমূল বিএনপির মাঠে কোন নেতা-কর্মী কিংবা সাংগঠনিক ভিত্তি নেই বলে স্থানীয়রা মনে করছেন। এছাড়াও জাতীয় পার্টির নুরুল আমিন সিকদার ভুট্টোর একসময়ের কলেজ শিক্ষক হিসেবে কিছুটা পরিচিতি থাকলেও জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে তেমন কোনো প্রভাব নেই। এছাড়াও এনপিপির ফরিদ আলম বাংলাদেশ কংগ্রেসের মোহাম্মদ ইসমাইলের পরিচিতি তো না-ই, গুগলে সার্চ দিয়েও তাদের একটি ছবি খুঁজে পাওয়া যায় না। এই ৫ প্রার্থীর সব ভোট কেন্দ্রের এজেন্ট দেওয়াও সক্ষমতা নেই।

উচ্চ আদালতে রায় নিয়ে শেষ মুহূর্তে প্রার্থীতা ফিরে পাওয়া কক্সবাজার-০৪ ( উখিয়া টেকনাফ) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল বশর এর ঈগল পাখি নিস্তেজ নির্বাচনে কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস ( জাগ্রত করালেও) দিলেও, নৌকা প্রতীকের মনোনীত প্রার্থী শাহীন চৌধুরীর পক্ষে হাজার বির্তক থাকার পরও জনপ্রিয়তায় অপ্রতিরোধ্য আবদুর রহমান বদির কারণে তিনিও (নুরুল বশর) হালে পানি পাবে না স্থানীয় সচেতন মহলের ধারণা। তবে শেষ পর্যন্ত বিনা চ্যালেঞ্জে ফসল ঘরে তোলার সমীকরণ এতো সোজা হবে না বলে মনে করেন আবার অনেকেই। সুষ্ঠু নির্বাচনে উখিয়া উপজেলা থেকে যিনি বেশি ভোট পকেটস্থ করতে পারবেন, তিনিই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলে মনে করছেন তারা।

এই ৬ প্রার্থীদের প্রতিপক্ষ নিয়ে ভোটের মাঠে লড়ছেন ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত আবদুর রহমান বদির সহধর্মিনী ও বর্তমান সংসদ সদস্য শাহীন আক্তার। আবদুর রহমান বদি ও শাহিন আক্তার এর বিরোধীরা একাট্টা হওয়ায় নির্বাচনে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে শাহিন আক্তার (নৌকা) ও নুরুল বশর (ঈগল) এর মধ্যে। কারণ মো. নুরুল বশরের রাজনৈতিক পরিচিতি বেশ সমৃদ্ধ। তিনি টেকনাফ উপজেলা ছাত্র লীগের সভাপতি, টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দীর্ঘ দিন দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। তার ছোট ভাই উপজেলা যুব লীগের সভাপতি নুরুল আলম বর্তমানে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। তিনি ইতিপূর্বে টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাছাড়াও বদির পিতা এজাহার মিয়া ও নুরুল বশরের পিতা মো: শফি তারা ২ যুগ যুগ ধরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। এদিকে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগসহ মূল অঙ্গসংগঠন গুলো স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. নুরুল বশরের পক্ষে কাজ করছে।

স্থানীয় ভোটারদের মতে, নুরুল বশর ছাড়া যে সব প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্ধিতায় নেমেছেন তারা প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্ধিতায় শাহীন আক্তারের কাছে যাওয়ারও কোনো সম্ভাবনা নেই। সেই হিসেবে বিবেচনা করলে শাহীন আক্তার ধরেই নিতে পারেন আগামীবারেরও সংসদ সদস্য তিনিই। বরং কত বেশি ভোটে তিনি বিজয়ী হয়ে আসছেন সেটাই এখন দেখার বিষয়। তবে এমপি হিসেবে শাহীন আক্তারের সাধারণ মানুষের কাছে তেমন কোন গ্রহণযোগ্য নেই। তিনি বরং এমপি হয়েছেন আবদুর রহমান বদির কারণেই। এবারও তিনি সহজে ভোটের মাঠের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও তা হবে কেবল স্বামী বদির মাঠ পর্যায়ের জনপ্রিয়তার জন্যই।

এই আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন জেলা যুবলীগের সভাপতি সোহেল আহমদ বাহাদুর, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শিল্প গ্রুপ শাহপরী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাহা ইয়াহিয়া, আবদুর রহমান বদির পুত্র দাবিকারী মোহাম্মদ ইসহাক। এই ৩ জন যদি মনোনয়ন দৌড়ে টিকে থাকতেন তাহলে শাহীন আক্তারের জন্য জয়টা অতটা সহজ হতো না। তাহা ইয়াহিয়ার এলাকায় পরিচিতি ও প্রভাব রয়েছে। তার বাবা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া এই অঞ্চলের পরিচিত ব্যক্তিত্ব।

অন্যদিকে সোহেল আহমদ বাহাদুর জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি হিসেবে দলীয় পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে শাহীন আক্তারকে চাপে ফেলতে পারতেন। সবচেয়ে বেশি চাপে ফেলতে পারতেন যিনি, তিনি হলেন আবদুর রহমান বদির কাছে পিতৃত্বের দাবিতে আদালতে মামলাকারী সেই মোহাম্মদ ইসহাক। তিনি যদি মনোনয়ন বাছাইয়ে টিকে
যেতেন তাহলে হয় তো নিজের পিতৃত্বের বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি আদায় করতে পারতেন এবং বদিকে আরো বেশি বিতর্কিত করে তুলতে পারতেন । এমনটা ঘটার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। কিন্তু বাছাইয়ে ঝড়ে যাওয়ায় সেই সম্ভাবনা আর তৈরি হয়নি। তাই এবারও শাহীন আক্তারের জন্য ভোটের মাঠ রয়েছে অনেকটা পরিস্কার ও মসৃণ।

পাঠকের মতামত

কুতুপালং পশ্চিমপাড়ায় পরিচয় যাচাইহীন রোহিঙ্গা ভাড়া, বাড়ছে শঙ্কা

মিয়ানমারের রাখাইনে আরাকান আর্মি ও সেনা জান্তার সংঘর্ষে প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। সীমান্ত ...

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মানবিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে ইউনাইটেড নেশন টিম

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন ইউনাইটেড নেশন ফোরাম বাংলাদেশ স্টাডি প্রোগ্রাম (BSP) এর ...

কক্সবাজারে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ধর্ম ও প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগ

কক্সবাজারে বাল্যবিবাহ শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হলো “বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে করণীয়” শীর্ষক আন্তঃধর্মীয় নেতৃবৃন্দের ...