প্রকাশিত: ০৮/১২/২০১৬ ৭:৩২ এএম

তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজার ও জাবেদ ইকবাল, টেকনাফ::

সেনা বর্বরতার শিকার হয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী জড়ো হচ্ছে নাফ নদের ওপারে। আর রাতের আঁধারে নদ পাড়ি দিয়ে অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে।

রোহিঙ্গার এই স্রোত থামাতে গিয়ে গলদ্ঘর্ম বিজিবি, কোস্ট গার্ডসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের তৎপরতায় সর্বশেষ গত দুই দিনে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু বোঝাই ১২টি নৌকা মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে।এদিকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ব্যস্ততার ফাঁকে নজরদারির বাইরে চলে যাচ্ছে ইয়াবা চোরাচালান। মিয়ানমার থেকে সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পাশাপাশি এই ভয়ংকর মাদকের চোরাকারবারিরাও যেন প্রতিযোগিতায় নেমে গেছে। অনেকটা বাধাহীনভাবে তারা দেশের ভেতরে নিয়ে আসছে ইয়াবা ট্যাবলেটের চালান। নাফ নদ-তীরবর্তী সীমান্তের উখিয়া-টেকনাফ উপজেলার কমপক্ষে ২০টি পয়েন্ট দিয়ে পাল্লা দিয়ে ঢুকছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারী ও ইয়াবার চালান।

সীমান্তের লোকজন জানায়, টেকনাফের উত্তরে উখিয়া উপজেলার সীমান্ত পর্যন্ত নাফ নদতীরের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। অন্যদিকে টেকনাফের দক্ষিণ সীমান্তের শাহপরীর দ্বীপ থেকে শুরু করে সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের বাংলাদেশ জলসীমায় ঢুকছে লাখ লাখ ইয়াবা ট্যাবলেটের চালান।

গত এক সপ্তাহ উখিয়া-টেকনাফ সীমান্ত ঘুরে জানা গেছে, কমপক্ষে ২০টি পয়েন্ট দিয়ে দেদার ঢুকছে রোহিঙ্গা ও ইয়াবার চালান। নাফ নদের কাঞ্জরপাড়া, ঝিমংখালী, খারাংখালী, আলীখালী, মৌলভীবাজার, হ্নীলা, দমদমিয়া, নাজিরপাড়া, নাইটংপাড়া, লম্বাবিল, খারাংগ্যাঘোনা, জাদিমুরা, জালিয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, খুরেরমুখ, সাবরাং, রহমতের বিল, উলুবনিয়াসহ বিভিন্ন পয়েন্টে দিন-রাত চলছে চোরাচালানিদের তৎপরতা। সীমান্তে দায়িত্বরত বিজিবি, কোস্ট গার্ডসহ আইন প্রয়োগকারী অন্যান্য সংস্থার সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়েই রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সঙ্গে জড়িত দালাল ও ইয়াবা পাচারকারীরা এসব পয়েন্টে ঢুকে পড়ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ সামাল দেওয়ার ফাঁকে ইয়াবা পাচারের ঘটনা বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে। ধরা পড়ছে মাদকের বড় বড় চালান। গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে রাতে পৃথক দুই অভিযানে কোস্ট গার্ড আটক করেছে ছয় লাখ পিস ইয়াবার চালান। সে সঙ্গে আটক করা হয়েছে চার পাচারকারিকে। ইয়াবার বড় বড় চালান পাচারের ঘটনা বৃদ্ধির কথা স্বীকার করেছেন সীমান্তে দায়িত্বরত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারাও। টেকনাফ সীমান্তে কর্মরত আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কোনদিকে সামাল দেব বুঝতে পারছি না। রোহিঙ্গা তাড়াতে গেলে ইয়াবা ঢোকে, আবার ইয়াবা আটকাতে গেলে রোহিঙ্গা ঢোকে। ’

কোস্ট গার্ডের টেকনাফ স্টেশনের কর্মকর্তা লে. কমান্ডার মো. নাফিউর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গারা ইয়াবা পাচারে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়েছে। এক দফায় আটক ১৬ জন পাচারকারির বেশির ভাগই রোহিঙ্গা। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ’ তবে ইয়াবা চোরাচালান দমনে নজরদারি কমে আসার তথ্যের সঙ্গে তিনি দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘সীমান্তে অবৈধভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ যাতে না হয় সে জন্য বিজিবি ও কোস্ট গার্ড সতর্ক এবং তৎপর রয়েছে। ফলে অন্যান্য সময়ের চেয়ে গত দুই মাসে বেশি ইয়াবার চালান ধরা পড়ছে। ’

টেকনাফ সীমান্তে দায়িত্বরত বিজিবি-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা বৃদ্ধির পর থেকে বিজিবি সদস্যরা মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন অনুপ্রবেশসহ ইয়াবা পাচার রোধ করতে। নাফ নদের তীরবর্তী কাদা মাটি, ভাঙা বেড়িবাঁধ ও জঙ্গলবেষ্টিত হওয়ায় অনেক সময় কিছু অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। তবে ইয়াবা পাচার স্থলসীমান্তে এক প্রকার বন্ধ করা গেছে। ’ তিনি বলেন, ‘সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নেই এবং সীমান্ত সড়কও নেই। এসব কারণে দীর্ঘ সীমান্ত রাত-দিন একটানা পাহারা দেওয়ার কাজটি শতভাগ সঠিকভাবে পালন করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। ’

লে. কর্নেল মো. আবু জার আল জাহিদ আরো বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে গিয়ে বিজিবি টহল ও সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি স্থল ও নৌপথে টহল জোরদার করা হয়েছে। এতে ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনায় অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশি হচ্ছে। ’

বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড গত ১ নভেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি বোট ও ১২ জন চোরাকারবারিকে আটক করেছে। একই সঙ্গে জব্দ করেছে ১২ লাখ ৫৭ হাজার পিস ইয়াবা। এর আগে গত ৩ মে থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ছয় মাসে দুটি বোট ও ১৯ জন কারবারি আটকসহ ১২ লাখ ৬৪ হাজার ৬৪০ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয়। সব মিলিয়ে গত ছয় মাসে কোস্ট গার্ডের আটক করা ইয়াবার আনুমানিক মূল্য ১২৬ কোটি আট লাখ ২০ হাজার টাকা।

অন্যদিকে গত নভেম্বর মাসে নাফ নদ থেকে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুবাহী কমপক্ষে ২০০ নৌকা ফিরিয়ে পাঠিয়েছে বিজিবি। ১ থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে নাফ নদের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে আসা এসব নৌকা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এসব নৌকায় কমপক্ষে দুই হাজার রোহিঙ্গা ছিল বলে জানায় বিজিবি। গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারে তিনটি চৌকিতে হামলার ঘটনার পর প্রথম দিকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ চেষ্টা তেমনটি দেখা না গেলেও নভেম্বর মাসে অনুপ্রবেশ চেষ্টা ছিল উল্লেখযোগ্য।

সেন্ট মার্টিনসে ছয় লাখ ইয়াবা জব্দ : সেন্ট মার্টিনসে পৃথক দুটি অভিযানে একটি বোটসহ ছয় লাখ পিস ইয়াবা ও চার পাচারকারিকে আটক করেছে কোস্ট গার্ড। সোমবার দিবাগত রাত থেকে ভোর পর্যন্ত এ দুটি অভিযান চালানো হয়। আটক চার পাচারকারি হচ্ছে—টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাবিরছড়া গ্রামের আব্দুল হামিদের ছেলে বাবুল মিয়া, মোহাম্মদ সিরাজের ছেলে জমির আহমদ, হোসেন আহমদের ছেলে ইদ্রিস ও সলিম উল্লাহর ছেলে জোবায়ের।

কোস্ট গার্ড সেন্ট মার্টিনস অফিস ইনচার্জ লে. আতাউর রহমান জানান, সেন্ট মার্টিনস দ্বীপের ছেঁড়াদিয়ার দুই নটিক্যাল মাইল পশ্চিমে সোমবার রাতে কোস্ট গার্ড টহল টিম একটি বোটে তল্লাশি চালিয়ে ৫০ হাজার পিস ইয়াবা পায়। পরে চার পাচারকারিসহ বোট ও ইয়াবা ট্যাবলেটগুলো জব্দ করা হয়।

এ ছাড়া মঙ্গলবার ভোরে সেন্ট মার্টিনসের পশ্চিম বিচে তিন ব্যক্তিকে সন্দেহবশত চ্যালেঞ্জ করলে তারা কয়েকটি বস্তা ফেলে পালিয়ে যায়। পরে বস্তাগুলোয় সাড়ে পাঁচ লাখ পিস ইয়াবা পাওয়া যায়।

রোহিঙ্গা বোঝাই ১২ নৌকা ফেরত : নাফ নদ পাড়ি দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু বোঝাই ১২টি নৌকা ফেরত পাঠানো হয়েছে। টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আবু জার আল জাহিদ জানান, সোমবার রাত থেকে গতকাল বুধবার সকাল পর্যন্ত সীমান্তের কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে নাফ নদের শূন্য রেখা অতিক্রমকালে নৌকাগুলো মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়। প্রতিটি নৌকায় ১০-১২ জন রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু ছিল। তিনি বলেন, সীমান্তে কড়া নজরদারির ফলে আগের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা নেই। বিজিবির পক্ষ থেকে সীমান্ত ও উপকূলে টহল জোরদার করা হয়েছে। কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে বিজিবি একাধিক চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে।

নাফ নদে নারীর লাশ : টেকনাফ স্থলবন্দরের উত্তর পাশে নাফ নদে ভাসমান অবস্থায় এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। লাশটি কোনো এক রোহিঙ্গা নারীর বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত সোমবার ভোরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে রেহাই পেতে ৩৫ জনের রোহিঙ্গা বোঝাই একটি নৌকা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য আসার পথে নাফ নদের মিয়ানমার জলসীমায় ডুবে যায়। এতে অনেক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু নিখোঁজ হয়েছে। উদ্ধার করা লাশটি তাদেরই একজনের বলে ধারণা করছে স্থানীয় লোকজন। সুত্র: কালেরকন্ঠ

পাঠকের মতামত

কক্সবাজারে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র চালু, দৈনিক উৎপাদন ৩০ মেগাওয়াট

কক্সবাজার সদর উপজেলার বাঁকখালী নদীর খুরুশকুল উপকূলে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছেছবি: প্রথম আলো কক্সবাজার সদর উপজেলার ...

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে টার্গেট কিলিং!

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে চলছে ‘টার্গেট কিলিং’। ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড ...

জান্নাতুলকে খুনের কথা আদালতে স্বীকার করলেন কক্সবাজারের রেজা

রাজধানীর পান্থপথে আবাসিক হোটেলে চিকিৎসক জান্নাতুল নাঈম সিদ্দিকা হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন ...

খাদ্য সংকটে সেন্টমার্টিন

হেলাল উদ্দিন সাগর :: বৈরী আবহাওয়ার কারণে গত এক সপ্তাহ ধরে দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন ...