প্রকাশিত: ১০/০৯/২০১৯ ১২:৫৮ পিএম , আপডেট: ১০/০৯/২০১৯ ১২:৫৯ পিএম

রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের গ্রামগুলি ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। সেখানে স্থাপন করা হয়েছে পুলিশ ব্যারাক, বিভিন্ন সরকারি ভবন এবং শরণার্থী শিবির।

সম্প্রতি মিয়ানমারে এক সরকারি সফর শেষে এই খবর জানিয়েছেন বিবিসি’র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া বিষয়ক প্রতিনিধি।

ওই প্রতিনিধি জানান, একসময় রোহিঙ্গা জনবসতি ছিল স্যাটেলাইট ইমেজে দেখা এমন চারটি এলাকায় সুরক্ষিত স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। তবে রাখাইন রাজ্যের গ্রামগুলিতে রোহিঙ্গাদের বসতি ভেঙে সেখানে সরকারি স্থাপণা নির্মাণের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মিয়ানমারের সরকারি কর্মকর্তারা ।

মিয়ানমারে ভয়াবহ সামরিক অভিযানের মুখে ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের ওই সেনা অভিযানকে ‘পরিকল্পিত জাতিগত নিধন’হিসাবে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ।

এদিকে গত ২২ আগস্ট রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবসনের দ্বিতীয় প্রচেষ্টাটিও ব্যর্থ হয়ে যায়। ওইদিন বাংলাদেশ থেকে ৩৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে রজি হয়েছিলো মিয়ানমার সরকার। কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থীরা নাগরিক অধিকার ছাড়া সেখানে যেতে অস্বীকার করায় দুই দেশের সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। এ ঘটনায় পরস্পরকে দুষছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকার।

মিয়ানমারে যা দেখেছে বিবিসি

বিবিসি প্রতিনিধি জানান, ‘সরকার আমাদের হেলা পো পো কাউং ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে গেছে, যেখানে ২৫,০০০ হাজারের মতো প্রত্যাবাসী থাকতে পারবে বলে তারা আমাদের জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের স্থায়ী আবাসনে নিয়ে যাওয়ার আগে এখানে তারা দু’মাস ধরে অবস্থান করবে।’

প্রায় এক বছর আগে ওই ক্যাম্পের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আর এটি নির্মাণ করা হয়েছে এমন জায়গায় যেখানে একসময় হাও রি তু লার এবং থার জ কোনে নামে দুটো গ্রাম ছিল। ২০১৭ সালের সহিংসতার পর গ্রামগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে।

ওই ক্যাম্পের প্রশাসনিক কর্মকর্তার কাছে বিবিসি প্রতিনিধি জানতে চান, গ্রাম দুটো কেন ভেঙে ফেলা হয়েছে। কিন্তু ওই কর্মকর্তা কোনো রোহিঙ্গা গ্রাম ভেঙে ফেরার কথা স্বীকার করেননি। উত্তরে তিনি কেবল জানান, সম্প্রতি তিনি এখানে নিয়োগ পেয়েছেন, তাই আগে কি হয়েছে তা তিনি জানেন না।

এরপর সাংবাদিকদের নিয়ে যাওয়া হয় কিয়েন চুংয়ে নামের আরেকটি প্রত্যাবাসী ক্যাম্পে। ভারত ও জাপান সরকারের অর্থ সহায়তায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য দীর্ঘ মেয়াদি এই ক্যাম্পটি তৈরি করেছে মিয়ানমার সরকার। মিয়ার জিন নামের রোহিঙ্গা গ্রাম ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে সেখানেই বানানো হয়েছে এই ক্যাম্পটি। এর অদূরেই গড়ে উঠেছে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর এক সেনা ছাউনি, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছিলো এই সেনাবাহিনীর একটা ইউনিট। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিছু মিয়ানমার কর্মকর্তাও বিবিসির এই প্রতিনিধির কাছে মিয়ার জিন গ্রামটি ভেঙে ফেলার কথা স্বীকার করেছেন।

এরকমই গুড়িয়ে দেয়া অরেকটি গ্রাম মিয়ো গুই, একসময় যার বাসিন্দা ছিলো ৮ হাজারে বেশি রোহিঙ্গা। গাড়িতে যেতে যেতে মিয়ো থু গুই নামের একটি গ্রামের কিছু দৃশ্য ভিডিও করেন বিবিসি প্রতিনিধি। সেখানে তিনি বহু গুড়ে যাওয়া বাড়ি দেখেছেন। আর সেখানেও তৈরি হচ্ছে বড় বড় সব স্থাপনা। যদিও রোহিঙ্গা গ্রামগুলোকে ঘিরে থাকা গাছগুলো এখনো সেখানে দণ্ডায়মান। তবে মিয়ো থু গুই গ্রামের অবস্থা ভিন্ন। এখানকার সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে, গ্রামের ওপর তৈরি করা হয়েছে বিশাল এক পুলিশ কমপ্লেক্স।

এরপর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ইন দিন নামের সেই আলোচিত গ্রামটিতে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে এখানেই ১০ রোহিঙ্গা মুসলিমকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করেছিল মিয়ানমার সেনারা, যার দায় এখনও স্বীকার করেনি মিয়ানমার সেনাবাহিনী। ইন দিন গ্রামের তিন চতুর্থাংশ অধিবাসীই ছিলো রোহিঙ্গা মুসলিম, বাকি এক ভাগ রাখাইন বৌদ্ধ। কিন্তু আজ সেখানে মুসলিমদের কোনো চিহ্ণই খুঁজে পাওয়া যায়না। গ্রামগুলোর মুসলিম বসতিতে নেই কোনো প্রাণের স্পন্দন, গোটা এলাকা জুড়ে বিরাজ করছে কবরের নিস্তব্ধতা! এখানে গেলে আপনি প্রথমে ধন্ধে পড়বেন, রাতারাতি কোথায় উধাও হয়ে গেলো রোহিঙ্গাদের বসতি আর গাছগুলো। একটু এগুলেই পেয়ে যাবেন উত্তর। সেখানে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িগুলো ভেঙে তৈরি করা হয়েছে বর্ডার গার্ড পুলিশের একটি বিশাল ব্যারেক, যা ঘিরে রাখা হয়েছে কাঁটাতারের বেষ্টনি দিয়ে। ওই গ্রামের রাখাইন বৌদ্ধ বাসিন্দারা বিবিসি প্রতিনিধিকে জানায়, তারা এখানে আর কখনও মুসলিমদের থাকেতে দেবে না।

মিয়ানমারে কি শরণার্থী হয়েই থাকবে রোহিঙ্গারা?

এইসব দেখার পর বিবিসি প্রতিনিধির এই বিষয়ে নিশ্চিত যে, ২০১৭ সালে সেনা অভিযানের মুখে যারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আর কখনই তাদের ঘরবাড়ি বা পুরনো জীবন ব্যবস্থায় ফিরতে পারবে না। বড় আকারের শরণার্থী প্রত্যাবর্তনের একমাত্র দৃশ্যমান প্রস্তুতি হচ্ছে হলা পো কাউংয়ের মতো জরাজীর্ণ ট্রানজিট শিবির এবং এর সংলগ্ন কায়েন চৌংয়ের স্থানান্তর শিবির। এই ধরনের প্রস্তুতিতে ভবিষ্যতের জন্য খুব কম শরণার্থীর পক্ষেই দু’বছর আগের ট্রমা কাটিয়ে উঠা সম্ভব। তাই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কতটা আন্তরিক তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

বিবিসি প্রতিনিধি বলেন, ‘ইয়াঙ্গুন থেকে ফেরার পথে আমি একজন বাস্তুচ্যুত তরুণ রোহিঙ্গার সাথে দেখা করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমাকে খুব কৌশলে আলাদাভাবে তার সঙ্গে দেখা করতে হয়েছে। কেননা কোনো বিদেশিকে রোহিঙ্গাদের সাথে দেখা করার অনুমতি দেয়া হয়না। ওই রোহিঙ্গা যুবক তার বাড়ি থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর গত সাত বছর ধরে একটি আইডিপি ক্যাম্পে সপরিবারে বন্দি রয়েছেন। ২০১২ সালে সহিংসতায় যে ১৩০,০০০ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়েছিলো ওই যুবক তাদেরই একজন। তার পক্ষে কেনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া সম্ভব নয়। এমনকি বিনা অনুমতিতে ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ারও প্রশ্ন উঠে না। তাই বাংলাদেশে ঠাঁই নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রতি তার পরামর্শ, তারা যেন ভুলেও মিয়ানমারে ফেরার ঝুঁকি না নেয়।’

কি বলছে মিয়ানমার সরকার?

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলো পরিদর্শনের পর সেখানকার সরকারি প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করেছিলেন বিদেশি সাংবাদিকরা। তারা ওই প্রতিনিধিকে রোহিঙ্গা গ্রামগুলো ধ্বংস করার বিষয়ে নানা প্রশ্ন করেন। কিন্তু তারা তাদের কোনো প্রশ্নেরই উত্তর পাননি। আর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কার্যত খুব সামান্য প্রমাণ খুঁজে পেয়েছেন তারা।

রোহিঙ্গাদের মায়ানমারের বাসিন্দা হিসাবে মনে করে না সে দেশের সরকার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা। ফলে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের দাবি এবং চলাফেরার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিতে অস্বীকার করেছে মিয়ানমার সরকার। এর বদলে তাদের দেয়া হতে পারে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড, যা নাকি চূড়ান্ত নাগরিকত্বের দিকে এক ধাপিএগিয়ে দেবে। তবে বেশিরভাগ রোহিঙ্গা এই কার্ডগুলি প্রত্যাখ্যান করেছে। কেননা সেখানে তাদের জাতিয়তা পরিচয় রোহিঙ্গার বদলে ‘বাঙালি’হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

পাঠকের মতামত

আশ্রয় নেওয়া বিজিপিদের বিনিময়ে বাংলাদেশি বন্দি মুক্তি দেবে মিয়ানমার

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি) সদস্যদের ফেরানোর বদলে দেশটির জান্তা সরকারের কারাগারে থাকা ...

মিয়ানমারের পরবর্তী নির্বাচন দেশব্যাপী নাও হতে পারে: জান্তা প্রধান

মিয়ানমারে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরলে নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে ক্ষমতাসীন জান্তা সরকারের। তবে সে নির্বাচন ...

এমভি আবদুল্লাহতে বিমান বিধ্বংসী অস্ত্র বসিয়েছে জলদস্যুরা

সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নিজস্ব ...