প্রকাশিত: ০৯/০২/২০১৯ ৭:৩৬ এএম

উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের লক্ষ্যে জাতিসংঘের কাঠামো যখন কাজ শুরু করতে চলেছে তখন মিয়ানমার জাতিসংঘে উত্থাপিত এক প্রতিবেদনে গণহত্যা, ধর্ষণের মতো গুরুতর সব অপরাধ রীতিমতো অস্বীকার করেছে। নারীর প্রতি সহিংসতা বিলোপ সংক্রান্ত সনদের আওতায় মিয়ানমার গত সপ্তাহে জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তরে প্রতিবেদনটি উত্থাপন করে। সেই প্রতিবেদনের উপসংহারে রোহিঙ্গাদের কথা উল্লেখ না করে মিয়ানমার বলেছে, ‘রাখাইন রাজ্যের জটিলতা ও চ্যালেঞ্জগুলো একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানবাধিকারের ক্ষুদ্র দৃষ্টি দিয়ে দেখা উচিত নয়, বরং একটি সম্প্রদায়ের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা বৈষম্য হবে।’

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারে নতুন করে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর জাতিসংঘের একটি দল কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বলেছিল, রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত করতে ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে মিয়ানমার বাহিনী। গত বছরের আগস্টে জাতিসংঘের স্বাধীন সত্যানুসন্ধানী দলের প্রতিবেদন এবং পরে মানবাধিকার পরিষদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে সাধারণ পরিষদ ভবিষ্যতে মিয়ানমারের বিচারের জন্য দেশটিতে সংঘটিত গুরুতর অপরাধের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণের জন্য আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ ও স্বাধীন কাঠামো (ট্রিপলআইএম) সৃষ্টি করেছে। কূটনৈতিক সূত্রে জানা যায়, জাতিসংঘ এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের পর সেই কাঠামো সচল হতে চলেছে।

সত্যানুসন্ধানী দলের প্রতিবেদনে উঠে আসা তথ্য এবং আলোচিত বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের সিডও কমিটি মিয়ানমারের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে ১২টি প্রশ্নের জবাব চেয়েছিল। এর প্রথমটিই ছিল রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমান নারী ও কন্যাশিশুদের ওপর মিয়ানমার বাহিনীর ধর্ষণসহ যৌন সহিংসতার বিষয়ে। মিয়ানমার এ বিষয়ে তার নিজস্ব তদন্তের বরাত দিয়ে বলেছে, ‘এ ধরনের বর্বর অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই।’ তবে ২০১৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ও ৩০-৩১ মার্চ মংডুর একটি পুলিশ স্টেশনে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ছয়টি ধর্ষণের অভিযোগ থাকার কথা মিয়ানমার কৌশলে স্বীকার করেছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গত বুধবার ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দিলে এ অঞ্চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় গণহত্যা সংঘটিত হতো। এর পরও ২৪ হাজার নিহত হয়েছে। ধর্ষিত হয়েছে ১৮ হাজার। এক লাখ ১৫ হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। এক লাখ ২০ হাজার ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলেছে। এর ফলে বাধ্য হয়ে তারা এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে।’

নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গতকাল শুক্রবার বলেছে, মিয়ানমার তার অত্যন্ত বেদনাদায়ক সত্যকে অস্বীকার করেই চলেছে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর বিষয়ে অনেক তথ্য-প্রমাণ রয়েছে।

মুসলমান নারী ও কন্যাশিশুদের ‘অপমৃত্যু’ হাঁপানি, ডায়াবেটিস ও পানিতে ডুবে : মিয়ানমারের কাছে সিডও কমিটির দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল অস্বাভাবিক কারণে নিহত মুসলমান নারী ও কন্যাশিশুদের সংখ্যা নিয়ে। জবাবে মিয়ানমার ২০১৬-১৭ সালে মংডুতে ৩৬ জন রোহিঙ্গা নারী ও আট কন্যাশিশু নিহত হওয়ার অভিযোগ থাকার কথা জানিয়েছে। ওই নারীদের মধ্যে ১৫ জন মুসলমান, ২৩ জন হিন্দু এবং ছয়জন অন্যান্য ধর্মীয় ও উপজাতীয় গোষ্ঠীর। মিয়ানমারের তথ্য অনুযায়ী, মুসলমান নারী ও কন্যাশিশুদের ‘অপমৃত্যু’ হয়েছে হাঁপানি, ডায়াবেটিস, পানিতে ডুবে বা অজানা কারণে। অন্যদিকে অমুসলিম নারী ও কন্যাশিশুদের মৃত্যুর জন্য কথিত রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠী আরসাকে দায়ী করেছে মিয়ানমার।

হত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ বিষয়ক প্রশ্নের জবাবে মিয়ানমার আরসা ও এর সহযোগীদের অভিযুক্ত হিসেবে উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশের নাম উল্লেখ না করে মিয়ানমার বলেছে, ওই অভিযুক্তরা প্রতিবেশী দেশে পালিয়ে গেছে।

সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমার বাংলাদেশ থেকে আরসা জঙ্গিদের তৎপরতার অভিযোগ তুললেও ঢাকা জোরালো ভাষায় তা প্রত্যাখ্যান করেছে। গত মাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে তাঁর দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যায় বাংলাদেশকে না জড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে।

রাখাইনে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে পরিচালিত নির্মূল অভিযানে সম্পৃক্ত ব্যাটালিয়ন ও অধিনায়কদের নাম জানতে চেয়েছিল সিডও কমিটি। মিয়ানমার তার জবাবে বলেছে, যেহেতু সেখানে কোনো হত্যা, যৌন সহিংসতা ঘটেনি, তাই সিডও কমিটির এমন প্রশ্ন অসংগতিপূর্ণ।

রোহিঙ্গাদের ওপর নির্মূল অভিযান চালানো ব্যাটালিয়নগুলোকে মিয়ানমার আড়াল করতে চাইলেও যুক্তরাষ্ট্র গত বছর ওই ব্যাটালিয়নগুলোর সবার ওপর অর্থনৈতিক ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডাও গণহত্যায় নেতৃত্ব দেওয়া ওই ব্যাটালিয়নগুলোর অধিনায়কদের ওপর অনুরূপ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

সিডও কমিটি মিয়ানমারের কাছে তাদের সেনাবাহিনীর তদন্ত প্রতিবেদন চেয়েছিল। মিয়ানমার তা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছে, এটি তাদের জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। তবে সেই প্রতিবেদনে নারী ও শিশুদের অধিকার লঙ্ঘনের কোনো অভিযোগ নেই!

ধর্ষণ, যৌন সহিংসতা ও নিপীড়ন বন্ধে মিয়ানমার বাহিনীর সব শাখাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কি না—সিডও কমিটির এমন প্রশ্নের জবাবে মিয়ানমার সরকার বলেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো অভিযোগকে তারা দায়মুক্তি দেয় না। মিয়ানমার বাহিনীতে এসব অপরাধের ব্যাপারে কোনো ছাড় নেই।

মিয়ানমার বাহিনীর হাতে আটক রোহিঙ্গা নারী ও কন্যাশিশুদের সংখ্যাবিষয়ক প্রশ্নের জবাবে মিয়ানমার দাবি করেছে, মাত্র ৪২ জন আটক আছে। তাদের মধ্যে ৩০ জন মাদক বিক্রেতা, ছয়জন মিয়ানমারে অবৈধভাবে ঢুকেছে, তিনজন বৈধ কাগজ ছাড়া চলাফেরা করছিল, বাকি তিনজনের কাছে অবৈধ অস্ত্র বা বিস্ফোরক ছিল।

এদিকে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে রাখাইনে কোনো রোহিঙ্গা নারীর মৃত্যু হয়নি বলে মিয়ানমার তার প্রতিবেদনে দাবি করেছে। রোহিঙ্গাদের অভিযোগ, সন্তান জন্ম দিতে হলেও মিয়ানমার বাহিনীকে তাদের উেকাচ দিতে হয়। অন্যদিকে প্রতিবেদনে মিয়ানমার বলেছে, অন্তঃসত্ত্বা মুসলমান নারীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাই সাপেক্ষে ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত বলে মিয়ানমার প্রতিবেদনে দাবি করেছে। প্রত্যাবাসনে দেরির কথা উল্লেখ করে মিয়ানমার বলেছে, রোহিঙ্গারা চাইলে নিজ ব্যবস্থায় ফিরে যেতে পারে। এরই মধ্যে ছয় দফায় ১৭১ জনকে মিয়ানমার ফিরিয়ে নিয়েছে বলেও দাবি করেছে। তবে এসব দাবির সত্যতা নেই বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। গত ১৫ নভেম্বর প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমারে অনুকূল পরিবেশ না থাকায় একজন রোহিঙ্গাও ফিরতে রাজি হয়নি। সুত্র : কালের কন্ঠ

পাঠকের মতামত