প্রকাশিত: ১৩/০৪/২০১৯ ৮:০৯ এএম

মির্জা মেহেদী তমাল::

রোহিঙ্গা শিবিরে চলছে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি। একের পর এক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। পরস্পর বিরোধী গ্রুপগুলো এখন মুখোমুখি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই শিবিরগুলোর সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

খুনোখুনি, অপহরণ, গুম, লুটপাটসহ নানা জঘন্য অপরাধজনক ঘটনা লেগেই রয়েছে। গত এক বছরে শুধু টেকনাফ ও উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় লাশ পড়েছে ৩০টি। নিজেরা নিজেদের মধ্যেই রক্তাক্ত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ায় এত লাশ।

তবে আশঙ্কাজনক খবর হচ্ছে, খোদ রোহিঙ্গা নিধনকারী বলে পরিচিত প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার সরকারও গোপনে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গ্রুপ সৃষ্টিতে ইন্ধন দিচ্ছে। এ খবর সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ভাবিয়ে তুলেছে।

গত মাসের এক রাতে উখিয়ার কুতুপালং ই-২ শিবিরে রোহিঙ্গা সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের একটি বড় হামলা নস্যাৎ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শিবিরের কয়েকটি মসজিদের মাইকের ঘোষণায় দ্রুত ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছুটে যাওয়ায় বড় ধরনের হামলার ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে।

সরেজমিনে জানা যায়, বর্তমানে শিবিরগুলোতে আল ইয়াকিন নামের একটি সশস্ত্র রোহিঙ্গা গ্রুপ বেশ সক্রিয় রয়েছে।
আল ইয়াকিন নামের সংগঠনটির বেশির ভাগ রোহিঙ্গা আগে আরএসও নামক সংগঠনে ছিল। আল ইয়াকিন সংগঠনকে রোহিঙ্গাদের অনেকেই আরসা হিসেবেও বলে থাকে। সংগঠনটিতে রয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা তরুণ ও যুবক। সাধারণ রোহিঙ্গাদের কাছে আল ইয়াকিন বা আরসা নামের সশস্ত্র সংগঠনটি একটি বড় ধরনের আতঙ্কের নাম। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের কাছে আরেক ত্রাস হিসেবে পরিচিত হচ্ছে ‘ডাকাত বাহিনী’।

ডাকাত বাহিনীটি আবার এক নামে ‘নবী হোসেন বাহিনী’ নামেও পরিচিতি পেয়েছে। প্রায় প্রতিটি শিবিরেই রয়েছে রোহিঙ্গা ডাকাত নবী হোসেন বাহিনীর তৎপরতা। মালয়েশিয়া থেকে ফিরে আসা রোহিঙ্গা নবী হোসেন, ইউনুস, মৌলভী আইউবসহ আরও বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার নেতৃত্বে থাকা বাহিনীটির প্রত্যেকের কাছেই রয়েছে অস্ত্রশস্ত্র। এই বাহিনীর সদস্যরা রাতে এমনকি দিনেও ডাকাতি, ছিনতাইসহ খুনখারাবিতে জড়িত। গত ৩ এপ্রিল এই নবী হোসেন গ্রেফতার হয়। নবী হোসেনকে গ্রেফতার করে উখিয়া থানা পুলিশ। তবে তাকে ছাড়িয়ে নিতে নানাভাবে চেষ্টা তদবির চালিয়ে যাচ্ছে তার গডফাদার নসরুল্লাহ।
নির্যাতনের মুখে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা নিরীহ রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দিতে বাংলাদেশ বহুমুখী সমস্যার মুখে রয়েছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও। তবে আশ্রয় নেওয়া এই বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে গোপনে সক্রিয় ‘সন্ত্রাসী চক্র’ এখন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সন্ত্রাসী রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে নানা ধরনের অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে। নিজেরাই খুনোখুনি করছে। বিগত এক মাসে লাশ পড়েছে ৩০টি। কয়েকটি ঘটনা এরই মধ্যে সমালোচিত হচ্ছে। মো. খালেদ নামে এক রোহিঙ্গা গত মাসে ফেসবুকে এক ভিডিওতে হুমকি দিয়েছে, ‘রোহিঙ্গাদের কোনো ক্ষতি করলে, জোর করে দেশে ফেরত পাঠালে বাংলাদেশ সরকারের সব দফতর এক রাতেই ধ্বংস করে দেওয়া হবে। ’ সে প্রধানমন্ত্রীকেও হুমকি দিয়ে বলেছে, ‘রোহিঙ্গাদের ওপর অন্যায্য কোনো আচরণ হলে ছাড় দেওয়া হবে না। ’ গত ২২ ফেব্রুয়ারি টেকনাফে র‌্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় দুর্ধর্ষ রোহিঙ্গা ডাকাত নুরুল আলম (৩০)। টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা শিবিরের আনসার ক্যাম্পে হামলা, অস্ত্র লুট ও কমান্ডার হত্যার মূল হোতাও ছিল এই নুরুল। সে না থাকলেও তার বাহিনীর দাপট মোটেও কমেনি। তারা পরের দিনই এই হত্যার বদলা হিসেবে রোহিঙ্গা পল্লী চিকিৎসক মো. হামিদকে খুন করে। এ ঘটনার মাত্র তিন দিন পর নয়াপাড়া ক্যাম্পে মোহাম্মদ জয়নাল (২২) নামে আরও একজনকে হত্যা করেছে একদল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। জয়নাল ছিল এই ক্যাম্পের নিরাপত্তা কর্মী। পুলিশের সোর্স সন্দেহে তাকেও হত্যা করা হয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

টেকনাফে নয়াপাড়া নিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্পের পুলিশ পরিদর্শক আবদুস সালাম জানান, ক্যাম্পের এইচ ব্লকে আবদুল হাকিমের দোকানের সামনে দুর্বৃত্তরা জয়নালকে ধরে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে হত্যা করে পালিয়ে যায়। হামলাকারীরা চিহ্নিত ডাকাত নুরুলের লোকজন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, নয়াপাড়া ক্যাম্পের পেছনের পাহাড়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের দুটি গ্রুপ আস্তানা গেড়েছে। দিনে পাহাড়ে আর রাতে ক্যাম্পে চষে বেড়ায় তারা। আবদুল হাকিম ও মো. হাসান এই দুই গ্রুপের নেতা। খুন, ধর্ষণ, ইয়াবা কারবার, মানব পাচার, অপহরণ- এমন কোনো অপরাধ নেই যা তারা করছে না। গত মাসে তাদের হাতে খুন হয়েছেন ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মোহাম্মদ ইলিয়াছ। এর আগে একই ক্যাম্পে মোহাম্মদ ইয়াসের নামে এক রোহিঙ্গা তরুণকে গুলি করে মারা হয়।

উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে ২৮ ফেব্রুয়ারি হামলায় জার্মানির দুই সাংবাদিক আহত হওয়ার ঘটনায় একদল রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী জড়িত ছিল। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে উঠে এসেছে অর্থ ও মূল্যবান মালপত্র ছিনিয়ে নেওয়াই ছিল এই হামলার উদ্দেশ্য।

উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নুরুল ইসলাম জানান, রোহিঙ্গাদের জনপ্রিয় নেতা আরিফ উল্লাহ প্রত্যাবাসনের পক্ষে থাকায় তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধ দিন দিন বাড়ছে।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী গোপনে কাজ করছে। ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটি দালাল গ্রুপ তৈরি করে দিয়েছে তারা। দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা গোপনে এই কাজে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে। একটি সূত্র দাবি করেছে, মিয়ানমারের অর্থে চালিত রোহিঙ্গাদের এই সন্ত্রাসী চক্রটি প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে। কেউ মিয়ানমারে ফিরতে চাইলে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েকজনকে তারা হত্যাও করেছে। এমনকি রোহিঙ্গাদের ভাষানচরে না যাওয়ার জন্যও উসকানি দিচ্ছে তারা। কক্সবাজার পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ ইকবাল হোসেন বলেন, যতই দিন যাচ্ছে, রোহিঙ্গাদের আচার-আচরণে ততই পরিবর্তন আসছে। তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে। তবে এসব ঝুঁকি মাথায় রেখেই দায়িত্ব পালন করা হচ্ছে। সুত্র ;বাংলাদেশ প্রতিদিন।

পাঠকের মতামত

রোহিঙ্গাদের কারণে কক্সবাজারে দীর্ঘস্থায়ী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা

মিয়ানমারের সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী পালিয়ে আশ্রয় নেওয়ার কারণে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ বাংলাদেশের কক্সবাজার ...

কক্সবাজারে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতির মৃত্যু, দায় নিচ্ছে না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ

কক্সবাজার শহরের বেসরকারি ইউনিয়ন হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় আফসানা হোসেন শীলা নামের এক প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে ...

কক্সবাজারের রেলপথ অনিরাপদ

প্রায় পৌনে ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে ট্রেন চলছে ঝুঁকি নিয়ে। ...

বগি লাইনচ্যুত, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ

চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারগামী বিশেষ ট্রেনের (ঈদ স্পেশাল) ইঞ্জিনসহ তিনটি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। এতে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম রুটে ...