প্রকাশিত: ২৪/০৩/২০১৮ ৯:১২ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৫:০৪ এএম

রুহুল আমিন রাসেল::
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পাশবিক নির্যাতনের মুখে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণে ৮টি নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এনজিওবিষয়ক ব্যুরো। জরুরি ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা-এনজিওগুলোর জন্য এ নির্দেশনা।

দেশি-বিদেশি এনজিওগুলোকে গত ৬ মার্চ দেওয়া ওই নির্দেশনার মধ্যে আছে, সন্ধ্যার পর আশ্রয় শিবিরে কোনো এনজিও কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না। তাদের কার্যক্রম মানবিক সহায়তার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। রাষ্ট্র ও সরকারবিরোধী কার্যক্রমে জড়িত থাকা যাবে না। জানা গেছে, রোহিঙ্গা শিবিরে দেশি-বিদেশি ৭২টি এনজিও ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছে। এদের প্রায় বেশির ভাগ এনজিওর বিরুদ্ধেই অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। গুরুতর অনিয়মের প্রমাণও পেয়েছে সরকার। ত্রাণ বিতরণে নিয়োজিত এনজিওগুলোর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দ করা চাল, ডালসহ ত্রাণসামগ্রী মেরে দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট এনজিওগুলোকে কড়া ভাষায় তিরস্কার করা হয়েছে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো একাধিক পত্রে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

যার অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে পাঠানো হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের জন্য কর্মরত দেশি-বিদেশি এনজিওগুলোর ত্রাণ বিতরণে একটি কর্মপরিধি প্রণয়ন করে গত ৬ মার্চ নির্দেশনাপত্র জারি করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এনজিওবিষয়ক ব্যুরো। সংস্থাটির মহাপরিচালক কে এম আবদুস সালাম স্বাক্ষরিত ওই নির্দেশনাপত্রে বলা হয়, বল প্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের জন্য গৃহীত ত্রাণ কার্যক্রম/প্রকল্প (এফডি-৭) বাস্তবায়নে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি এনজিওসমূহ কাজ করছে। এনজিওসমূহ তাদের প্রকল্প অনুমোদনের পর মাঠ পর্যায়ে জেলা প্রশাসন এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে থাকে। জরুরি ত্রাণ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে এনজিওদের জন্য একটি কর্মপরিধি প্রণয়ন করা হলো। পত্রে উল্লিখিত কর্মপরিধির ৮ নির্দেশনা হচ্ছে—এক. অনুমোদিত এফডি-৭ অনুযায়ী সব সামগ্রী নিয়ে সংশ্লিষ্ট এনজিওকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কাছে রিপোর্ট করতে হবে। প্রতি পাতায় এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর কর্মকর্তা কর্তৃক অনুস্বাক্ষরিত এফডি-৭’র কপি আবশ্যিকভাবে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার, জেলা প্রশাসকের কাছে দাখিল করতে হবে। জেলা প্রশাসকের তত্ত্বাবধায়নে ও নির্দেশনা অনুযায়ী কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।

দুই. প্রকল্পভুক্ত কর্মীদের তালিকা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকের কাছে দাখিল করতে হবে। এর অতিরিক্ত কোনো কর্মীকে ত্রাণ কার্যক্রমে সম্পৃক্ত কর যাবে না। তিন. এই কার্যক্রমে সংযুক্ত সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবকের এনজিও কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সরবরাহ করা পরিচয়পত্র দৃশ্যমানভাবে ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। চার. শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার এবং জেলা প্রশাসকের কাছে দাখিল করা এফডি-৭’র প্রাপ্তি স্বীকারপত্র ১৫ দিনের মধ্যে এনজিওবিষয়ক ব্যুরোতে দাখিল করতে হবে। পাঁচ. কর্মসূচি বাস্তবায়নের ১৫ দিনের মধ্যে সমাপনী প্রতিবেদন, স্থানীয় প্রশাসনের প্রত্যয়নপত্র এবং ৩০ দিনের মধ্যে অডিট রিপোর্ট এনজিওবিষয়ক ব্যুরোতে দাখিল করতে হবে। ছয়. চিকিৎসা এবং জরুরি সেবা প্রদানকারী সংস্থাসমূহ ব্যতীত অন্য কোনো এনজিও সন্ধ্যার পর রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। সাত. এনজিওর কার্যক্রম মানবিক সহায়তার মধ্যে সীমাবন্ধ থাকতে হবে। আট. সংস্থা বা প্রকল্পের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রকল্প বাস্তবায়নকালে রাষ্ট্র, সরকার, প্রত্যাবাসনবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারবে না।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর ওই ৮টি নির্দেশনা সংক্রান্ত পত্রের অনুলিপি দেওয়া হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মুখ্য সচিব, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব, কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার, এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর পরিচালক (নিবন্ধন ও অডিট), কক্সবাজার জেলা প্রশাসকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে।খবর বিডিপ্রতিনিদিনের

এর আগে গত জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থবিভাগসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পাঠানো একাধিক পত্রে উল্লেখ করা হয়, সরকারের দেওয়া ভর্তুকি মূল্যে চাল, ডাল, গামছা, সাবানসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করার কথা থাকলেও এনজিওগুলো রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরে অনেক বেশি দামে তা সরবরাহ করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বরাদ্দ মূল্যের চেয়ে বেশি দামে চাল, ডাল সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু গামছা, টুথব্রাশ, ডাস্টবিন, ডাস্টফেন, বেলচা দেওয়ার কথা থাকলেও তা সরবরাহ করছে না। অথচ জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে এসব পণ্য বুঝে নিয়েছে এনজিওগুলো। সূত্র জানায়, ত্রাণ কার্যক্রমে এমন অভিযোগ পাওয়ার পর কক্সবাজার জেলা প্রশাসন তা তদন্ত করেছে। এই তদন্ত প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ১৪০ টাকায় ৫ কেজি ডাল সরবরাহের কথা থাকলেও এনজিওগুলো ৭০ টাকায় পরিবার প্রতি তিন কেজি ডাল সরবরাহ করছে। প্রতি পরিবারের বাকি দুই কেজি ডাল নিজেরা আত্মসাৎ করেছে। ১২০ টাকায় ৫ কেজি চাল দেওয়ার কথা থাকলেও ৭০ টাকায় ৩ কেজি চাল সরবরাহ করা হয়েছে। ৩২০ টাকায় বড় ময়লা ফেলার ডাস্টবিন সেট ও টুথব্রাশ দেওয়ার কথা থাকলেও ৪৫ টাকা মূল্যে ছোট ময়লার ঝুড়ি দিয়েছে। প্রত্যেক পরিবারকে ২০০ টাকা দামের একটি করে গামছা দেওয়ার কথা থাকলেও ৮০ টাকা দামের একটি গামছা দুই টুকরা করে একটি করে টুকরো প্রতি পরিবারে দেওয়া হচ্ছে। অথচ জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে বরাদ্দকৃত মূল্যমানের অর্থ বুঝে নিয়েছে এনজিওগুলো। এভাবে বিপুল পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী ও নগদ অর্থ এনজিওগুলো আত্মসাৎ করেছে বলে মনে করে জেলা প্রশাসন।

পাঠকের মতামত