প্রকাশিত: ১১/০৮/২০২০ ২:০৮ পিএম

তানভীর হাসান, ঢাকা ও আরাফাত সানী, টেকনাফ::
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যাকারী বাহারছাড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত হোসেনের নামেও বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। এই কেন্দ্রে যোগদানের সাত মাসের মধ্যেই তিনি এলাকায় মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ওঠেন। অভিযোগ রয়েছে মাদক ব্যবসায়ী ও মানব পাচারের অভিযোগ তুলে একের পর এক এলাকাবাসীকে তুলে এনে চাঁদা আদায় করতেন তিনি। এছাড়া এলাকার ১২টি ফিশারিজ ঘাট থেকেও নিয়মিত মাসোহারা আদায় করতেন। পাশাপাশি টাকা নেওয়ার পরও ক্রসফায়ারে দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে তার ৫০ লাখ টাকার অবৈধ উপার্জন ছিল বলে এলাকাবাসী জানিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে সর্বমহলে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে নিয়ে মাতামাতিতে চাপা পড়ে গেছে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা হত্যা মামলার প্রধান আসামি লিয়াকত হোসেনের অপকর্মগুলো।
জানা গেছে, চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি এই তদন্ত কেন্দ্রে যোগদান করেন ইন্সপেক্টর লিয়াকত হোসেন। প্রথম অবস্থায় তিনি কয়েকদিন এলাকা ঘুরে দেখেন। এরপর ধীরে ধীরে নিজের প্রকৃত চেহারার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো শুরু করেন। ওসি প্রদীপের প্রশ্রয়ে নিজেও এলাকায় গড়ে তোলেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। নিয়োগ দেওয়া হয় ক্যাশিয়ার ও নিজস্ব সোর্স। এরপর গত ২৫ এপ্রিল তিনি মানব পাচারের অভিযোগ তুলে নোয়াখালী পাড়া গ্রামের আব্দুল হাকিমের ছেলে আব্দুস সালামকে তুলে আনেন। এরপর ওই পরিবারের কাছ থেকে সাড়ে ৮ লাখ টাকা নেন। এতে সন্তুষ্ট হতে না পেরে ২৬ এপ্রিল তিনি সালামকে বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করেন বলে পরিবারের অভিযোগ। এ ঘটনার পর এলাকার সবাই লিয়াকত ভয়ে তটস্থ থাকতেন। এতে লিয়াকত এলাকায় প্রদীপের উত্তরসুরি বলে প্রচার বেড়ে যায়।

সূত্রমতে, বাহারছড়া ইউনিয়নটি সাগরতীরে অবস্থিত হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষ মাছ শিকার করে জীবনযাপন করে। এখানে অন্তত ১২টির বেশি ফিশারিজ ঘাট রয়েছে। ঘাটগুলোর মধ্যে শামলাপুরে দুটি, শীলখালী একটি, চৌকিদারপাড়া দুটি, বাইন্যাপাড়া একটি, জাহাজপুরা একটি, হাজমপাড়া একটি, নোয়াখালী পাড়াতে একটি ও কচ্ছপিয়া অন্যতম। প্রতি ঘাটে গড়ে ১শ করে নৌকা রয়েছে। এসব নৌকা সমুদ্রে নামার আগেই দৈনিক ১শ টাকা দেওয়া লাগত তার ক্যাশিয়ার আব্দুলস্নাহ আল মামুনকে। টাকা না দিলেই মানব পাচারের অভিযোগ তুলে ধরে আনা হতো তদন্ত কেন্দ্রে। এছাড়া মৎস্য ব্যবসায়ীদের সংগঠন থেকেও প্রতি মাসে ৬ লাখ টাকা চাঁদা নিত বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব টাকা না দিলে মাছ ধরা ও ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হতো। পাশাপাশি মাদক দিয়ে চালান করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে থাকত। দীর্ঘদিন ধরে এসব অপকর্ম চলে আসলেও ক্রসফায়ার, মামলা, হামলার ভয়ে মুখ খোলার সাহস পেত না ভুক্তভোগীরা।
শামলাপুর দক্ষিণ ঘাটের সভাপতি বেলাল উদ্দিন বলেন, আমরা প্রতি ঘাট থেকে পুলিশের মেসের জন্য খরচ দিতাম। উত্তরের সভাপতি সৈয়দুল ইসলাম মেম্বার বলেন, মুঠোফোনে তো এসব কথা বলা যায় না। তাদের হুমকি-ধমকিতে ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়। ঘাটপ্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা করে নিয়ে গেলে শুরুতে মা-বোন ধরে গালিগালাজ করত। টাকা কম হওয়াতে এসব গালমন্দ শুনতে হতো বলে জানান সৈয়দুল। পরে টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। লিয়াকত পুরো শামলাপুরকে সাবার করে ফেলেছে বলেও অভিযোগ করেন সৈয়দুল মেম্বার।
একটি ফিশারিজ ঘাটের নৌকার মালিক রাশেদুল আলম জানান, তাদের মিলের জন্য মাছ দিয়ে আসতে হতো। আসলে এত মাছ তাদের প্রয়োজন হতো না। মাছ জমা করে ক্যাশিয়ার মামুন এক দালাল ধরে বিক্রি করে ফেলত। শামলাপুর বাজারে ৩০টির মতো মাছের আড়ত রয়েছে। এসব আড়তে প্রতিদিন ৩০-৫০ জন ব্যবসায়ী মাছ কিনতে আসেন। এসব ছোট মাছ ব্যবসায়ী থেকে ৩০০-৫০০ টাকা চাঁদা নিতেন। এসব চাঁদা না দিলে মাছের ভেতর ইয়াবা রয়েছে বলে মাছ রাস্তায় ছিটিয়ে দেওয়াসহ নানাভাবে হয়রানি করতেন। সেইসাথে ব্যবসায়ীদের ফাঁড়ি উঠিয়ে নিয়ে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করা হতো।
স্থানীয় আড়তদার হেলাল উদ্দিন জানান, ত্রিশ আড়তে প্রতিদিন শত শত মাছ ব্যবাসায়ী মাছ কিনতে আসেন। প্রতি মাছ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৩শ থেকে ৫শ টাকা আদায় করতে ক্যাশিয়ার মামুন। তিনি নিজে এসেই টাকা নিয়ে যেতেন। টাকা দিতে সমস্যা হলে নানাভাবে হয়রানি করা হতো বলেও জানান তিনি।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। শামলাপুরে টমটম থেকেও মাসে ৩ থেকে ৫শ টাকা চাঁদা নিতেন লিয়াকত। টমটম চালক সরওয়ার কামাল জানান, করোনাকালে লকডাউন ঘোষণাকালে ৫শ টাকার জন্য সামনের গস্নাসটি ভেঙে পেলে পরিদর্শক লিয়াকত। এরপর টাকা নিয়েই তিনি গাড়িটি ছেড়েছেন। প্রতিটি টমটম থেকেই তিনি মাসে ৩ থেকে ৫ টাকা আদায় করতেন।
শুধু তা নয়, গ্রাম্য সালিশ থেকেও হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিতেন লিয়াকত ও তার সহযোগীরা। তার চলাফেরা আচার ব্যবহারে প্রায় সব পেশাজীবী শ্রেণি ক্ষুব্ধ ছিলেন। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, লিয়াকত ইচ্ছেমতো চলাফেরা করত। সাধারণ মানুষ তার ভয়ে তটস্থ থাকত। ফাঁড়িতে কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য যেতেও সাহস পেত না অনেকে। এমন পরিস্থিতে লিয়াকতের সহযোগীদেরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।
সরেজমিন বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রে গেলে দেখা যায়, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। একজন অস্থায়ী ভারপ্রাপ্ত ইনচার্জ রয়েছে। তারা এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ। এ ব্যাপারে টেকনাফ থানায় যোগাযোগ করা হলে তদন্ত ওসি এবিএস দোহা জানান, আমি করোনামুক্ত হয়ে মাত্রই এসেছি। তাছাড়া এসব বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাই ভালো জানেন।
তবে গত রোববার টেকনাফ থানায় যোগদানকারী নতুন ওসি আবুল ফয়সাল জানান, টেকনাফে মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে। শুধু অপরাধী ছাড়া সবার জন্যই থানার দরজা উন্মুক্ত। এসব অভিযোগের বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখা হবে।
উলেস্নখ্য, শুক্রবার (৩১ জুলাই) রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার-টেশনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর সিনহা রাশেদ খান। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন ও নিরাপত্তা বিভাগ। একইভাবে তদন্তের স্বার্থে টেকনাফের বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলিসহ ১৬ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়। এ ঘটনার পরে ৫ আগস্ট বুধবার কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। মামলাটির শুনানিতে সন্তুষ্ট হয়ে তা ‘ট্রিট ফর এফায়ার’ হিসেবে আমলে নিতে টেকনাফ থানাকে আদেশ দেন আদালতের বিচারক। আদালতের নির্দেশে টেকনাফ থানায় মামলাটি রুজু হয়। দন্ডবিধি ৩০২, ২০১ ও ৩৪ জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা নং সিআর : ৯৪/২০২০ইং/টেকনাফ। এই মামলায় ৭ জন আত্মসমর্পণ করেন। আদালত তিন দফা শুনানি শেষে তাদের সবাইকে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আসামিরা হচ্ছেন- টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, গুলিবর্ষণকারী ইন্সপেক্টর লিয়াকত, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুলস্নাহ আল মামুন ও এএসআই লিটন মিয়া। মামলার অপর দুই আসামি এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোস্তফার নামে জেলায় কোনো পুলিশের সন্ধান পাওয়া যায়নি। সুত্র: যায়যায়দিন

পাঠকের মতামত

সোনার দামে আবারও রেকর্ড, ভ‌রি‌ ১ লাখ ১৯ হাজার ৬৩৮ টাকা

আবারও সোনার দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)। প্রতি ভরিতে ...