প্রকাশিত: ২৪/১০/২০২১ ৯:৪১ এএম

পৃথিবী থেকে যুদ্ধকে বিদায় জানানো এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে গঠিত জাতিসংঘ পুরোপুরি সফল হয়নি। বিশ্ব থেকে যুদ্ধবিগ্রহ বিদায় করতে সেভাবে সফল হয়নি সংস্থাটি। যদিও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা এখনো বেজে উঠেনি। জাতিসংঘের বড় ব্যর্থতা ফিলিস্তিনি সংকট নিরসন এবং রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমি মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে না পারা। নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য দেশগুলোর ভেটো ক্ষমতা এক্ষেত্রে বড় বাধা। ইসরাইলের অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে কোনো প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করছে যুক্তরাষ্ট্র। অপরদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ভেটো প্রয়োগ করছে চীন। ফলে এ দুটি ক্ষেত্রে জাতিসংঘ কার্যকারিতা হারাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ আজ ৭৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন করছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে দেওয়া এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্তর্ভুক্তিমূলক সহযোগিতাধর্মী জাতিসংঘ গড়ে তুলতে সম্মিলিত প্রচেষ্টার আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস তার বাণীতে বলেন, ৭৬ বছর আগের বিপর্যয়কর এক সংঘাতের ছায়া থেকে বিশ্বের উত্তরণের প্রত্যাশার বাহন হিসাবে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা পায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে সান ফ্রান্সিসকোতে ৫০ দেশের প্রতিনিধিরা সংঘবদ্ধ জাতির আন্তর্জাতিক সংগঠনের ব্যাপারে এক সম্মেলনে মিলিত হন। যুদ্ধ প্রতিহত করার দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে তারা সেখানে জাতিসংঘ সনদ প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেন, যা ১৯৪৫ সালের ২৬ জুন স্বাক্ষরিত হয়। চীন, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং সনদে স্বাক্ষরদানকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর সম্মতির ভিত্তিতে নিউইয়র্কে সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে তার কর্মযাত্রা শুরু করে। বিশ্ব শান্তি রক্ষার উদ্যোগ গ্রহণের এই ঐতিহাসিক দিনটিকে স্মরণ করতে প্রতিবছর ২৪ অক্টোবর তারিখটি জাতিসংঘ দিবস হিসাবে উদ্যাপন করা হয়।

বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ১৩৬তম রাষ্ট্র হিসাবে জাতিসংঘের সদস্যপদ পাওয়ার পর একই বছর সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলায় ভাষণ দেন। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ বদ্ধপরিকর। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের মতো বহুপক্ষীয় সংস্থাকে কাজে লাগাতে চায়। বাংলাদেশ জাতিসংঘে শীর্ষ শান্তিরক্ষা বাহিনী প্রেরণকারী দেশ। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডেও বাংলাদেশ সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে।

বিরোধপূর্ণ ইস্যুগুলোয় জাতিসংঘ কার্যকারিতা হারানোর পরিপ্রেক্ষিতে এই বিশ্ব সংস্থার সংস্কারের কথা উঠছে। বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদের সম্প্রসারণের মাধ্যমে সংস্কারের কথা বলছে অনেক দেশ। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কোনো অবস্থান গ্রহণ করেনি। বড় দেশগুলো সংস্কারের বিষয়ে বিতর্ক করছে। বর্তমানে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী এবং ১০টি অস্থায়ী সদস্য দেশ রয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য সংখ্যা ২৬টিতে উন্নীত করার প্রস্তাব উঠছে। স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র সংখ্যা ১১টিতে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। কেউ কেউ চায় ভেটো ক্ষমতাসহ নিরাপত্তা পরিষদের সম্প্রসারণ। আবার কেউ কেউ চায় ভেটো ক্ষমতা ছাড়া সম্প্রসারণ। আরেক শ্রেণির সদস্য রাষ্ট্র মনে করে, ভেটো ক্ষমতা পুরোপুরি বাতিল হওয়া উচিত। ফিলিস্তিনি ও রোহিঙ্গা সংকট বারবার হোঁচট খেয়েছে ভেটোর কারণে। ফলে বাংলাদেশও আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে ভেটো ক্ষমতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়াও নিরাপত্তা সংস্কার অবশ্যই সমঝোতার ভিত্তিতে হওয়া উচিত বলে ঢাকার কর্মকর্তারা মনে করেন।

জাতিসংঘ সংস্কার প্রস্তাবে সাধারণ পরিষদেও সংস্কার করার প্রস্তাব রয়েছে। সাধারণ পরিষদে শত শত প্রস্তাব পাশ হচ্ছে। কিন্তু এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নের কোনো ম্যাকানিজম নেই। এসডিজি কোন দেশ কতটা বাস্তবায়ন করছে, তা মূল্যায়নের কোনো ব্যবস্থা নেই। তৃতীয় কমিটিতে রোহিঙ্গা নিয়ে অনেক প্রস্তাব পাশ হয়েছে। এর কোনো বাস্তবায়ন নেই। রোহিঙ্গা বিষয়ে বিশেষ দূত নিয়োগের আহ্বান সত্ত্বেও এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তাদানের প্রস্তাব পাশ হলেও এর বাস্তবায়ন নেই। ফলে সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব বাস্তবায়নের ব্যাপারে ম্যাকানিজম রাখার প্রতি বাংলাদেশের নিশ্চয়ই আগ্রহ থাকবে।

জাতিসংঘ মহাসচিব ‘আমাদের অভিন্ন এজেন্ডা’ নামের একটি এজেন্ডা হাতে নিয়েছেন। আগামী ২৫ বছরে জাতিসংঘ কী করতে পারে, সেই প্রস্তাব তিনি প্রণয়ন করছেন। তার প্রতি সবার সমর্থন থাকা উচিত বলে বাংলাদেশ মনে করে। ১২টি থিমের ওপর আগামী ২৫ বছরের রোডম্যাপ তৈরি করা হচ্ছে। বিগত ৭৫ বছরে জাতিসংঘের অর্জন আশানুরূপ নয়। পৃথিবীর বুকে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘের সংস্কার জরুরি বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত।

জাতিসংঘ মহাসচিবের বাণী : আজ জাতিসংঘের নারী-পুরষ সেই প্রত্যাশাকে বিশ্বজুড়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কোভিড-১৯, সংঘাত, ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং জলবায়ু জরুরি পরিস্থিতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, আমাদের এই বিশ্বটা যথাযথ বাসযোগ্য গ্রহ থেকে অনেক অনেক দূরে রয়েছে। তবে এসব সংকট পরিষ্কার করে দিয়েছে যে সংহতির মাধ্যমেই এগিয়ে যেতে হবে। বড় চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের একসঙ্গে কাজ করা প্রয়োজন।

আমাদের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে বিশ্বের সব জায়গার সব মানুষের কোভিড-১৯ টিকাপ্রাপ্তি যত দ্রুত সম্ভব নিশ্চিত করার মাধ্যমে।

সব মানুষের, বিশেষত দরিদ্রতম ও সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত মানুষ, নারী ও মেয়েশিশু এবং শিশু ও তরুণদের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত ও সুরক্ষিত করার মাধ্যমে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

আমাদের বিশ্বটাকে ক্ষতবিক্ষত করা সংঘাত নিরসনের পথ অনুসন্ধানের মাধ্যমে অগ্রসর হতে হবে।

আমাদের এই গ্রহটাকে রক্ষা করতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বড় ধরনের প্রতিশ্রুতি ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে।

অন্তর্ভুক্তিমূলক, আন্তঃসম্পর্কযুক্ত ও কার্যকর বৈশ্বিক সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। যার বিস্তারিত আমার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন ‘আওয়ার কমন অ্যাজেন্ডায়’ আমি তুলে ধরেছি।

জাতিসংঘ সনদকে ৭৬ বছর ধরে শক্তি জুগিয়েছে যেসব মূল্যবোধ-শান্তি, উন্নয়ন, মানবাধিকার এবং সবার জন্য সমান সুযোগ-এর প্রয়োজনীয়তা কখনো ফুরিয়ে যাবে না।

আজ জাতিসংঘ দিবস পালনের সময় আমি এসব আদর্শে সবাইকে একতাবদ্ধ হওয়ার এবং জাতিসংঘের প্রতিশ্রুতি, সম্ভাবনা ও এই বিশ্ব সংস্থার প্রতি প্রত্যাশা পূরণের আহ্বান জানাচ্ছি।

পাঠকের মতামত