প্রকাশিত: ০৮/১১/২০১৭ ১১:২৮ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ১১:২৭ এএম

তোফায়েল আহমদ, উখিয়া থেকে ফিরে ::
মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের জিরো লাইনে ফ্রান্সের এক নাগরিক ঘোরাঘুরি করছিলেন। অদূরেই মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের আনাগোনা।

বিদেশির সঙ্গে রয়েছেন কুতুপালং শিবিরের একজন রোহিঙ্গা। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের আঞ্জুমানপাড়া পয়েন্টে দেখা যায় এ দৃশ্য। এই স্থান দিয়েই সাম্প্রতিক সময়ে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা দলে দলে অনুপ্রবেশ করেছে। সীমান্তে একাকী এক ভিনদেশি নাগরিকের সন্দেহজনক উপস্থিতির খবর পেয়ে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নিকারুজ্জামান সেখানে যান এবং ওই বিদেশিকে নিয়ে আসেন। ইউএনও জানান, ফ্রান্সের এই নাগরিক ভারত থেকে রোহিঙ্গা শিবির দেখতে এসেছেন বলে জানিয়েছেন তাঁকে। খবর কালেরকন্ঠের।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন ‘মাত্র এক দিন আগে সোমবার আমি এবং পুলিশ সুপার একসঙ্গে ওই সীমান্তে গিয়ে বিনা অনুমতিতে অহেতুক বিদেশি নাগরিকদের উপস্থিতি থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করে আসি। কিন্তু আজ সেখানেই বিদেশি নাগরিকের উপস্থিতি মানেই হচ্ছে এ দেশের আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের শামিল। ’ পুলিশ সুপার ড. এ কে এম ইকবাল হোসেন এ বিষয়ে বলেন, বিদেশিরা সরকারের যথাযথ অনুমতি ব্যতিরেকে সীমান্ত এলাকায় অবস্থান বা বসবাস করতে পারে না।

সরকারি প্রশাসনের এ রকম নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী নো ম্যানস ল্যান্ডসংলগ্ন করাচিপাড়া নামক এলাকায় রীতিমতো একটি পাকা বাড়ি ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন একটি আন্তর্জাতিক এনজিওর দেশি-বিদেশি কর্মী।

প্রতি মাসে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা ভাড়ায় সীমান্তের পাকা বাড়িটি ভাড়া নেন তাঁরা। এনজিওর কর্মীরা স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে থাকেন রোহিঙ্গাদের। স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র হচ্ছে কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কসংলগ্ন রোহিঙ্গা শিবিরে। আর তাঁরা অজপাড়াগাঁয়ের কাঁচা রাস্তা পাড়ি দিয়ে অনেক কষ্টে থাকছেন সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডসংলগ্ন এলাকায়।
এ প্রসঙ্গে পালংখালী ইউনিয়নের স্থানীয় ইউপি মেম্বার সুলতান আহমদ গতকাল বলেন, ‘করাচিপাড়ার মোহাম্মদ হারুন দুবাই থাকেন। বিদেশি এনজিও এমএসএফের কর্মীরা হারুনের ঘর ভাড়া নিয়েছেন। সীমান্তের এ রকম দুর্গম এলাকায় তাঁরা কেন থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা আমার বুঝে আসে না। ’ ইউপি মেম্বার আরো জানান, জেলা প্রশাসক ও উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নির্দেশ মতে, তিনি ওই এনজিওর কর্মীদের সীমান্তবর্তী এলাকার ভাড়া বাসা ছেড়ে দেওয়ার কথা জানাবেন।

পালংখালীর ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী গতকাল এই প্রতিবেদককে বলেন, সীমান্ত এলাকায় আরো অনেক দেশি-বিদেশি নাগরিক বাসা ভাড়া নিয়েছে। এলাকার লোকজনও বেশি টাকার বিনিময়ে ঘর ভাড়া দিতে পেরে নিজেরা অন্যত্র সরে যাচ্ছে। চেয়ারম্যান বলেন, ‘প্রশাসনিক কর্মকর্তারা আমাকে এ বিষয়ে নজরদারি করতে বলেছেন। তাই আমি নজরদারি করার কাজ শুরু করেছি। ’ ইউপি চেয়ারম্যান জানান, রোহিঙ্গা শিবিরে রাতবিরাতে অনেক লোকজনের বিচরণ রয়েছে। দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা লোকজনের রোহিঙ্গাদের মাঝে নগদ টাকা-পয়সা দেওয়ার মতো খবরও রয়েছে।

এদিকে সোমবার রাতে উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে পাঁচ বিদেশি নাগরিকসহ ২৬ জনকে আটক করার খবর নিয়েও উঠেছে নানা কথা। দুই নারীসহ এই পাঁচ বিদেশির মধ্যে চারজনই পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। পুলিশের কাছে তাঁদের একজন পরিচয় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক ধনকুবের হিসেবে। আমির ফারুক (৩২) নামের এই পাকিস্তানির নেতৃত্বেই বিদেশিরা গত সপ্তাহে ‘ভিসা অন অ্যারাইভাল’ ব্যবস্থায় ঢাকা আসেন। এই পদ্ধতিতে তাঁদের এখানে এক মাস অবস্থানের সুযোগ রয়েছে। সঙ্গে রয়েছেন মাছয়ার আহমেদ জামাল, হাবিবা জাবিন জামাল ও মোহাম্মদ জামাল। তাঁরাও পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ। অপরজন হচ্ছেন নারী ডিজাইনার পরিচয়দানকারী চায়নার নাগরিক মিস লিংকছোয়া।

বিদেশিরা পুলিশকে জানিয়েছেন, তাঁরা এখানকার আইনকানুন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। এ কারণেই তাঁরা রাতের বেলায়ও রোহিঙ্গা শিবিরে অবস্থান নিয়েছিলেন। বিদেশি নাগরিক হওয়ায় তাঁদের মুচলেকাসহকারে পাসপোর্টের ফটোকপি জমা নিয়ে পুলিশ তাঁদের ছেড়ে দেয়।

সোমবার আটক এই ২১ জনের মধ্যে ১১ জনের বিরুদ্ধে উখিয়া থানা পুলিশ ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়ে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেছে। এ প্রসঙ্গে পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, এই ১১ জনের মধ্যে পাঁচজনকে নানা কারণে সন্দেহ করা হচ্ছে। তাঁরা হচ্ছেন যথাক্রমে রাজধানী উত্তরার মারকাজুল মাদরাসার শিক্ষক পরিচয়দানকারী মাওলানা মোয়াছ আবদুল্লাহ ও শুকুর আলী, টঙ্গীর আল আমিন, নরসিংদীর মওলানা ইউসুফ ও মনির হোসেন। পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা শিবিরে জঙ্গি অর্থায়নেরও অভিযোগ এনেছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা পুলিশকে বলেছেন, গত দুই মাস সময়ে তাঁরা একাধিকবার শিবিরে এসেছিলেন। কুতুপালং শিবিরের মধুরছড়া পাহাড়ি এলাকায় ‘মদিনা পাহাড়’ নাম দিয়ে এসব লোক কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া মাদরাসা ও মক্তব স্থাপন করেছেন। তবে তাঁরা তাঁদের অর্থের উৎস সম্পর্কে পুলিশকে কিছুই জানাতে পারেননি।

সোমবার রাতে পুলিশি অভিযানে পাঁচ বিদেশিসহ আটক ২৬ জনের মধ্যে অপর ১০ জনকে সোমবার রাতেই ভ্রাম্যমাণ আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। সাজাপ্রাপ্তদের সাতজনই রোহিঙ্গা এবং অপর তিনজন স্থানীয় বাসিন্দা।

দুই নৌকা রোহিঙ্গা : গতকাল মঙ্গলবার ভোরে কক্সবাজারের উখিয়ার ইনানী সৈকতে ৬৫ জন রোহিঙ্গা নিয়ে আরো দুটি নৌকা ভেড়ে। বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর ইকবাল আহমেদ জানিয়েছেন, এই রোহিঙ্গাদের কুতুপালং শিবিরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

পাঠকের মতামত