প্রকাশিত: ২৬/১০/২০১৮ ৮:৩৭ পিএম

আবদুর রহমান, টেকনাফ
দেশের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত কক্সবাজারের টেকনাফ। টেকনাফ থেকে ৩৪ কিলোমিটার দূরে সাগরের বুকে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। পরিবেশগত সংকটপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হলেও সরকারি নির্দেশ অমান্য করে এখানে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় দালানকোঠা। ইটের তৈরি এসব স্থাপনার ভারে এখন বিপন্ন হতে চলেছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। এ দ্বীপকে রক্ষা করতে এখান থেকে ইটের দালান সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন পরিবেশবাদী, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় লোকজন।

সম্প্রতি দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষায় ২০১৯ সালের ১ মার্চ থেকে সেন্টমার্টিনে রাতযাপন নিষিদ্ধসহ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে দ্বীপ রক্ষায় গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি।

এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদফতর কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাইফুল আশ্রাব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দ্বীপে পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ১০৮টি হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে ৩৮টি আবাসিক হোটেল ভাঙার নির্দেশনার বিরুদ্ধে আপিল করেছেন হোটেল মালিকপক্ষ। আইনিভাবে লড়াই করে হোটেলগুলো ভাঙা হবে। দ্বীপ রক্ষায় সরকার নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।’

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভাষ্য মতে, ১৯৯৭ সালে সর্বপ্রথম দ্বীপের শত বছরের সঞ্চিত প্রবাল পাথর সরিয়ে মাটি বের করে অবকাশ নামে একটি আবাসিক দোতলা হোটেল নির্মাণ করা হয়। সেটিকে ২০০০ সালে তিনতলা করা হয়। তারপর থেকে শুরু হয় দ্বীপের বুকে সারি সারি ইট-পাথরের দালানকোঠা। প্রবাল দ্বীপে পর্যটনশিল্প বিকাশের দোহাই দিয়ে ’৯০ দশকের পর থেকে একের পর এক গড়ে ওঠে ভবন। শুধু তাই নয়, প্রবাল পাথরের টুকরোগুলো দিয়ে বানানো হচ্ছে প্লটের সীমানাপ্রাচীর। সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দায়ের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালে দ্বীপে পাকা স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং নির্মিত সব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। তখন একে ‘পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা’ ঘোষণা করা হয়। নির্দেশনা মতে, সেন্টমার্টিনে ছোট কিংবা বড় কোনও স্থাপনাই নির্মাণের সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও সেখানে গড়ে উঠেছে ৮৪টি আবাসিক হোটেল। সরকারি হিসাবে এই সংখ্যা শতাধিক।

এখানকার জনপ্রতিনিধিদের দাবি, দ্বীপে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা সকল দালানকোঠা উচ্ছেদ করলে এ দ্বীপ রক্ষা পাবে। সর্বশেষ গত বছরের শেষে দ্বীপে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ৩৮টি বহুতল ভবন ভাঙার নির্দেশনা থাকলেও তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। এ দ্বীপের দৈর্ঘ্য প্রায় ৮ কিলোমিটার, প্রস্থ কোথাও ৭ কিলোমিটার আবার কোথাও ২ কিলোমিটার। দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমে দিকে রয়েছে প্রবাল প্রাচীর এবং শেষ মাথায় সরু লেজের মতো ছেঁড়াদ্বীপ নামে আরেকটি অবিছিন্ন দ্বীপ রয়েছে ।

এখানে সব হোটেল-কটেজ ইটের ভবন হলেও এখানকার মানুষের বেশির ভাগের ঘরবাড়িই ছনপাতা-পলিথিন দিয়ে তৈরি। স্থানীয়রা কি তাহলে এখানকার পর্যটন-অর্থনীতির সুবিধাভোগী নয়? এমন প্রশ্নের জবাবে সেন্টমার্টিন দ্বীপের সাবেক চেয়ারম্যান মাস্টার শামসুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পর্যটকরা সেন্ট মার্টিনে ভ্রমণে গেলে যে আয় হয়, তা স্থানীয়দের পকেটে যায় না। যারা ওইসব রেস্টুরেন্ট-হোটেলের মালিক, তারাই সব সুবিধা নিয়ে নেন। এখানকার ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগই বহিরাগত।’

তিনি বলেন, ‘মুষ্টিমেয় লোকের হাতে পর্যটন অর্থনীতি জিম্মি হয়ে আছে। তাই অধিবাসীরা এর সুযোগ-সুবিধা থেকে অনেকটাই বঞ্চিত। দ্বীপ বাঁচলেই হবে পর্যটন। তাই এখান থেকে বহুতল ভবন উচ্ছেদ না করলে এ দ্বীপ হারিয়ে যাবে।’ তবে পর্যটন সমৃদ্ধ হলেও যোগাযোগ, চিকিৎসা, শিক্ষা, নিরাপত্তাসহ মৌলিক অনেক সমস্যা রয়েছে বলে জানান তিনি।

পরিবেশ অধিদফতর সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে সেন্টমার্টিনে পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া গড়ে ওঠা ৪টি হোটেল চিহ্নিত করা হয়েছে। এর আগে গত বছর মে মাসে ১০৪টি আবাসিক হোটেল চিহ্নিত করা হয়েছিল। এর মধ্যে তিনতলা ও দোতলাসহ ৩৮টি আবাসিক হোটেল ভেঙে তা সরিয়ে নিতে মালিকপক্ষকে লিখিতভাবে নোটিশ দেওয়া হয় গত বছর। নোটিশে গত ২০ মের মধ্যে নিজ দায়িত্বে এসব হোটেল সরিয়ে নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ওই নোটিশের বিপক্ষে আদালতে আপিল করে হোটেল মালিকপক্ষ। এখন আদালতের মাধ্যমে আইনি লড়াই করে হোটেল ভেঙে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। হোটেলগুলোর মধ্যে রয়েছে- ব্রু-মেরিন, ফ্যান্টাসি, অবকাশ পর্যটন লিমিটেড, লাবিবা বিলাস, সেন্ডশোর, প্রসাদ প্যারাডাইস, প্রিন্স হেভেন, স্বপ্ন-বিলাস, সেভেন স্টার, ব্রু-সি ইস্টার্ন রিসোর্ট, সি ইন, ডাক বাংলা, ওশান ব্রু, সি ভিউ, সি-প্রবাল, সি টি বি ও এস কে ডিস প্রভৃতি।

হোটেল ব্রু-মেরিনের পরিচালক মনসুর আহমেদ বলেন, ‘পরিবেশ অধিদফতরের একটি নোটিশের কথা শুনেছি। তবে এ বিষয়ে হোটেলের ঢাকা অফিস বিস্তারিত বলতে পারবে। ‘

কক্সবাজার পরিবেশ সংস্থা ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) গত বছরে শুরুতে সেন্টমার্টিনের হোটেল-রিসোর্টের ওপর একটি জরিপ করে। সে জরিপে নির্মাণাধীনসহ ১০৬টি হোটেল-রিসোর্টের বিস্তারিত তালিকা প্রকাশ করা হয়। তারা সে সময় কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালককে একটি আবেদন জমা দেয়।

আবেদনে তারা জানায়, আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও সেন্টমার্টিন প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় প্রতিদিন গড়ে উঠছে হোটেল-মোটেলসহ নানা স্থাপনা। বেসরকারি স্থাপনার পাশাপাশি চলছে সরকারি স্থাপনার কাজও। পাশাপাশি অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন সেন্টমার্টিন দ্বীপের সৌন্দর্য, পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পর্যটকের অবাধ চলাচলের কারণে দ্বীপের কাঁকড়ার প্রজনন কমে গেছে। অপরিকল্পিত পয়ঃনিষ্কাশন এবং যত্রতত্র আবর্জনা ফেলে পানি ও মাটিদূষণের কারণে এখানকার জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। বর্তমানে এ দ্বীপে ৮ হাজারের বেশি মানুষের বসবাস। তার ওপর পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার পর্যটক দ্বীপে যাচ্ছেন। যত না মানুষ তার চেয়ে বেশি রিসোর্ট। দ্বীপের ভারসাম্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখেই অপরিকল্পিতভাবে ইট-পাথরের দালান গড়ে উঠেছে। উঁচু ভবন নির্মাণের জন্য প্রবাল খুঁড়ে মাটি বের করা হয়েছিল। অবাধে আহরণ হচ্ছে শামুক-ঝিনুক-পাথর। সৈকতসংলগ্ন এলাকায় হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও দোকান নির্মাণের জন্য কেয়াবন ও ঝোপঝাড় ধ্বংস করা হচ্ছে। এছাড়া হোটেলে চলা জেনারেটরের আওয়াজে দ্বীপে চলছে শব্দদূষণ। যে যেভাবে পারছেন, দ্বীপে ঘুরছেন। পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণহীন। মানুষের অতিরিক্ত চাপে পানি ও পরিবেশদূষণে হুমকিতে দ্বীপের প্রায় ৬৮ প্রজাতির প্রবাল।

কক্সবাজারের পরিবেশবিষয়ক সংস্থা ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) প্রধান নির্বাহী এম ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, ‘পর্যটনের জন্য বিশ্বের কাছে সেন্টমার্টিনের পরিচিতি প্রবাল দ্বীপ হিসেবে । এ দ্বীপকে রক্ষা করতে হলে প্রথমে এখানকার ইটের দালানকোঠা উচ্ছেদ করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘পরিবেশ অধিদফতরের সুপারিশসহ সেন্টমার্টিনে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ৩৮টি আবাসিক হোটেল ভাঙার নির্দেশ দেওয়া এক বছর পেরিয়ে গেলেও তা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। পাশাপাশি দ্বীপে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার।’

সেন্টমার্টিন দ্বীপের চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ‘দু’ শ’ বছর ধরে এ দ্বীপে মানুষের বসতি, তাই এসব মানুষের কথা চিন্তা করে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সিন্ধান্ত নিতে হবে। দ্বীপ রক্ষায় যা করার প্রয়োজন সব করতে প্রস্তুত এখানকার মানুষ। তারাও চাই না বহুতল ভবন। এসব ভবনের জন্য আজ দ্বীপের এ দুরবস্থা, ভবন না থাকলে দ্বীপ রক্ষা পাবে।’ তিনিও এসব ভবন উচ্ছেদের দাবি জানান।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রবিউল হাসান বলেন, ‘প্রবাল দ্বীপ নিয়ে সরকার নতুন করে কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছে। আগে থেকে যেসব ভবন ভাঙার নির্দেশনা ছিল, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করার চেষ্টাও চলছে।’

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আশরাফুল আফসার বলেন, ‘দ্বীপে রাতযাপন নিষিদ্ধ দ্রুত বাস্তবায়ন হবে। ভ্রমণকারীদের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে অনলাইনে আবেদন করে যেতে হবে। দ্বীপে দিনে কতজন ভ্রমণে যাবে, তারা সেখানে কী কী নিয়ে যেতে পারবে তাও মনিটরিং করা হবে।’

অবৈধ ভবন সরিয়ে নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দ্বীপ নিয়ে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা আছে। এটি সময় সাপেক্ষ। সেখানে যত জমিজমা আছে সরকার অধিগ্রহণ করে নিয়ে নেবে এবং অধিবাসীদেরকে টেকনাফ অথবা অন্য কোথায় সরিয়ে নেওয়া হবে। দ্বীপ রক্ষায় যা যা দরকার সরকার তাই করবে। বৃহস্পতিবার ২৬ অক্টোবর থেকে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল শুরু হচ্ছে।’

পাঠকের মতামত