উখিয়া নিউজ ডটকম
প্রকাশিত: ০১/১২/২০২৫ ৮:৪৪ এএম

ইব্রাহিম খলিল মামুন, কক্সবাজার::
অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত কচ্ছপের ডিম পাড়ার মৌসুম। গত মৌসুমে সৈকত থেকে ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল তিন হাজার ৫০০। ২০২০ সাল পর্যন্ত কচ্ছপ বছরে ১০ হাজারের বেশি ডিম পাড়ত। কিন্তু চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ডিম দিতে কোনো কচ্ছপ সৈকতে আসেনি। এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যাচ্ছে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়া দ্বীপের সংকটাপন্ন পরিবেশের কথা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় লোকজন জানান, সোনাদিয়া দ্বীপে গত এক মাসে ঝাউগাছ কেটে এবং বন বিভাগের জমি দখল করে অন্তত ১৫টি কটেজ ও রিসোর্ট নির্মাণ করা হয়েছে। আরও কয়েকটির নির্মাণকাজ চলছে। তারা জানান, গভীর রাত পর্যন্ত দ্বীপে আলোকসজ্জা, লোকজনের হইচই ও বিকট শব্দে গানবাজনার কারণে ডিম পাড়তে আসতে পারছে না মা কচ্ছপ।

সোনাদিয়ায় কাজ করা নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম) কক্সবাজারের ব্যবস্থাপক আবদুল কাইয়ুম জানান, নির্জন এই দ্বীপে পর্যটকের আনাগোনা, সৈকতে রাতে আলোকসজ্জা, উচ্চ শব্দে বাদ্যযন্ত্র বাজানো, নির্বিচারে ঝাউগাছ কেটে কটেজ ও রিসোর্ট বানানো এবং রাত যাপনের কারণে পরিবেশের এমন দুরবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

কক্সবাজারের পরিবেশ সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির (ইয়েস) তথ্যমতে, সোনাদিয়া দ্বীপের অন্তত ৭০ একর সরকারি জমি অবৈধভাবে দখল করে ১৫টি কটেজ ও রিসোর্ট নির্মাণ করা হয়েছে। এসব জমির গাছও কেটে ফেলা হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কয়েকজন নেতা দখল-বাণিজ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

কক্সবাজার শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় ছোট্ট দ্বীপ সোনাদিয়া। আয়তন প্রায় ৯ বর্গকিলোমিটার। দ্বীপের পূর্ব পাশে মগচরে গিয়ে দেখা যায়, সৈকতের তীরে প্রায় পাঁচ একর ঝাউবন ঘিরে গড়ে তোলা হয়েছে স্যান্ডি বিচ রিসোর্ট। বাঁশ ও কাঠ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ছোট ছোট পাঁচটি কটেজ। পুরো এলাকায় রংবেরঙের বিদ্যুতের বাল্ব দিয়ে সাজানো হয়েছে রিসোর্ট।

রিসোর্টের মালিক মোহাম্মদ ফারুক জানান, কক্সবাজার শহরের কয়েকজন ব্যবসায়ীসহ চারজন মিলে তারা এটি নির্মাণ করেছেন। আগামী এক মাসের মধ্যে আরও দুটি কটেজ নির্মাণ করা হবে। ইতোমধ্যে ১০ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। বর্তমানে এ রিসোর্টে ১০০ জন থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। নির্মাণকাজ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো বাধা আসেনি। ডিসেম্বর মাসে ১৭ দিনের বুকিং হয়ে গেছে।

এর পূর্ব পাশে আরেকটি রিসোর্ট ক্যাম্প ফায়ার সোনাদিয়া নির্মাণ করা হয়েছে। শামীম ও রাকিব নামে দুই ব্যক্তি এ রিসোর্ট নির্মাণ করেছেন।

দ্বীপের পশ্চিমপাড়ায় ঘাট থেকে ওঠার পরই দেখা গেছে কটেজ স্যান্ডি হিল বিচ সোনাদিয়া। পারভেজ এ কটেজ নির্মাণ করেছেন। এর দক্ষিণ পাশে সৈকতের তীরে নির্মাণ করা হয়েছে কটেজ মেরিনা ডি সোনাদিয়া। করিম মিয়া ও শফিক মিয়া এটি নির্মাণ করেছেন। এটি নির্মাণে রাজশাহীর এক ব্যক্তি অর্থ দিয়েছেন বলে জানান কাজে জড়িত রুহুল আমিন।

পরিবেশ ধ্বংসের শাস্তি কী
পরিবেশ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখা যায়, দেশের ১৩টি প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার (ইসিএ) একটি সোনাদিয়া দ্বীপ। এ দ্বীপের পানি, মাটি, বায়ু বা প্রাণীর ক্ষতি করে এমন কোনো কাজ করা যাবে না। এ কারণে সেখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণে ছাড়পত্র দেয় না পরিবেশ অধিদপ্তর। ইসিএ লঙ্ঘনের শাস্তি পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে নির্ধারিত। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (১৯৯৫) এবং ২০১০ সালে এর সংশোধনী অনুযায়ী, পরিবেশদূষণ করলে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদণ্ড বা তিন লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে। পরিবেশ আদালত আইন, ২০১০ অনুযায়ী এই শাস্তি আরও কঠোর হতে পারে। সেখানে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড ও পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।

সোনাদিয়া দ্বীপে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ ঠেকানোর কাজটি জেলা, উপজেলা প্রশাসন ও বন বিভাগের। প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে দ্বীপটি রক্ষার দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। দ্বীপে রয়েছে বন বিভাগের একটি বিট অফিস। কিন্তু সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে দ্বীপটিতে নির্মাণসামগ্রী নেওয়া হয়, নির্মাণকাজ চলে, পর্যটকরা যান, ব্যবসা হয়– কেউ বাধা দেয় না।

পরিবেশ সংগঠন ইয়েসের অ্যাডভোকেট মুজিবুল হক সমকালকে বলেন, অনিয়ন্ত্রিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ, বিপুল সংখ্যক পর্যটক গমন ও পরিবেশদূষণে দ্বীপটি সেন্টমার্টিনের মতো সংকটাপন্ন হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া দ্বীপে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা, প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট ও কটেজ-রিসোর্টের বর্জ্য ফেলা হয়। বড় উদ্বেগের দিক হলো, দ্বীপে ঝাউগাছ উজাড় করে হোটেল-রিসোর্ট নির্মিত হচ্ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর জেলা কার্যালয়ের পরিচালক মো. জমির উদ্দিন সমকালকে বলেন, সোনাদিয়া দ্বীপটি সরকার ঘোষিত ইসিএ। এ কারণে সেখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দেয়নি অধিদপ্তর। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি কটেজ নির্মাণ করা হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। খবর নিয়ে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ভূমি বন্দোবস্ত ও বাতিল
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে ইকো-ট্যুরিজম পার্ক গড়ে তোলার শর্তে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) এক হাজার এক টাকা সেলামিতে দ্বীপের ৯ হাজার ৪৬৭ একর ভূমি বরাদ্দ দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। তখন দেশের বৃহত্তম ইকো-ট্যুরিজম পার্ক গড়ার জন্য মহাপরিকল্পনা হাতে নেয় বেজা। ভারতীয় প্রতিষ্ঠান মাহিন্দ্র ইঞ্জিনিয়ারিংকে মহাপরিকল্পনা তৈরির কাজ দেয়। ইকোপার্কের জন্য জমি দেওয়ার পর সোনাদিয়া দ্বীপে গাছ কাটা, চিংড়ি ঘের নির্মাণসহ বিভিন্ন পরিবেশবিধ্বংসী কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। এর ফলে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের অনুরোধে বেজাকে দেওয়া বন্দোবস্ত বাতিল করে ভূমি মন্ত্রণালয়। গত ৫ মে ভূমি মন্ত্রণালয়ের খাসজমি-২ শাখার উপসচিব মাসুদ কামালের সই করা স্মারকে এ তথ্য জানানো হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বেজার অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া সোনাদিয়ার জমি বন বিভাগের অনুকূলে হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বেজার পরিচালক (বিনিয়োগ উন্নয়ন ও মনিটরিং) শাহীন আক্তার জেলা প্রশাসককে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছেন।

এ জমি এখনও বন বিভাগের অনুকূলে ন্যস্ত করা হয়নি জানিয়ে উপকূলীয় বন বিভাগের গোরকঘাটা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আইয়ুব আলী বলেন, সোনাদিয়া দ্বীপ নিয়ে গত ২৪ নভেম্বর মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়েছি। চিঠিতে বলা হয়েছে, বন্দোবস্ত বাতিল করা জমিগুলো এখনও গেজেট নোটিফিকেশন না হওয়ায় ইসিএ এলাকা হিসেবে গণ্য হবে। তাই জমিগুলো ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে বন বিভাগ ব্যবস্থা নিতে পারছে না। তার পরও দ্বীপের অবৈধ স্থাপনার তালিকা তৈরির কাজ করছি।

এ বিষয়ে মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. হেদায়েত উল্যাহ্ সমকালকে বলেন, সোনাদিয়া দ্বীপে কয়েক দিন আগে অবৈধ স্থাপনার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছি। আগামীতে আবার করব।

সেন্টমার্টিন বন্ধের প্রভাব সোনাদিয়ায়
সোনাদিয়া ক্যাম্পেই কটেজের মালিক গিয়াসউদ্দিন সমকালকে বলেন, নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ, কম সময়ে যাতায়াতের ব্যবস্থার পাশাপাশি সেন্টমার্টিন কয়েক মাস বন্ধ থাকায় সোনাদিয়া দ্বীপে পর্যটকের যাতায়াত বেড়েছে। পর্যটকের জন্য দ্বীপের কটেজগুলোতে দুটি প্যাকেজ রয়েছে– একটি এক হাজার টাকা, অন্যটি এক হাজার ২০০ টাকা।

কয়েকজন পর্যটক অভিযোগ করেন, রাতে বার-বি-কিউ পার্টি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মিলিয়ে জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকাও নিচ্ছে কটেজ-রিসোর্ট মালিকরা।

মহেশখালী স্পিডবোট মালিক সমিতির সভাপতি আতা উল্লাহ বোখারী বলেন, কক্সবাজার শহর থেকে স্পিডবোটে সোনাদিয়া দ্বীপে যাওয়া যায়। দিনে চার/পাঁচটি (প্রতিটিতে সর্বোচ্চ ১০ জন) বোট যায়। তবে ছুটির দিনে এই সংখ্যা বেড়ে যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কটেজ মালিক জানান, প্রতি মাসে প্রায় এক হাজার পর্যটক সোনাদিয়া দ্বীপে যাতায়াত করেন। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি রাতযাপন করেন, বিশেষ করে বিভিন্ন দিবসের পাশাপাশি সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পর্যটকের যাতায়াত বাড়ে।

জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ দ্বীপ
ছোট-বড় খালসমৃদ্ধ এই দ্বীপের আরও একটি নাম প্যারাদ্বীপ। তিনদিকে সমুদ্র ঘেরা এই চরাঞ্চলের বিশেষত্ব হচ্ছে ম্যানগ্রোভ বন এবং দুর্লভ জীববৈচিত্র্য। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে সৈকতে লাল কাঁকড়ার বিচরণ। শীতকালে বিপন্ন সামুদ্রিক কাছিমগুলো সাগরলতায় ঢাকা বালিয়াড়িতে আসে ডিম পাড়ার জন্য।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, একসময় এই দ্বীপে ছিল ৫৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৫২ প্রজাতির শামুক, ২১ প্রজাতির কাঁকড়া, ৯ প্রজাতির চিংড়ি, ২০৭ প্রজাতির মাছ, ১২ প্রজাতির উভচর, ১৯ প্রজাতির সরীসৃপ ও ২০৬ প্রজাতির পাখির অভয়ারণ্য

পাঠকের মতামত

সেন্টমার্টিনে রাত্রি যাপনের সুযোগ দুই মাস, মানতে হবে ১২ নির্দেশনা

দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে পুনরায় চালু হচ্ছে কক্সবাজার–সেন্টমার্টিন রুটে পর্যটকবাহী জাহাজ ...