ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ১৫/০৭/২০২৫ ৮:২৩ এএম

রায়হান রাশেদ
মানবজাতির দ্বিতীয় পিতা নুহ (আ.)। তিনিই প্রথম রাসুল। তাঁর সময়ে ঘটিত প্লাবনের পর যেসব বিশ্বাসী মানুষ বেঁচে ছিলেন, তাঁরা তাঁরই বংশধর। তাঁদের বেশির ভাগ ছিলেন তাঁরই পরিজনের অন্তর্ভুক্ত।

পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং তাঁর বংশধরদেরই আমি অবশিষ্ট রেখেছিলাম।’ (সুরা : সাফফাত, আয়াত : ৭৭)
সৃষ্টির প্রভাত থেকেই মানুষ এক আল্লাহর ইবাদত করেছে। একত্ববাদের ওপর অবিচল থেকেছে। সময়ের পরিক্রমায় শয়তানের প্ররোচনায় মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায়।

একত্ববাদের বিশ্বাস আর স্লোগান থেকে দূরে সরে যায়। শুরু করে মূর্তিপূজা। এভাবে কেটে যায় অনেক বছর। একসময় পাপাচারে ভরে ওঠে পৃথিবী।
আল্লাহর নাম নেওয়ার মতো তেমন মানুষই পাওয়া গেল না কোথাও। আল্লাহ তাদের হেদায়েত করতে চাইলেন। পাঠালেন নবী ও রাসুল নুহ (আ.)-কে। তিনি সম্প্রদায়ের লোকদের আল্লাহর পথে ডাকলেন। একত্ববাদের বিশ্বাস লালন করতে বললেন।

মূর্তিপূজা ছাড়ার আহবান জানালেন। (সুরা : হুদ, আয়াত : ২৫-২৬)
নুহ (আ.)-এর জাতির লোকেরা ছিল একরোখা, অহংকারী, মন্দ স্বভাব, পাপাচারী ও সীমা লঙ্ঘনকারী। তারা নবীকে প্রত্যাখ্যান করল। ঈমান তো আনেনি; বরং তাঁর ওপর অত্যাচার শুরু করল। বিভিন্ন ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে সীমা লঙ্ঘন করছিল। কখনো তারা পথে-ঘাটে তাঁকে পাগল বা উন্মাদ বলে বেড়াত। কখনো মাটির ওপর শুইয়ে গলা চেপে ধরত। তিনি অজ্ঞান হয়ে যেতেন। তার পরও তিনি একত্ববাদের দাওয়াত দিয়ে চললেন। সাড়ে ৯০০ বছর এভাবে দাওয়াত দিলেন। তেমন কাজ হয়নি। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ ছাড়া বেশির ভাগই তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করেনি। (তাফসিরে মাআরিফুল কোরআন, মাওলানা মুহাম্মাদ ইদরিস কান্ধলভি, অনুবাদ : আব্দুল্লাহ আল ফারুক, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-৩১৪ ও ৩২৩)

নুহ (আ.)-এর স্ত্রীর নাম ছিল ওয়াগেলা। (তাফসিরে কুরতুবির সূত্রে তাফসিরে মারেফুল কোরআন, মুফতি মুহাম্মাদ শফি, অনুবাদ : মাওলানা মুহিউদ্দিন খান, পৃষ্ঠা-১৩৮৯)

তিনি তাকে একত্ববাদের দাওয়াত দেন। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের কথা বলেন। সে স্বামীর কথা মেনে নেয়নি। বরং তার বিরোধিতা করল। অহংকার করল। মানুষের গোপনে ঈমান আনার কথা সমাজের প্রভাবশালীদের কাছে ফাঁস করে দিল সে। নুহ (আ.) সম্পর্কে জনসমাজে বলল, সে পাগল, তোমরা তাঁর কথায় কান দিয়ো না। (তাফসিরুল মাওয়ারদি, আবুল হাসান আল মাওয়ারদি, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৪৬-৪৭; তাফসিরে ইবনে কাসির, খণ্ড-১১, পৃষ্ঠা-১৯৪)

এসব কিছুর মধ্যেও নুহ (আ.) দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছিলেন। লোকেরা বিরক্ত হয়ে বলল, আমাদের সঙ্গে কলহ-বিবাদ কোরো না; পারলে তোমার প্রভুর শাস্তি নিয়ে এসো। নবী কাফিরদের জন্য আল্লাহর কাছে শাস্তির দোয়া করলেন। আল্লাহ তাঁকে নৌকা তৈরির নির্দেশ দিলেন। তিনি নৌকা তৈরি করলেন। কাফিররা নৌকা তৈরির ব্যাপার নিয়ে তাঁর সঙ্গে ঠাট্টা করত। শাস্তির দিন ঘনিয়ে এলো। একদিন ভূগর্ভ থেকে পানি উথলিয়ে উঠল। নুহ নবী বিশ্বাসীদের নিয়ে নৌকায় চড়লেন। আসমান থেকে পানি বর্ষণ শুরু হলো। জমিনের ফোয়ারাগুলো পূর্ণমাত্রায় উথলিয়ে উঠল। শুরু হলো মহাপ্লাবন। বিশ্বাসীরা বেঁচে গেল। অবিশ্বাসীরা পানিতে ডুবে মরল।

(সুরা : হুদ, আয়াত : ৩২-৪৪; সুরা কাসাসুল কোরআন, মাওলানা হিফজুর রহমান, অনুবাদ : আব্দুস সাত্তার আইনী, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৯)

নুহ (আ.)-এর স্ত্রী ওয়াগেলা আমৃত্যু কুফুরির ওপর অবিচল ছিল। সে নবীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে একত্রে বসবাস, একসঙ্গে ওঠাবসা সত্ত্বেও ঈমান আনতে সম্মত হয়নি। নবীর স্ত্রী হয়েও তার ভাগ্যে ঈমানের মহাদৌলত জোটেনি। সেও পানিতে ডুবে মরল। জাহান্নামি হয়ে গেল। আল্লাহ বলেন, ‘যারা কুফুরির (অবিশ্বাস) নীতি অবলম্বন করে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ নুহের স্ত্রী আর লুতের স্ত্রীর দৃষ্টান্ত পেশ করছেন। এরা ছিল আমার দুই নেককার বান্দার অধীনে। কিন্তু তারা দুজনেই তাদের স্বামীদ্বয়ের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ফলে নুহ ও লুত তাদের আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারল না। তাদের বলা হলো, তোমরা দুজন জাহান্নামে প্রবেশ করো (অন্যান্য) প্রবেশকারীদের সঙ্গে।’

(সুরা : তাহরিম, আয়াত : ১০)

এ আয়াতে আল্লাহ নুহ (আ.)-এর স্ত্রীর অবস্থান সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিবৃতি প্রদান করেছেন। আয়াতে খিয়ানত দ্বারা উদ্দেশ্য, দ্বিনের ব্যাপারে খিয়ানত করা। নুহ (আ.)-এর স্ত্রী মানুষকে বলে বেড়াত, তার স্বামী একজন বিকারগ্রস্ত লোক। অথবা সেই যুগের শাসকদের কাছে গোপনে তথ্য পাচার করত, যারা নুহ (আ.)-এর দাওয়াতে ঈমান আনত তাদের তালিকা পৌঁছে দিত। বৈবাহিক অধিকারের ব্যাপারে খিয়ানত করেছেন—এমনটি এখানে উদ্দেশ্য নয়।

(আল-মারআতু ফিল কাসাসুল কোরআনি, আহমাদ আশ-শারকাবি, খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৪৩)

ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘কোনো নবীপত্নী কখনো ব্যভিচারে লিপ্ত হননি। তাঁদের খিয়ানত ছিল ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে।’ (প্রাগুক্ত)

নুহ (আ.)-এর স্ত্রীর উচিত ছিল, সবার আগে তাঁর ওপর ঈমান আনা। কারণ, সে ছিল তাঁর সবচেয়ে কাছের মানুষ। তাঁর সম্পর্কে সে সবচেয়ে ভালো জানত। কিন্তু সমাজে প্রতিষ্ঠিত ভ্রষ্টতা থেকে সে বের হতে পারেনি। কুফুরিকে আমৃত্যু লালন করেছে সে। ফলে তাকেও জাহান্নামে ছুড়ে ফেলা হলো।

(আশ-শাখসিইয়াতুন নিসায়িইয়াহ ফিল কিসসাতিল কুরআনিইয়া, হুদা আব্দুল লতিফ, পৃষ্ঠা-২৮৩)

কোনো কোনো আলেম বলেছেন, ‘মহাপ্লাবনের আগেই নুহ (আ.)-এর স্ত্রী মারা গিয়েছিল।’

[নুহ (আ.) ওয়া কাওমুহু ফিল কোরআনিল মাজিদ, আল-মাইদানি, পৃষ্ঠা-৩১০]

নুহ (আ.)-এর স্ত্রীর জাহান্নামে প্রবেশ করা অবশ্যম্ভাবী। নবী তার কোনো উপকার করতে পারবে না। কিয়ামত দিবসে সে জাহান্নামের অধিবাসী হবে।

[নুহ (আ.) ওয়া কাওমুহু ফিল কোরআনিল মাজিদ, আল-মাইদানি, পৃষ্ঠা-৩১০]

ঈমান ও আকিদার ব্যাপারে আল্লাহ কারো সঙ্গে কোনো ধরনের আপস করেন না। নুহ (আ.)-এর স্ত্রীর ব্যাপারে তিনি যদি সুপারিশ করেনও তবু গ্রহণ করা হবে না। (ফি জিলালিল কোরআন, সাইয়িদ কুতুব, খণ্ড-৬, পৃষ্ঠা-৩৬২১)

লেখক : আলেম ও সাংবাদিক

পাঠকের মতামত

স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিবাদ-বিচ্ছেদ লাগানো নিয়ে যা বলেছেন মহানবী (সা.)

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মান-অভিমান, মনোমালিন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে বর্তমানে অনেকে ব্যক্তিগত স্বার্থ, নিজের পছন্দ-অপছন্দ ও ব্যক্তি ...