
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় লাখ লাখ রোহিঙ্গা। সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের হত্যা, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, নারীদের ধর্ষণসহ নানা ধরনের নিষ্ঠুর নিপীড়ন চালায়। রাজ্যটিতে এখনও সেনা অভিযান চলছে।
কেবল রাখাইন নয়; দেশটির শান, কাচিনসহ অন্যান্য প্রদেশও অশান্ত হয়ে উঠেছে। সেখানে জাতিগত সংখ্যালঘু বিদ্রোহীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দফায় দফায় সংঘর্ষ চলছে।
বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী শান প্রদেশে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। যার ধারাবাহিকতায় প্রায়ই প্রদেশটির ওইসব বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তবে এবারের সংঘর্ষের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাচ্ছেন প্রদেশটিতে বসবাস করা সাধারণ মানুষ।
সর্বশেষ গত এক সপ্তাহে প্রদেশটিতে সেনাবাহিনী ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষে ৩০ সেনা নিহত হওয়ার খবর এসেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
স্থানীয় তিনটি সরকারবিরোধী বিদ্রোহী সংগঠনের জোট ‘নর্দান অ্যালায়েন্স’ সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি অভিজাত কলেজসহ আরও কয়েকটি স্থানে হামলা চালিয়ে এক ডজনের বেশি মানুষকে হত্যা করে। ওই হামলার পর সেনাবাহিনী পাল্টা অভিযান শুরু করলে অঞ্চলটিতে উত্তেজনা শুরু হয়।
চলমান সংঘর্ষের কারণে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে প্রদেশজুড়ে। ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন ২ হাজারেরও বেশি মানুষ। তারা বিভিন্ন মঠে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
নর্দান অ্যালায়েন্স মূলত দেশটির বিচ্ছিন্নতাবাদী তিনটি গোষ্ঠীর জোট। তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) ছাড়াও আরাকান আর্মি (এএ) ও মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) এই জোটের সদস্য।
শান প্রদেশে স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার জাতিগোষ্ঠীগুলো এসব সশস্ত্র সংগঠনের মাধ্যমে তাদের কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। ২০১৮ সালের ২১ ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ৭ আগস্ট পর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাদের ৪৩২ বার সংঘর্ষ হয়েছে। এর মধ্যে আরাকান আর্মির সঙ্গে ৩৪৫ বার, টিএনএলএ’র সঙ্গে ৬২ বার এবং এমএনডিএএ’র সঙ্গে ২৫ বার সংঘর্ষ হয়েছে।
মিয়ানমার সরকার এই সংগঠনগুলোকে ‘জঙ্গিগোষ্ঠী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
২০১৬ সালে নির্বাচনে বড় জয় নিয়ে ক্ষমতায় আসেন অং সান সু চি। সেসময় তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আদিবাসী সংখ্যালঘু গেরিলা দল, সেনাবাহিনী ও বেসামরিক সরকারের মধ্যে শান্তি আলোচনা শুরুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে সু চি সরকার ওই প্রতিশ্রুতি পূরণের কোনো উদ্যোগই নেয়নি।
তবে নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হওয়ায় পর টিএনএলএ, এমএনডিএএ ও আরাকান আর্মির সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনী আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছে। ৩১ আগস্ট সেনাবাহিনীর একটি প্রতিনিধি দল শান্তি আলোচনার জন্য নর্দান অ্যালায়েন্সের সঙ্গে বসবে বলে জানিয়েছে মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতি।
শান প্রদেশে শান্তি প্রক্রিয়ার ব্যাপারে চীন এগিয়ে এসেছে। বেইজিং মনে করছে, সীমান্তে স্থিতিশীলতা ও শান্তি এলে দুই দেশই লাভবান হবে।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং ফেডারেল পলিটিক্যাল নেগোসিয়েশন অ্যান্ড কনসালটেটিভ কমিটির (এফপিএনসিসি) সদস্যদের মধ্যে শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতার ব্যাপারে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এর আগে, এফপিএনসিসির সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাজি হয়নি। সম্প্রতি তারা এএ, টিএনএলএ এবং এমএনডিএএ’র সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।
তবে গত সপ্তাহে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমার পিস কমিশন এএ, টিএনএলএ এবং এমএনডিএএ’র সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অংশ নিতে রাজি হয়েছে।
অনেকেই মনে করছেন, চীন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং দেশটির জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলোর (ইএও) মধ্যে শান্তি আলোচনার ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করতে পারলে উত্তরাঞ্চলীয় শান ও আরাকান প্রদেশে সংঘাতের ইতি টানা সম্ভব।
পাঠকের মতামত