জসিম উদ্দিন টিপু,টেকনাফ::
টেকনাফের দুর্গম পাহাড়ী জনপদ হোয়াইক্যংয়ের কম্বনিয়াপাড়া গ্রামে ১ম বারের মত গভীর নলকুপে পানি পাওয়া গেছে। দুর্গম পাহাড়ী গ্রামটিতে প্রথম বারের মত নলকুপে পানি পাওয়ায় স্থানীয়দের মাঝে বাড়তি আনন্দ দেখা দিয়েছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, উত্তরপাড়া, কম্বনিয়াপাড়া, ডেইলপাড়া, পাহাড়তলী ও বুড়িরপইরপাড়াসহ ছোট্ট ছোট্ট ৫টি এলাকা নিয়ে কম্বনিয়া গ্রাম। গ্রামটিতে প্রায় ৫হাজার মানুষের বসবাস রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। প্রাচীণকাল থেকে গত মৌসুম পর্যন্ত এখানকার মানুষের পানির উৎস ছিল পাহাড়ী ঝর্ণা, পাতকুয়া, পুকুর ও ছরা। এই সব উৎস থেকে সংগৃহীত পানি দিয়ে কম্বনিয়া গ্রামের মানুষ চাহিদা মেটাতো। সেই থেকে এই পর্যন্ত এখানকার মানুষের সুপেয় পানির বন্দোবস্ত ছিলোনা। গ্রামটিতে সুপেয় পানি বলতে ছিলো পাহাড়ী ঝর্ণা। আর গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছরা এবং পুকুরের পানি নিত্য ব্যবহার্য কাজে ব্যবহার করতো। বেশ কয়েকবছর আগে কম্বনিয়াপাড়ার মানুষের খাবার পানির যোগান দিতে ইউনিয়ন পরিষদের সার্বিক সহযোগীতায় উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বেশ কয়েকটি পাতকুয়া খনন করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলে স্থানীয়রা জানান। বর্ষা মৌসুম ছাড়া বাকী সব মৌসুমে এসব পাতকুয়া একেবারেই শুকিয়ে যায়। এছাড়া গ্রামটির আশেপাশের এলাকায়ও পানির সংকট থাকায় পাশ্ববর্তী গ্রাম মহেশখালীয়াপাড়া থেকে ওয়াটার সংযোগের মাধ্যমে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করার একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছিল স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ। একটি এনজিও সংস্থার মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কথা থাকলেও। পরবর্তীতে স্থানীয়দের বাঁধার মুখে উক্ত প্রকল্প শুরু করাও সম্ভব হয়নি বলে ইউপি সুত্র জানায়।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, সুপেয় পানির উৎস না থাকলেও কম্বনিয়াপাড়া গ্রাম উপজেলার অন্যতম সবজ্বি উৎপাদনশীল গ্রাম। গ্রামটির সিংহভাগ মানুষ কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ক্ষেতখামার করে জীবন সংসার চালান এখানকার মানুষ। তবে উপজেলার অন্যান্য এলাকার চেয়ে কম্বনিয়াপাড়া অনুন্নত এবং উন্নয়ন বঞ্চিত একটি গ্রাম। সবজ্বির যোগান দিলেও গ্রামটির মানুষ এতদিন সুপেয় পানির উৎস থেকে বঞ্চিত ছিলো।
এলাকাবাসী জানায়, কম্বনিয়াতে লেয়ার পাওয়া যায়না অজুহাতে এখানে অতীতে কোন ধরণের গভীর নলকুপ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। চলতি মৌসুমে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ২০২৪-২০২৫ ইং অর্থবছরে বাস্তবায়িত “সমুগ্রদেশ নিরাপদ পানি প্রকল্প" এর আওতায় কম্বনিয়াপাড়া প্রামে প্রথমবারের মত একটি গভীর নলকুপ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ঝুঁকি নিয়ে গভীর নলকুপ স্থাপন করতে গিয়েই সফল হয়েছেন। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ কম্বনিয়াপাড়ায় পানির যথেষ্ট লিয়ার পেয়েছেন। যা গভীর নলকুপ স্থাপনের জন্য বেশ উপযোগী। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের লোকজনের সাথে কথা বলে জানাগেছে, মাটির স্তর পরিবর্তন হওয়ায় এখানে আর আগের মত সমস্যা হবেনা। আশা করা যাচ্ছে,এখানে সামনে থেকে পানির উৎসে গভীর নলকুপ স্থাপন করা যাবে। তাতে স্থানীয়দের সুপেয় পানির দুর্ভোগ লাঘব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কম্বনিয়া গ্রামের ডেইলপাড়া এলাকার গৃহিনী মিনারা বেগম জানান, পাহাড়ী ঝর্ণা ও ছরা থেকে পানি সংগ্রহ করে বাড়ীতে রেখে দিতাম। পরে সময় ক্ষেপণ করে উক্ত পানি খাবার পানি হিসেবে ব্যবহার করেই আসছিলাম। চলতি মাস থেকে দূরে হলেও নতুন এই নলকুপ থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করছি।
উত্তরপাড়া এলাকার মনোয়ার বেগম জানান,পুকুর এবং পাশের ঝর্ণা থেকে সংগ্রহকৃত পানি খাবার পানি হিসেবে সংরক্ষণ করেছি আসছি। এতবছর ওই পানিই ব্যবহারের পাশাপাশি খাবার পানি হিসেবেও খেয়ে আসছি। গ্রামে একটি গভীর নলকুপ স্থাপন করায় গৃহিনী মনোয়ারা উপজেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
কম্বনিয়াপাড়া এলাকার কৃষক বাছা মিয়া জানান,জীবনের শেষ প্রান্তে শেষে আমাদের গ্রামে টিউবওয়েলের পানি দেখেছি। প্রাচীণকাল থেকে কম্বনিয়াপাড়া গ্রামে টিউবওয়েলে পানি পাওয়া যায়না বলে একটা রেওয়াজ ছিল। মাসে খানিক আগে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহযোগীতায় সরকারীভাবে একটি গভীর নলকুপ স্থাপন করা হয়েছে। যা থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পাওয়া যাচ্ছে। গ্রামের প্রায় এলাকার নারীরা এই নলকুপ থেকে পানি সংগ্রাহ করছেন জানিয়ে এই কৃষক ইউএনও এবং পাবলিক হেলথ্ ইঞ্জিনিয়ারকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
ছাত্র অধিকার পরিষদের কক্সবাজার জেলা সাধারণ সম্পাদক ও জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সেনানী ছাত্রনেতা ইউনুছ মুহাম্মদ মামুন জানান,কম্বনিয়াপাড়া গ্রামে গভীর নলকুপ স্থাপনে সফলতা পেয়ে উপজেলা প্রশাসন প্রথমবারের মত চমক দেখিয়েছেন। দুর্গম কম্বনিয়াপাড়াসহ আরো অন্যান্য পাহাড়ী জনপদে সুপেয় পানির সুবিধার্থে পরিকল্পিতভাবে গভীর নলকুপ স্থাপনের জন্য দাবী জানিয়েছেন জুলাই আন্দোলনের এই নেতা।
হোয়াইক্যং মডেল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মাওলানা নুর আহমদ আনোয়ারী জানান, পরীক্ষামূলকভাবে দেখা গেছে অতীতে কম্বনিয়াপাড়ায় লেয়ার ছিলোনা। লেয়ার না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে সংস্থা ব্যাক্তির উদ্যোগে গভীর নলকুপ স্থাপনের উদ্যোগ নেননি। চলতি সনে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ঝুঁকি নিয়ে গভীর নলকুপ স্থাপনের কাজটি করে প্রথমবারের মতো সফল হয়েছেন। স্থাপিত গভীর নলকুপে পর্যাপ্ত পরিমাণে লেয়ার পাওয়ার খবরে তিনি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় পুর্বক উপজেলা প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। চলতি মৌসুমে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে ওই এলাকার মানুষের সুপেয় পানির বন্দোবস্তের জন্য ৫টি রিংওয়েল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সামনে (পরবর্তী মৌসুম) থেকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর তথা সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগে গভীর নলকুপ স্থাপনের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন চেয়ারম্যান আনোয়ারী।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফারুক হোসাইন জানান, টেকনাফের বিভিন্ন জায়গায় সুপেয় পানির ব্যাপক অভাব রয়েছে। এর মধ্যে হোয়াইক্যং কম্বনিয়াপড়া গ্রাম অন্যতম। গ্রামটিতে প্রাচীণকাল থেকে কোন সুপেয় পানির বন্দোবস্তই ছিলোনা। আশেপাশের ২/৩কি: মি: এলাকাতেও কোন সুপেয় পানির উৎস নেই। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে কম্বনিয়াপাড়া গ্রামে প্রথমবারের মতো গভীর নলকুপ স্থাপন করতে পেরে আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আগামীতে সরকারীভাবে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের উদ্যোগে সুপেয় পানির জন্য গভীর-অগভীর নলকুপ এবং রিংওয়েলের আবেদন করতে তিনি (জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী) দালাল বা প্রতারক দিয়ে নয়; সংশ্লিষ্ট সকলকে ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে যোগাযোগের কথা জানান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহেছান উদ্দিন জানান,অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দুর্গম এবং অবহেলিত এলাকায় সুপেয় পানির ব্যবস্থা করণার্থে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কাজ করবে। কেবলমাত্র নির্ধারিত ফি: জমাদান সাপেক্ষ্যে সম্পূর্ণ সরকারী খরচে সুপেয় পানির উৎস সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হয় জানিয়ে ইউএনও আরো বলেন,জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ উপজেলার কোন দপ্তরেই অনিয়ম দুর্নীতি এবং দালালদের প্রশ্রয় দেওয়া হবেনা।##