১৯৯৭ সালে মিয়ানমারের মংডু থেকে পালিয়ে এসে কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয় রোহিঙ্গা নারী সুরুজ জামানের পরিবার।
সুরুজের প্রথম সন্তান তৈয়বা আক্তার অবৈধ উপায়ে তৈরি করেছেন বাংলাদেশি পাসপোর্ট, আর সেই পাসপোর্টে তিনি নিয়মিত অবাধে মালেয়শিয়া যাতায়াত করছেন।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটি সহ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তৈয়বার রয়েছে একাধিক স্বামী। এছাড়াও 'বিয়ে' করার নামে অভিনব প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অসংখ্য বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা যুবক'কে তিনি করেছেন নিঃস্ব।
কে এই তৈয়বা?
[caption id="attachment_171573" align="aligncenter" width="640"] রোহিঙ্গা ফ্যামিলি কার্ড[/caption]
উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে 'রোহিঙ্গা সুন্দরী মালয়েশিয়ান তৈয়বা' নামে ব্যাপক আলোচিত এই নারী, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য প্রদত্ত এমআরসি কার্ড (শরণার্থী পারিবারিক প্রত্যায়ন পত্র) এর তথ্যানুযায়ী উখিয়ার কুতুপালং নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের (কুতুপালং আরসি) বি-ব্লকের বাসিন্দা।
এমআরসি নং- ১৮৫৭০ ক্রমিকের কার্ডটির তথ্য বলছে, ঐ ব্লকের ৪১ নং শেডে বাস করা তৈয়বা আক্তারের জন্ম তারিখ ১ জানুয়ারি ১৯৯৪।
এছাড়া কার্ডটিতে তৈয়বার মা সুরুজ জামান ও ভাই নুরুল আফসার সহ পরিবারের ৫ সদস্যের তথ্য রয়েছে।
ঢাকাপোস্টের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৬ বছর আগে মালেয়শিয়া প্রবাসী এক রোহিঙ্গা যুবকের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে কুয়ালালামপুরে পাড়ি জমান তৈয়বা।
সেই যুবকের সাথে বিচ্ছেদের পর অন্তত ৬ জন কে তিনি বিয়ে করেছেন এছাড়াও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে বিয়ের আশ্বাসে আরো ৭/৮ জন যুবকের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন বিপুল অংকের অর্থ।
তৈয়বার এক প্রতিবেশী বলেন, ' সে মালয়েশিয়ায় থাকে মাস ছয়েক পর কিংবা বছর ঘুরে এখানে বেড়াতে আসে, সেখানে এক ছেলে তাকে বিয়ে করে নিয়ে গিয়েছিলো পরে শুনেছি তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায় এখন নাকি নতুন বিয়ে করেছে। তবে তার আসল স্বামীকে আমরা জানি না, সে খুব বিলাসী চলাফেরা করে ।'
[caption id="attachment_171574" align="aligncenter" width="640"] বাংলাদেশি পাসপোর্ট[/caption]
রোহিঙ্গা হয়েও কিভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেলেন তৈয়বা?
এই নারীর বর্তমান ব্যবহৃত বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর হচ্ছে - ইএম০১৮৯৮৮৪। ২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর ইস্যুকৃত সেই পাসপোর্টের তথ্যানুযায়ী, তৈয়বার ঠিকানা নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার ভূঁইয়ারহাটের চন্দ্রসুদ্দি গ্রামে।
পাসপোর্টে বাবার নাম লেখা হয়েছে বাবুল মিয়া ও তার আসল মা সুরুজ জামান হলেও মায়ের নাম লেখা আছে আমেনা খাতুন । এছাড়াও স্বামীর নামের স্থলে আছে দাদন মিয়া এবং জরুরি যোগাযোগের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে - ৩৬ পুরানা পল্টন,ঢাকা জিপিও, পল্টন, ঢাকা।
এমআরসি কার্ডের সাথে প্রায় ৫ বছর ব্যবধান রেখে পাসপোর্টে জন্ম তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১০ মার্চ ১৯৯৯ এবং প্রদত্ত জন্ম নিবন্ধন নং- ১৯৯৯১৯২০৯০৪০০০৯৪২।
[caption id="attachment_171575" align="aligncenter" width="640"] ভিসার তথ্য[/caption]
বাস্তবে তৈয়বার এই পরিচয় সম্পূর্ণ ভূয়া বলে তার মুল ঠিকানা কুতুপালং নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। পাশাপাশি এমআরসি কার্ডে প্রদত্ত ছবি ও পাসপোর্টের ছবির মধ্যে তৈয়বার মুখমন্ডলের যথেষ্ট মিল পরিলক্ষিত হয়েছে।
এছাড়াও প্রতিবেদকের হাতে তৈয়বার ব্যবহৃত আরো একটি পুরাতন পাসপোর্ট (ইবি০৫১২৯৩০) এর স্ক্যান কপি সংরক্ষিত আছে।
১৯৭৩ এর পাসপোর্ট আইন অনুযায়ী, শুধুমাত্র বাংলাদেশের নাগরিকরাই বৈধভাবে পাসপোর্ট পেতে পারেন এবং বিদেশি বা শরণার্থী (যেমন রোহিঙ্গা) কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়ার যোগ্য নন।
আইনের ১১ নং ধারায় বলা আছে, ভুয়া তথ্য দিয়ে বা মিথ্যা পরিচয় দিয়ে পাসপোর্ট নেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যার শাস্তি সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা, অথবা উভয়ই হতে পারে।
রোহিঙ্গা যুবক আতিকের ২০ লাখ টাকা আত্মসাৎ
২ বছর আগে মুঠোফোনে তৈয়বার পরিচয় ঘটে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ২৫ বছর বয়সী তরুণ মোহাম্মদ আতিকের সাথে,নিয়মিত যোগাযোগের মধ্যে তৈরি হয় প্রেমের সম্পর্ক।
আতিককে বিয়ে করে মালয়েশিয়া নিয়ে যাবেন জানিয়ে বিভিন্ন সময়ে তার কাছ থেকে তৈয়বা হাতিয়ে নেন বিপুল অর্থ।
একপর্যায়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তৈয়বা, নিজের সবটুকু হারিয়ে নিঃস্ব আতিক জানতে পারেন এই নারী একজন প্রতারক।
কান্নাজড়িত কন্ঠে তিনি ঢাকাপোস্টকে বলেন, ' আমি তাকে বিশ্বাস করে ভালোবেসেছি, যখন যা চেয়েছে দিয়েছি। সে আমার কাছ থেকে কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা নিয়েছে, অনেক স্বপ্ন ছিলো সংসার করবো মালয়েশিয়ায় নতুন জীবন গড়বো। কিন্তু সে একটা প্রতারক বলে পরে জানতে পেরেছি৷ দুই মাস আগে বাংলাদেশে সে এসেছে শুনে অনেক চেষ্টা করেও টাকা ফেরত পাইনি।' (অডিও সংরক্ষিত)
আতিক দাবী করেন, 'মালয়েশিয়ায় তার অনেক স্বামী আছে সে কিছুদিন পর আবারো সেখানে চলে যাবে। আমার মতো অনেকের সাথে একই কাজ করেছে এবং করতে থাকবে কারণ এটা তার পেশা।আল্লাহ তার বিচার করবে।' (অডিও সংরক্ষিত)
মালয়েশিয়ায় 'অবৈধ' বিয়ে বাণিজ্য
বিয়ের নামে প্রতারণায় সিদ্ধহস্ত রোহিঙ্গা তরুণী তৈয়বার হাতে প্রতারিত আতিক ছাড়াও আরো কয়েকজন ভুক্তভোগী তরুণের অভিযোগ মিলেছে যারা মালয়েশিয়ায় বাস করেন। প্রতারিতদের মধ্যে রোহিঙ্গা ছাড়াও আছেন বাংলাদেশি, কানাডিয়ান,পাকিস্তানি নাগরিক।
২০১৯ সালের শেষের দিকে রোহিঙ্গা যুবক সালামতউল্লাহর সাথে পরিচয়ের পর ধর্মীয়ভাবে তৈয়বার বিয়ে হয়।
কুয়ালালামপুরের শহরতলীতে সবজি-ফল এর দোকান নিয়ে ভালোই জীবন যাচ্ছিলো সালামতের, কিন্তু তৈয়বার ফাঁদে পড়ে হারাতে হয় ব্যবসা থেকে শুরু করে কষ্টার্জিত সব অর্থ।
মুঠোফোনে সালামত উল্লাহ ঢাকাপোস্ট'কে বলেন, ' পরিবারের জন্য পাঠাতে হবে, জমি কিনতে হবে মিথ্যা তালবাহানা করে মাত্র ১ বছরের সংসার জীবনে সে আমার ৩০ লক্ষ টাকার বেশি ক্ষতি করেছে। আমি বিশ্বাস করে ঠকেছি, সব হারিয়ে কোনো রকমে বেচে আছি।' (অডিও সংরক্ষিত)
কানাডা প্রবাসী রহিমউল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গা যুবককে মালয়েশিয়ায় বিয়ের কথা বলে নিয়ে আসেন তৈয়বা।
রহিমউল্লাহর এক বন্ধু বলেন,' তৈয়বার প্রলোভনে পড়ে রহিমউল্লাহ স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে মালেয়শিয়া গিয়েছিলেন। হোটেলে অবৈধভাবে অবস্থান করে রহিমের ভিডিও ধারণ করে তৈয়বা তাকে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকলে সে বিপুল টাকা দিয়ে কানাডা ফিরে যায়। একই কাজ এক পাকিস্তানির সাথেও করেছে বলে শুনেছি।'
এছাড়াও অনুসন্ধানে মেহেদী নামে এক বাংলাদেশি তরুণের তথ্য পাওয়া গেছে যিনিও তৈয়বার হাতে একইরুপে প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
মালয়েশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি ব্যবসায়ি আমিনুল হাকিম বলেন, ' অবৈধভাবে বিয়ে বাণিজ্য করে অসংখ্য যুবকভাইদের তৈয়বা নামের রোহিঙ্গা নারী মালয়েশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণা করে বেড়াচ্ছে। সে খুব চতুর, অপকর্মে ঢাকতে এখানে বারবার স্থান পরিবর্তন করে। তার শাস্তি হওয়া উচিত যেনো সে কখনো মালয়েশিয়া আসতে না পারে।'
অবৈধ পাসপোর্ট থেকেও কেনো অধরা এই রোহিঙ্গা নারী?
ঢাকার উত্তরা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট করতে এসে ২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ধরা পড়েন হতিজা আক্তার নামে এক রোহিঙ্গা নারী।
হতিজা সে সময় পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিলেন , ' মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী এক ছেলের সঙ্গে তাঁর প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। ওই ছেলের পরামর্শে পাসপোর্ট তৈরি করে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। '
গত ২৭ আগস্ট ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট করতে এসে ধরা পড়েন এক রোহিঙ্গা নারী।
এনআইডি ও অন্যান্য কাগজপত্র জমা দিলেও শেষ পর্যন্ত বায়োমেট্রিক যাচাইয়ের সময় তার আসল পরিচয় প্রকাশ পায়। এসময় আটককৃত নারীর স্বামী পরিচয় দেওয়া বাংলাদেশি যুবক মেজবাহকেও আটক করা হয়।
এরপর দিন ২৮ আগস্ট চট্টগ্রামে ভুয়া তথ্য ব্যবহার করে পাসপোর্ট করতে যাওয়া দুই রোহিঙ্গা নাগরিককে আটক করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
পাসপোর্ট করতে গিয়ে এসব রোহিঙ্গারা ধরা পড়লেও অবৈধভাবে পাসপোর্ট বানিয়ে ফেলতে সক্ষম হওয়া তৈয়বারা রয়ে যাচ্ছেন অধরা।
উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মীর সাহেদুল ইসলাম বলেন, ' বিগত সময় অনেক রোহিঙ্গা পাসপোর্ট এনআইডি দালালদের মাধ্যমে মোটা টাকায় বানিয়েছে। এখন সেই সুযোগ আর নেই, আমরা প্রতিটি তথ্য যাচাই করি খুব সূক্ষ্ণভাবে। অতীতে এসব অপকর্মে যারা জড়িত ছিলো তাদের আইন আওতায় আনা উচিত, একই সাথে অবৈধ পাসপোর্টগুলো শনাক্ত করে বাতিল করা উচিত বলে মনে করি।'
কক্সবাজার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোবারক হোসেন বলেন, 'আবেদনকারীদের সন্দেহ হলে তাদের কাগজপত্র যাচাই করতে গিয়ে জালিয়াতি ধরা পড়ে।আর দালালদের দৌরাত্ম্য অনেকাংশে এখন কমে এসেছে, আমরা এই বিষয়ে সতর্ক আছি।'
রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করার কোনো সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, 'আগে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রথা চালু ছিল, তাই পাসপোর্ট অফিস কর্তৃপক্ষের দায় ছিল কম; কিন্তু এখন সেটা না থাকায় পাসপোর্টের আবেদনকারীকে ভালো মতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়।'
যদি কেউ অবৈধভাবে অতীতে পাসপোর্ট বানিয়ে থাকে তাহলে তথ্য-প্রমাণ পেলে অবশ্যই তড়িৎ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
প্রতারণা ও পরিচয়পত্র জালিয়াতির অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে পাসপোর্টে থাকা তৈয়বার সাথে জরুরি যোগাযোগের নাম্বারে ফোন দেওয়া হলে অপর প্রান্ত থেকে 'ভুল নাম্বার' জানিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন অজ্ঞাত এক নারী। সুত্র, ঢাকাপোষ্ট