
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আলোচিত নবী হোসেন কারাগার থেকে বের হয়ে ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তার বাহিনীর রাজত্বে এখন রোহিঙ্গারা আবরো জীম্মি হয়ে পড়েছে।
তাদের রয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই শতাধিক সদস্যের বাহিনী। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শুধু আতঙ্কের নাম নবী হোসেন। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে মাদক, অস্ত্র পাচার, অপহরণ ও ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িত এই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাকে জীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এরপর আগস্টের ৩১ তারিখ গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় প্রশাসন।
মিয়ানমারের সন্ত্রাসী সংগঠন ‘নবী হোসেন গ্রুপের’ প্রধান নবী হোসেন (৪৭) ও তার ভাই সৈয়দ হোসেন ওরফে বুলুকে (৪৫) গ্রেপ্তার করেছিল আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। এসময় তাদের কাছ থেকে ২টি বিদেশি পিস্তল ও ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছিল। তবে সম্প্রতি তারা কারাগার থেকে বের হয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত সন্ত্রাসী নবী হোসেন মিয়ানমারের জান্তা সরকারের দীর্ঘদিনের একজন বিশ্বস্ত সহচর হিসাবে পরিচিতি রয়েছে তার।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবার বড় চালান পাচার করাই নবী হোসেনের প্রধান কাজ। সীমান্তের কাছাকাছি পাঁচটি ক্যাম্পে তার আসা-যাওয়া রয়েছে। দুই শতাধিক সক্রিয় সদস্য রয়েছে তার। মিয়ানমারের বিজিপির সহায়তায় সে দেশের এক নাগরিকের মাধ্যমে দিয়েছে চিংড়ির ঘের। ক্যাম্পে তার ৩০ সহযোগীর নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের মূল কাজ মাদক পাচার ও অর্থ লেনদেন। বছর তিনেক আগে রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) ছেড়ে ‘নসুরুল্লাহ নবী’ গ্রুপ তৈরি করে নবী হোসেন।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ দমনে কাজ করা গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে নবী হোসেনের অপরাধ কর্মকাণ্ড নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন ঢাকায় পাঠিয়েছি। আমাদের তদন্তে মিয়ানমার থেকে মাদকের বড় চালান পাচারের সঙ্গে জড়িত পাঁচটি ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী’ গ্রুপের নাম উঠে এসেছে। এর মধ্যে অন্যতম নবী হোসেন গ্রুপ। নদীপথে বেশিরভাগ মাদক চালান নবী হোসেনের হাত ধরে বাংলাদেশে আসে। মিয়ানমারে অবস্থান করলেও মাদক বাংলাদেশে নিয়ে আসে নবী। তার সহযোগীরা কেনাবেচা করে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়। একসময় আরএসও’র কমান্ডার ছিল নবী।’
অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৮ ইস্টে বসবাসকারী মোস্তাক আহমেদের ছেলে নবী হোসেন (৪৭) মিয়ানমারের মংডু ডেভুনিয়া তুমরা চাকমাপাড়ায় আরএসও কমান্ডারের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। সেখানে প্রতিপক্ষের দ্বন্দ্বে একটি হত্যা মামলার আসামি হয়ে ২০১২ সালে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমায়। সেখানে মাদ্রাসায় চাকরি নেয়।
২০১৭ সালের আগস্টে তার পরিবার বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এরপর নবী হোসেন কুতুপালংয়ে পরিবারের কাছে চলে আসে। সে সময় তাকে দলে নিতে চাপ দেয় আরসা। এতে রাজি না হলে ক্যাম্প ছাড়তে বাধ্য হয়। তখন মাদক চালানে জড়িয়ে পড়ে। এরপর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাহিনী গড়ে। ২০১৮ সালে মাদকের বড় চালান নিয়ে আসে বাংলাদেশে। এরপর থেকে ইয়াবার সব বড় চালান তার হাত ধরে দেশে আসছে। এখনও আরএসও’র কিছু নেতার সঙ্গে নীবর যোগাযোগ রয়েছে। ওপারে তার প্রশিক্ষণ সেন্টার আছে।
আরো জানা গেছে, পুলিশের লিস্টে থাকা এই সন্ত্রাসীর স্বজনরা ওই ক্যাম্পের বি-৪১ ব্লকে তালিকাভুক্ত হলেও নবী হোসেন কোনও ক্যাম্পে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। নবীর এক ভাই ভুলু মাঝি ক্যাম্প-৮ ইস্টে দায়িত্বে থাকাকালীন তাকে অপরাধ কর্মকাণ্ডে সহযোগিতা করার কারণে দায়িত্বে থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবে তার আরেক ভাই মো. কামাল ক্যাম্প ৮ ইস্টের বি-৪১ ব্লকের মাঝির দায়িত্ব পালন করছে। এছাড়া ক্যাম্প-৮ ইস্ট, ৯, ১০ ও ১৪ নম্বরসহ বিভিন্ন ক্যাম্পে দুই শতাধিক সক্রিয় সদস্য রয়েছে নবীর।
রোহিঙ্গা নেতাদের ভাষ্য, উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে নবী হোসেন গ্রুপের ২০০ সক্রিয় সদস্য আছে। এর মধ্যে নারী সদস্য আছে। তাদের মধ্যে কিছু সদস্যের বাংলাদেশ-মিয়ানমারে আসা-যাওয়া রয়েছে। তাদের মূল পেশা মাদক চালান এনে ক্যাম্পে মজুত ও বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেওয়া। এছাড়া সন্ত্রাসী ইসলাম ও মাস্টার মুন্না গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ আছে তার গ্রুপের।
নবী হোসেনের সক্রিয় সদস্যরা হলো-তার ভাই সৈয়দ হোসেন বুলু, মো. জোবাইর, বালুখালী ক্যাম্প-৯ এর হাবিব, আবদুল্লাহ, তাহের, ক্যাম্প-৮ এর নবী হোছন, কমান্ডার মোহাম্মদ সালাম, ক্যাম্প-৯ এর জিয়াবুল আলম, ক্যাম্প-৮ ই এর মো: সালাম উল্লেখযোগ্য।
পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে নবী হোসেন এবং তার সহযোগীদের নাম উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে নবী হোসেনকে মাদক পাচারের মূলহোতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
উখিয়া ক্যাম্পের ৮-ইস্টের বাসিন্দা এনাম বলেন, ‘আমরা নতুন করে এখন নবী হোসেনের গ্রুপের ভয়ে আছি। ক্যাম্পে নবী হোসেনের সদস্যরা ভিন্ন কৌশলে সক্রিয়। তার দলে নারীও আছে। সবার হাতে অস্ত্র আছে। তবে পুলিশের তৎপরতায় ইতোমধ্যে তার অনেক সহযোগী ক্যাম্প ছেড়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ৮ এপিবিএনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ক্যাম্পে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। নবী হোসেন মাদক ব্যবসায়ী এবং তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। তার প্রধান কাজ মিয়ানমার থেকে মাদক এনে বাংলাদেশে বিক্রি করা। একাধিক সংস্থা তার বিষয়ে কাজ করছে। তারাও প্রমাণ পেয়েছে। ইতোমধ্যে তার সহযোগীদের শনাক্ত করতে পেরেছি আমরা।’ সে কারাগার থেকে এসে আবারো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আশা রাখছি তাকে দ্রুত গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হব।
তিনি আরো বলেন, ‘নবী হোসেন ক্যাম্পে নজরদারিতে রয়েছে। তাকে আমরা খুঁজছি। তার গ্রুপ ও স্বজনদের নজরদারিতে রেখেছি। শুধু নবী হোসেন নয়, সব দুষ্কৃতকারীর বিরুদ্ধে তৎপর রয়েছি।
পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘কক্সবাজারের বড় সমস্যা এখন রোহিঙ্গা। আমাদের প্রতিনিয়ত প্রাণের ভয়ে থাকতে হয়। কারণ ক্যাম্পজুড়ে রয়েছে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র। দ্রুত সময়ে এসব অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা না হলে সামনে ভয়াবহ দিন আসবে।
পুলিশ বলছে, নবী ও তার গ্রুপের সঙ্গে ক্যাম্প-২২ (উনচিপ্রাং) এ একসময় আধিপত্য বিস্তারকারী ইসলাম গ্রুপের জিয়াবো, কালাপুতু, গুনাইয়া, রাইউল্লাহর সখ্যতা রয়েছে। ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর উখিয়া থানায় ডাকাতের প্রস্তুতিসহ অস্ত্রের মামলায় কারাভোগও করেছিল নবী। তিন বছর আগে আরএসও ছেড়ে বাহিনী গড়ে তোলে। কিছু সময় আরসা তাকে অর্থ সহায়তা দিতো। যখন থেকে অর্থ সহায়তা দেওয়া বন্ধ করা হয় তখন থেকে দ্বন্দ্ব শুরু হয়।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘যত বড় অপরাধী হোক ক্যাম্পে ঠাঁই হবে না। নবী হোসেনসহ সব অপরাধীকে ধরতে আমাদের অভিযান চলছে।’ কাউকে ছাড় দেওয়া হবেনা।
ক্যাম্পে বসবাসকারী অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নবী হোসেন ছিল আরএসও’র কমান্ডার। এখন আলাদা গ্রুপ রয়েছে তার। পাশাপাশি এখানে বেতনভুক্ত সোর্স হিসেবে তার সঙ্গে কাজ করছে অনেকে। এজন্য তাকে ধরা যায় না।’
তারা আরো জানান, নবী হোসেন মিয়ানমারের সন্ত্রাসী সংগঠন নবী হোসেন গ্রুপের প্রধান। তিনি মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ইয়াবা চোরাচালানের মূলহোতা বা গডফাদার হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের উখিয়া এবং টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় তার নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী রয়েছে। যার মাধ্যমে তিনি হত্যা, অপহরণ এবং ইয়াবা চোরাচালান করে থাকেন।
রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন প্রথম থেকেই বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে বাধা দিয়ে আসছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের সীমান্ত দিয়ে নবী হোসেন বাহিনী ইয়াবা পাচারের কাজে লাগিয়েছিল শত শত রোহিঙ্গাদের।
তদুপরি রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নবী হোসেনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড এত ব্যাপকতা লাভ করেছিল যে, তাকে কোনোভাবেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছিল না। এ কারণে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নবী হোসেনকে ধরতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে বিজিবি। তার বিরুদ্ধে বহু সংখ্যক হত্যা, মাদক ও ডাকাতি মামলা রয়েছে।
বর্তমানে তার অত্যাচারে ক্যাম্প ও ক্যাম্পের বাইরের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বহু মানুষ। উল্লেখ্য, নবী হোসেন ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদেরই একজন। পরে তিনি বিপুল পরিমাণ অস্ত্র এনে ক্যাম্পের ভেতর অপরাধ চক্র গড়ে তোলেন। জানা যায়, বালুখালী এলাকার চারটি ক্যাম্প নবী হোসেন বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। এ বাহিনী মাদক পাচার, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িত। বাংলাদেশে নবীর বিরুদ্ধে পাঁচটি হত্যা মামলাসহ ১২টি মামলা রয়েছে।
কুতুপালং ক্যাম্পের রহমান, আজিজ ও মকছুদ জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে প্রায়ই সহিংস ঘটনা ঘটছে। অতি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেও গোলাগুলি-খুনোখুনির মতো ঘটনা ঘটছে। এমন তথ্যও রয়েছে যে, ক্যাম্প অশান্ত করার জন্য সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে ইতঃপূর্বে বিনামূল্যে কোটি কোটি টাকার ইয়াবা দিয়েছে মিয়ানমার, যাতে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন রোধ করা যায়।
এছাড়া কক্সবাজার ও বান্দরবানের সীমান্তবর্তী নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তের শূন্যরেখা ও তোতার দ্বীয়া দ্বীপে জঙ্গি ঘাঁটি গড়ে ওঠার তথ্যও রয়েছে। বলা বাহুল্য, এ পরিস্থিতি দেশের জন্য মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে। কাজেই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের অত্যন্ত শক্ত হাতে দমন করা প্রয়োজন। বর্তমানে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্ট পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে থাকলে সন্ত্রাসী নবী হোসেনকে যেভাবেই হোক গ্রেফতার করতে হবে।
তিনি ও তার সদস্যের বাংলাদেশ-মিয়ানমারে আসা-যাওয়া রয়েছে। তাদের মূল পেশা মাদক চালান এনে ক্যাম্পে মজুত ও বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেওয়া।
######