আন্তর্জাতিক হুন্ডিচক্র টেকনাফের গফুর সিন্ডিকেট হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধভাবে বিদেশ ও ইয়াবার টাকা পাচার অব্যাহত রেখেছে। ৫ আগস্ট পরবর্তি বিদেশ ও সীমান্তের চিহ্নিত হুন্ডি গডফাদাররা আত্মগোপনে গেলেও অদৃশ্য কারনে হুন্ডি সম্রাট শাহপরীরদ্বীপ উত্তরপাড়ার মৃত এবাদুল হক এর ছেলে আবদুল গফুর দাপটের সঙ্গে এ কাজে জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চক্রের হোতা গফুরের রয়েছে দেশ বিদেশে ১০/১২ জনের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট।
সীমান্তের প্রভাবশালী এক সাবেক জনপ্রতিনিধি এবং ইয়াবা ডনের ছত্রছায়ায় থেকে টেকনাফের হুন্ডি সাম্রাজ্যের একক নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন এই হুন্ডি মাফিয়া চক্র। সৌদি প্রবাসী গফুর নামের ওই ব্যক্তি ৩০ বছর ধরে হুন্ডির কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। তার কারনে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে৷
এলাকার লোকজন জানান, একসময়ের অসহায় আবদুল গফুর মিয়ানমারের নাগরিক দেশের হুন্ডির শীর্ষ এজেন্ট মৌলভী বোরহান উদ্দিনের বোন বিয়ে করার পর তার কপাল খুলে যায়। বিয়ের পর সীমান্তে হুন্ডির লেনদেন নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একচেটিয়া দাপট দেখিয়ে কোটিপতি বনে যান। হুন্ডি সাম্রাজ্য নিয়ে তার বিরুদ্ধে কোন প্রশাসন ও স্থানীয় লোকজন প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। সেই গফুর আবার টেকনাফ বাস স্টেশনের দ্বীপ প্লাজা হোটেলের মালিকপক্ষের একজন। এই সুযোগে হোটেলের ঠিকানায় অফিসে বসে তার চক্রের লোকজন মিয়ানমারে টাকা পাচার, সৌদিআরব, দুবাই, কাতার, সিঙ্গাপুর ও মালেশিয়া থেকে সহজে টাকা আদান-প্রদান করে আসছে। গফুর তৎকালিন ক্ষমতাসীন টেকনাফ পৌরসভার মেয়র হাজী ইসলামের তালত ভাই হিসেবেও দাপট দেখিয়ে হুন্ডির সাম্রাজ্য ঠিকিয়ে রেখেছেন। আবার সেই গফুর টেকনাফে ১০২ জন ইয়াবা কারবারীর সাথে আত্মসমর্পণ করা সাবরাং ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা রেজাউল করিম রেজু মেম্বারের আপন ভাই। তার নাম ভাঙিয়ে প্রভাব বিস্তার করে নানান অপরাধ কর্মকান্ডও করে চলেছেন বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ রয়েছে।
খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীরদ্বীপ উত্তরপাড়ার মৃত এবাদুল হকের ছেলে আবদুল গফুর (৫৫) প্রশাসনের তালিকাভুক্ত একজন চিহ্নিত আন্তর্জাতিক হুন্ডি কারবারি। টেকনাফ সীমান্তের বহুল পরিচিত হুন্ডি কারবারি মৌলভী বোরহানের অধীনে দীর্ঘদিন ধরে গফুর হুন্ডি কারবার চালিয়ে আসছেন।
এ ব্যাপারে টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জায়েদ নুর বলেন-‘হুন্ডি কারবারি সবার বিরুদ্ধে প্রশাসনের নজরদারি রয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে। ওসি আরো বলেন, অপরাধী যেউ হোক আমরা কাউকে ছাড় দেব না।
টেকনাফে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিহ্নিত ১০২ ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণের পর আলোচনায় আসে সীমান্তের হুন্ডি কারবারিদের নামধাম। আত্মসমর্পণ করা ইয়াবা কারবারিরাই পুলিশের কাছে একে একে ২১ জন হুন্ডি সম্রাটের নাম পরিচয় প্রকাশ করেন। ইয়াবা কারবারিরা পুলিশকে জানান, ২১ জন বড় এবং ছোটখাট আরো মিলে কমপক্ষে অর্ধশত হুন্ডি কারবারি সীমান্তের পুরো ইয়াবা কারবারের টাকা লেনদেনের সঙ্গে জড়িত। সেখানে গফুরের নামও রয়েছে। স্বয়ং তার আপন ভাই রেজু মেম্বার হুন্ডি ব্যবসার কথা স্বীকার করেন।
তৎকালিন সময়ে ইয়াবা কারবারিরা এসব হুন্ডি কারবারিদের নাম পরিচয় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তারা সবাই গাঁ ঢাকা দেয়। এমনকি হুন্ডি কারবারি আলোচিত টিটি জাফরসহ আরো বড় মাপের কয়েকজন দেশ থেকে পালিয়ে দুবাই এবং সৌদি আরব পালিয়ে যান। টেকনাফ সীমান্তের হুন্ডি কারবারিরা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় ইয়াবা কারবারিরা বিপাকে পড়ে যান। তখন থেকে কিছু দুর্নীতিবাজ আমলা ও সুশীল নামধারী রাজনৈতিক নেতার আশ্রয়ে গফুর নামের এই ব্যক্তি তার চক্র হুন্ডির কারবার বন্ধ করেননি। এমনকি বেশ কিছুদিন ধরে কারবারি গফুর রয়েছেন একদম প্রকাশ্যে। তিনি সৌদি আরব থেকে নিয়মিত আসা যাওয়া করছে।
অভিযোগ রয়েছে, গফুর চক্র পুরো মধ্যপ্রাচ্য ও সীমান্তের পুরো হুন্ডি সাম্রাজ্যের এককভাবে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন।
অভিযোগ উঠেছে, সীমান্তের কিছু বিতর্কিত সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধির ছত্রছায়ায় থেকে দাপটের সঙ্গে গফুর হুন্ডি কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন। বিপদ-আপদ থেকে রক্ষার জন্য ওই জনপ্রতিনিধি গফুরের হুন্ডি ব্যবসার অংশীদার বলেও কথিত রয়েছে। তিনি ও তার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এলাকায় প্রকাশ্যে হুন্ডি কারবার পরিচালনা নিয়ে রয়েছে নানা কথাও। তার নিজস্ব ক্যাশিয়ার খ্যাত দ্বীপ প্লাজার ম্যানেজার লিটন সব দেখাশুনা করেন। লিটন দ্বীপ প্লাজায় বসে ইয়াবা ব্যবসাও পরিচালনা করে আসছে।
সর্বশেষ ২৮ অক্টোবর সেই হুন্ডি সম্রাট গফুর নিজে উপস্থিত হয়ে ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে তাদের পরিচালনাধীন হোটেল দ্বীপ প্লাজার দীর্ঘদিনের ভাড়াটিয়া আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দুলাল পাল ও তার ছেলে বর্তমান নয়াবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সুপন পালকে জীম্মি করে দোকান থেকে মারধর করে বের করে দেন। এসময় লুট করা হয় দোকানের মালামাল ও নগদ টাকা। এ ঘটনায় পুরো টেকনাফসহ দেশ বিদেশে নিন্দারঝড় বয়ে যাচ্ছে। নিন্দিত এ ঘটনার পর টেকনাফ থানার পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেও গফুরের অবৈধ টাকা লেনদেনের কারনে মামলা নিচ্ছেনা ওসি। আলোচিত গফুরের সাথে দোকানে হামলা লুটপাটে নেতৃত্ব দেন সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির আপন ভাগনী জামাই আরমান নামের আরেক প্রভাবশালী। দ্বীপ প্লাজার ৫০ জনের অধিক শেয়ারহোল্ডারদের ৩০ বছর ধরে জীম্মি রেখে গফুর ও বশির পুরো মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করতে তাদের অবৈধভাবে বের করে দিয়েছেন। যা অন্য শেয়ারহোল্ডাররা অনেকটা অবগত নন।
এ ব্যাপারে ভুক্তভোগী শিক্ষক সুপন পাল জানান, দ্বীপ প্লাজার ১ ও ২ নং দোকান ভাড়া নিয়ে আমরা দীর্ঘ ২২ বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করে আসছি। হঠাৎ বশির ও গফুর দোকান থেকে আমাদের চুক্তির নবায়ন থাকার পরেও কয়েকমাস ধরে মাসিক ভাড়া নিচ্ছেনা। যার কারনে আমি ডাকযোগে ভাড়ার টাকা প্রেরণ করি। সেই ঘটনার সুত্র ধরে প্রতিহিংসা করে আমার ৮০ বছরের বৃদ্ধ বাবাকে টেনেহিঁচড়ে দোকান থেকে বের করে দিয়ে তালা লাগিয়ে দেয়। এখন থানায় মামলাও নিচ্ছেনা তাদের টাকা ও প্রভাবের কারনে। তিনি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে সাংবাদিকদের জানান।
এ ঘটনার পর দ্বীপ প্লাজার অন্যান্য দোকান মালিকরা সংবাদ সম্মেলন করেছে। তাদের মধ্যে দোকান মালিক দিদার হোসেন বলেন, সম্পুর্ণ অন্যায়ভাবে দুলাল পাল ও সুপন পালকে মারধর করে দোকান দখলে নিয়েছে তারা। চাইলে উভয়পক্ষ বসে সমাধান করতে পারত।
এসব বিষয় নিয়ে আবদুল গফুরের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা দোকানের মালিক চুক্তি শেষ হয়েছে তাই দোকান নিয়ে ফেলছি। মারধর ও লুটপাটের বিষয়ে তিনি বলেন, দোকান আমরা নিতে গেলে তারা বিভিন্ন মিডিয়া ও মানুষ এনে আমাদেরকে বাধা সৃষ্টি করে। পরে আমাদের বিরুদ্ধে অনর্থক এসব অভিযোগ করতেছে। হুন্ডি ব্যবসার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি অস্বীকার করেন।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ডিএসডি (মিডিয়া ফোকাল পয়েন্ট) অলক বিশ্বাস বলেন, ঘটনার বিষয়টা অভিযোগসূত্রে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হুন্ডি চক্রের বিরুদ্ধে প্রশাসন সবসময় তৎপর রয়েছে।