জসিম উদ্দিন,যুগান্তর :
৪০০ টাকার একটি কোদালের দাম সাড়ে ৭ হাজার টাকা! অবিশ্বাস্য হলেও কক্সবাজারের পেকুয়ায় হতদরিদ্র শ্রমিকদের জন্য সরকারের বিশেষ কর্মসূচি ইজিপিপি নন-ওয়েজের বরাদ্দে এ ঘটনা ঘটেছে। ২ লাখ টাকার কোদাল-ঝুড়ি কিনে বরাদ্দের প্রায় সব টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণ হিসাবে কাগজপত্র উপস্থাপন করা হলেও উলটো লুটপাটের পক্ষে যুক্তি দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মঈনুল হোসেন চৌধুরী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পেকুয়ায় ইজিপিপি নন-ওয়েজের প্রায় ১৭ লাখ টাকা বরাদ্দ থেকে শ্রমিকদের জন্য দুই লাখ টাকার ঝুড়ি ও কোদাল কিনে বাকি ১৫ লাখ টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে ইউএনও মো. মঈনুল হোসেন চৌধুরী ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) আবু তাহেরের বিরুদ্ধে। তাদের দুজনের নেতৃত্বে পিআইও অফিসকেন্দ্রিক একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে সরকারি বরাদ্দ লুটপাটের মহোৎসবে মেতেছেন। শুধু তাই নয়, ইউএনও মঈনুলের বিরুদ্ধে সরকারি বরাদ্দ লুটপাটসহ আরও অভিযোগ রয়েছে।
বরাদ্দের কাগজে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পেকুয়া উপজেলার সাত ইউনিয়নের অতিদরিদ্রদের জন্য প্রাস (ইজিপিপি+) কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ইউএনওর অনুকূলে নন-ওয়েজের ১৬ লাখ ৭৮ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এসব বরাদ্দ কাগজে ঠিক থাকলেও বাস্তবে চিত্র ভিন্ন।
পেকুয়া উপজেলার সাত ইউনিয়নের ইজিপিপি প্রকল্পের ৬৩ জন শ্রমিকের মধ্যে অন্তত ৫৫ জন জানিয়েছেন, পেকুয়া সদর ইউনিয়নের শ্রমিকদের জন্য ৩৬টি কোদাল, ১৮৫টি ঝুড়ি, শিলখালী ইউনিয়নে ২৯টি কোদাল, ১০৪টি ঝুড়ি, বারবাকিয়া ইউনিয়নে ২৬টি কোদাল, ১০৪টি ঝুড়ি, মগনামা ইউনিয়নে ২৭টি কোদাল দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শ্রমিকরা পেয়েছেন ৬টি কোদাল ও ১৪২টি ঝুড়ি। উজানটিয়া ইউনিয়নের শ্রমিকরা কোদাল পাননি, তবে ঝুড়ি পেয়েছেন ১৩৪টি। টইটং ইউনিয়নে কোদাল ৩৯টি, ঝুড়ি ১২৬টি; রাজাখালী ইউনিয়নে কোদাল ৩৯টি, ঝুড়ি ৯৭টি দেওয়া হয়েছে। পুরো উপজেলায় কোদাল দেওয়া হয়েছে ১৯২টি ও ঝুড়ি ৮৯২টি।
উপকারভোগী মাঝিরা (শ্রমিক) জানান, এসব কোদাল ও ঝুড়ি তারা পিআইও অফিসের জিয়াবুল স্যারের কাছ থেকে নিয়েছেন। কিন্তু যাকে তারা ‘স্যার’ সম্বোধন করেন, তিনি পিআইও অফিসের উমেদার হিসাবে কাজ করেন।
বর্তমান এসব পণ্যের বাজার মূল্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একটি কোদালের মূল্য ৪০০ টাকা এবং প্রতিটি ঝুড়ির দাম ১৪০ টাকা। পুরো উপজেলায় ১৯২টি কোদালের বাজার মূল্য দাঁড়ায় ৭৬ হাজার টাকা এবং ৮৯২ ঝুড়ির মূল্য ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। ইউএনওর অনুকূলে বরাদ্দ ১৬ লাখ ৭৮ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। উপজেলার সাত ইউনিয়নে নন-ওয়েজ থেকে কোনো প্রকল্পও বাস্তবায়িত হয়নি। বাকি ১৫ লাখ টাকার খোঁজ মেলেনি।
৪০০ টাকার কোদালের দাম সাড়ে ৭ হাজার : ইউএনও মো. মঈনুল হোসেন চৌধুরীর দাবি অনুযায়ী, এসব কোদাল ও ঝুড়ি ‘কয়েক হাত ঘুরে কিনতে হয়েছে’, তাই দাম বেশি পড়েছে। তার হিসাব অনুযায়ী, ঝুড়ি ২৮০ টাকা ধরে ৮৯২টি কিনতে ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ৪৯ হাজার ৭৬০ টাকা। বাকি ১৪ লাখ ২৮ হাজার টাকায় ১৯২টি কোদাল কেনা হয়েছে দেখানো হয়েছে। ফলে প্রতিটি কোদালের ক্রয়মূল্য দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৭ হাজার টাকা।
স্থানীয়রা জানান, পেকুয়া উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে জিয়াবুল করিম ও মো. তানভীর উমেদার হিসাবে কাজ করছেন। তারা পিআইও অফিসের মূল কর্মী না হলেও ইউএনও ও পিআইওর পছন্দের লোক হওয়ায় সব কার্যক্রম তারা নিয়ন্ত্রণ করেন। এ দুজনের মাধ্যমে যাবতীয় লুটপাটের নথিপত্র তৈরি ও পরিচালিত হয়। এভাবে ইউএনও ও পিআইওসহ চারজনের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট সরকারি বরাদ্দকে লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পিআইও আবু তাহের প্রথমে বরাদ্দ হয়নি দাবি করেন। পরে ডকুমেন্ট পাঠানো হলে ফোন রিসিভ করেননি। তবে সংবাদ প্রকাশ ঠেকানোর চেষ্টা করেছেন।
লুটপাটের পক্ষে যুক্তি দিলেন ইউএনও : অভিযোগের তথ্য দেখানো হলে ইউএনও মো. মঈনুল হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘কোদাল-ঝুড়ি ঠিকঠাক বিতরণ হয়েছে, আমি ছবিতে তা দেখেছি। সরাসরি কিনতে পারিনি; ছয়-সাত হাত বদল হয়েছে। তাই দাম বেশি হয়েছে। তবে পরে সংবাদ প্রকাশ ঠেকাতে প্রতিবেদকের কাছে তদবির করেছেন অভিযুক্তরা।
বিষয়টি অবগত করে জানতে চাইলে কক্সবাজার নবাগত জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল মান্নান বলেন, ‘তথ্য যাচাই করে সত্যতা পাওয়া গেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’