মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি ও আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) মধ্যে চলমান সংঘাত, তীব্র খাদ্য সংকট ও দমন-পীড়নের কারণে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বাড়ছে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) তথ্যমতে, গত দেড় বছরে বাংলাদেশে নতুন করে আশ্রয় নিয়েছে অন্তত ১ লাখ ১৮ হাজার ৩১৬ জন রোহিঙ্গা। সূত্র জানায়-নাইক্ষ্যংছড়ি, উখিয়া ও টেকনাফের ২২টি সীমান্ত পয়েন্ট ব্যবহার করে এ অনুপ্রবেশ ঘটছে। শুধু সীমান্তবর্তী নয়, বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার, মহেশখালী, চট্টগ্রামের আনোয়ারা, বাঁশখালী ও পতেঙ্গা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে এই ঢল। শনিবার চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সৈকতের মুসলিমাবাদ বেড়িবাঁধ থেকে ৩৫ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে র্যাব।
সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি বলছে, কাঁটাতারহীন দুর্গম সীমান্তে প্রতিনিয়ত জীবন হাতে নিয়ে অভিযান চালানো সত্ত্বেও দালাল চক্র আর রোহিঙ্গা ঢল থামানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এদিকে প্রকাশিত সংবাদের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও মাদক পাচার রোধে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি ১২ মে জরুরি বিশেষ সভা ডেকেছে কক্সবাজারে।
রাখাইনে গোলাগুলি-সহিংসতা, বাংলাদেশে ঢোকার হিড়িক : রোহিঙ্গা সূত্রে জানা যায়, আরাকান আর্মি সম্প্রতি মংডু টাউনশিপ দখল করে সেখানে রোহিঙ্গা বসতির ওপর দমন শুরু করেছে। তাদের অভিযোগ, আরসাকে আশ্রয় দেওয়ার দায়ে রোহিঙ্গা নারীদের ঘরছাড়া করা হচ্ছে, পুরুষদের ধরে নিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক কাজে নিয়োজিত করা হচ্ছে।
পরিবারের আট সদস্য নিয়ে শালবন আশ্রয় শিবিরে সদ্য আসা রোহিঙ্গা আবদু রহমান বলেন, আরাকান আর্মি আমাদের ঘরবাড়ি দখল করে ধান-চাল লুট করে নিচ্ছে। ঘর থেকে ধরে নিয়ে কাজে লাগানো হচ্ছে। কেউ যদি পালিয়ে আসতে চায়, তাকে পথে ৫ হাজার কিয়াত ঘুস দিতে হচ্ছে। একই কথা বলছেন মিয়ানমার থেকে সদ্য আসা রোহিঙ্গা সলিম উদ্দিন, মো. হোসেন ও কামলাসহ আরও অনেকে। সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যানিটির সভাপতি রোহিঙ্গা নেতা ডা. মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংঘাত নতুন কিছু নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ঘরে ঘরে চলছে খাদ্য সংকট। রাখাইনের পরিস্থিতির উন্নতি না হলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো যাবে না। আর এ অবস্থায় প্রত্যাবাসন তো কল্পনাও করা যায় না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এই সংকট বাংলাদেশের জন্য আরও ভয়াবহ হবে।
২২ পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে বাংলাদেশে : সূত্র জানায়, নাফ নদীসহ মোট ২২টি পয়েন্ট দিয়ে রাতের আঁধারে ও ভোরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। বিশেষ করে নাইক্ষ্যংছড়ি, উখিয়া ও টেকনাফের ২২টি সীমান্ত পয়েন্ট ব্যবহার করে এ অনুপ্রবেশ ঘটছে। বিজিবি কক্সবাজার রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এমএম ইমরুল হাসান বলেন, মিয়ানমারে সংঘাত, নির্যাতন ও দমন-পীড়নের কারণে রোহিঙ্গারা দালালদের সহায়তায় রাতের আঁধারে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে। সীমান্তের অনেক স্থানে কাঁটাতার বা বাধা না থাকায় তা এখনো অরক্ষিত। এই সুযোগে রোহিঙ্গা ছাড়াও অবৈধ মালামাল পাচার চলছে। তিনি বলেন, বিজিবি সীমিত জনবল ও সরঞ্জাম নিয়ে দিন-রাত অভিযান চালাচ্ছে। অনেক সময় স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গারা অপরাধে যুক্ত থাকায় বিজিবিকে প্রতিপক্ষের মতো লড়তে হয়। তারপরও বিজিবি গুলি না চালিয়ে মানবিকতা বজায় রেখে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়। তিনি জানান-যানবাহন, অস্ত্র, নজরদারি প্রযুক্তি ও বাজেটের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও সীমান্ত সুরক্ষায় বিজিবি নিবেদিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে নতুন ব্যাটালিয়ন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ পুরোপুরি ঠেকাতে স্থানীয়দের সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, সামান্য লাভের জন্য অবৈধ অনুপ্রবেশে সহযোগিতা করলে দেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও বিপদে ফেলবে। তাই সবাইকে আরও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিজিবিকে সহায়তা করতে হবে।
সংবাদের পর উচ্চপর্যায়ের কমিটি : এদিকে যুগান্তরে সংবাদ প্রকাশের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও মাদক পাচার রোধে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) ও অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সোমবার দুপুরে বলেন,একটি জাতীয় পত্রিকার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে। ১২ মে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এ কমিটির বিশেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও মাদক পাচার রোধই এই কমিটির মূল উদ্দেশ্য। কারণ, মাদক পাচার বন্ধ না হলে রোহিঙ্গা ঢল বন্ধ করা যাবে না এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন কখনোই সম্ভব হবে না। এই উচ্চপর্যায়ের কমিটির আহ্বায়ক হিসাবে রয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেনটেটিভ ড. খলিলুর রহমান। কমিটিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের কর্মকর্তারা সদস্য হিসাবে রয়েছেন।
মিজানুর রহমান জানান, ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ১ মে পর্যন্ত বাংলাদেশে নতুন করে অনুপ্রবেশকারী ১ লাখ ১৫ হাজার রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন সম্পন্ন হয়েছে। স্থানীয় ও বিভিন্ন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী আরও প্রায় ৫ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের জন্য বর্তমানে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান করছে