বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতের শহর কক্সবাজার। ১৯৯৯ সালে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সমুদ্র সৈকতকে ইসিএ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। সেই আইন অনুযায়ী, সৈকতের জোয়ার-ভাটার অঞ্চল থেকে ৩০০ মিটার পর্যন্ত যেকোনো স্থাপনা নির্মাণ ও উন্নয়ন নিষিদ্ধ। কিন্তু এ আইন কেউ মানছেন না। এছাড়া এ আইন অনুযায়ী উচ্চ আদালত ২০১১ সালে সৈকতের বালিয়াড়িতে সকল স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেয়। সেই নির্দেশের আলোকে ২০২২ সালে প্রায় ৫ শতাধিক স্থাপনা উচ্ছেদ করে প্রশাসন।
তবে থেকে যায় আরো তিন শতাধিক স্থাপনা। সেই সব স্থাপনাও পরে উচ্ছেদের কথা ছিল। কিন্তু সে কথা রাখেনি প্রশাসন। পরে উচ্ছেদ হওয়া স্থাপনা আবারও নতুন করে তৈরি হয়ে যায়। আর এর মধ্যে এবার নতুন চুক্তি করে সৈকতে স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দিয়েছে জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেল।
ফলে সৈকতের বালিয়াড়ি দখল ও স্থাপনা নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক, লাবনী, সুগন্ধা, কলাতলী, দরিয়ানগর, হিমছড়ি, সোনারপাড়া, ইনানী,পাটুয়ারটেক ও টেকনাফ সৈকতে কয়েকশ দোকান-পাট ও স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে।
সম্প্রতি সৈকতের কলাতলী ও সুগন্ধা পয়েন্টে রাতারাতি শতাধিক দোকান তৈরি হয়েছে। বলা হচ্ছে , কক্সবাজার প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে বসানো হচ্ছে এসব দোকান।
এবিষয়ে বালিয়াড়ির দোকানদার মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, একটি খাবারের দোকানের জন্য জেলা প্রশাসনের বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির ব্যাংক একাউন্টে এবং এলআর ফান্ডের একাউন্টে টাকা জমা দিয়ে ব্যাংক স্লিপ সহ পর্যটন সেলে জমা দিতে হয়।
তবে অপর একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রক্রিয়া মত কার্ড পাওয়া যায় না। বছরের পর বছর আপনি বালিয়াড়িতে ব্যবসা করতে পারবেন কার্ড ভাড়া নিয়ে। কিন্তু আপনি যদি কার্ড নিজের নামে চান তবে এই টাকার সাথে আরো অতিরিক্ত টাকা গুণতে হবে আপনাকে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য বলছে, এবারের যেসব কার্ড নতুন করে অনুমোদন দেওয়া রয়েছে, তাদের অধিকাংশই বর্তমান সময়ে ক্ষমতাধর রাজনৈতিক, ছাত্র নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল।
বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি ও বালিয়াড়ি ভাড়া নেওয়া দোকানদারদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবনী পয়েন্ট থেকে কলাতলী মোড় পর্যন্ত দুরত্ব ১ কি.মি.। ৩০০ মিটারের কম প্রস্থের এই দুরত্বের বালিয়াড়িতে আগে থেকেই ৮৩০ টি চটপটি, ফুচকা, চা, ফিশ ফ্রাই, আচারের দোকান রয়েছে। এছাড়া একই দুরত্বের পথে ১ হাজারের ছাতা, চেয়ার, দুই শতাধিক টিউব, প্রায়ই সাড়ে ৪শ ফটোগ্রাফার, ৬০ টি বীচ বাইক ও ৬২ টি ওয়াটার বাইক রয়েছে। এছাড়া ডজন খানেক লকার, ২ টি বক্সার সহ ১ টি মিনি শিশু পার্ক রয়েছে। এই স্বল্প জায়গাতে গেল মাসের শেষ ভাগে নতুন করে আরো ৪ শতাধিক দোকান ও ৬ শতাধিক ছাতা চেয়ার বসানোর অনুমতি দিয়েছে পর্যটন সেল। এরই প্রেক্ষিতে গত ২৩ সেপ্টেম্বর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় থেকে সৈকতে বসানো অবৈধ দোকানপাট ও স্থাপনা উচ্ছেদ করতে জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এদিকে সমুদ্রসৈকতের ইসিএ এলাকা দখলমুক্ত করতে দুই সচিবসহ সরকারি আটজন কর্মকর্তাকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। তবুও উচ্ছেদ হয়নি স্থাপনা উল্টো আরো স্থাপনা অনুমোদন দেওয়ার পায়তারা করছে প্রশাসন।
সরেজমিনে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে গিয়ে দেখা যায়, লাবনী পয়েন্টের ট্যুরিষ্ট পুলিশ ভবনের বিপরীতে বালিয়াড়ি ঘেষেই পাবলিক টয়লেট। এর পাশ দিয়ে বালিয়াড়িতে পা দিলেই দেখা মিলে ৬/৭ টি খাবারের দোকান। দক্ষিণে কলাতলীর দিকে হাটতেই লাবনী পয়েন্টেই রয়েছে ২৫০ খাবার, ঝিনুকের দোকান। আরেকটু সামনে হাঁটলেই ট্যুরিষ্ট পুলিশ বক্সের পশ্চিমে ফের শামুক ঝিনুকের দোকান। অথচ এইখানেই রয়েছে ছাতা মার্কেট। বালিয়াড়ি ঘেষেই বিজিবির উর্মি রেষ্ট হাইজ ও রেষ্টুরেন্ট, এরপরই জলতরঙ্গ, তারপরে অল্প পরিমান ঝাউবন থাকলেও এরপরই বসানো হয়েছে নতুন করে ১১০টির মত টং দোকান, এরপর জেলা পরিষদের চেঞ্জিং রুম, এর পাশ ঘেঁষে মসজিদ। মসজিদ ঘেঁষেই সুগন্ধা পয়েন্টে সাড়ে ৫৫০ মত দোকান। এই দোকানের মাঝের ফাকাঁ জায়গায় বসানো হয়েঝে লকার, বক্সার সাথে অসংখ্য ভ্রাম্যমান হকার। এরপর কিছুটা বালিয়াড়ি ফাকা থাকলেও কলাতলীতে রয়েছে ৩০ টি দোকান সহ কয়েকটি রেষ্টুরেন্ট। এর ১ কিলোমিটার বালিয়াড়ির একদম সমুদ্র ঘেষে উত্তর-দক্ষিনে সারিবদ্ধভাবে বসানো হয়েছে হাজারো ছাতা চেয়ার। এছাড়া লাবনী পয়েন্টে সমুদ্রে দাপিয়ে পড়েছে ওয়াটার বাইক আর বালিয়াড়িতে বীচ বাইক।
কক্সবাজারের পরিবেশবাদি সংগঠন ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) এর প্রধান নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল মামুন বলেন, আদালত বলেছে উচ্ছেদ করতে আর প্রশাসন অনুমোদন দিয়ে নতুন দোকান বসানো যেন আজব এক কাণ্ড। উল্টো রথে চলছে কক্সবাজার । যাদের আইন প্রয়োগ করার কথা। তারাই ইসিএ আইন অমান্য করে ভাড়ায় দিচ্ছে বালিয়াড়ি।
ট্যুর অপারেটর এসোশিয়েশন অব কক্সবাজার (টুয়াক) আহবায়ক মিজানুর রহমান মিল্কী বলেন, 'কক্সবাজার সৈকতের বালিয়াড়ি দখল করে বিভিন্ন ধরনের দোকান বসানোর ফলে সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে পর্যটকরা সমুদ্র উপভোগে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন। সরকার এ এলাকাকে ইসিএ এলাকা ঘোষণা করেছে এবং হাইকোর্ট থেকেও বালিয়াড়ি দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে প্রশাসন উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার বদলে আরও দোকান বসানোর অনুমতিপত্র দিচ্ছে, যা হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করার পাশাপাশি পরিবেশ ও পর্যটনের ক্ষতি সাধন করছে।
তিনি বলেন, বিশ্বের কোনো দেশের সৈকতে বালিয়াড়ির ওপর বস্তির মতো দোকান বসানোর নজির নেই। তাই আমরা চাই, পর্যটকরা যেন নির্বিঘ্নে সমুদ্র উপভোগ করতে পারেন এবং ইসিএ ঘোষিত এলাকায় আইন অমান্য করে গড়ে ওঠা সব সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা দ্রুত উচ্ছেদ করা হয়। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতকে তার আগের প্রাকৃতিক রূপে ফিরিয়ে আনাই এখন সময়ের দাবী।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পর্যটন শাখার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আজিম খান বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মেনেই সব করা হয়েছে। যদি আমরা অনুমতি না দিতাম তবুও সেখানে লোকজন বসত। দখল হত। নতুন করে যে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা নয়। ২০০২ সাল থেকে এটি চলমান রয়েছে।
পুরাতন দোকানের পাশাপাশি এত নতুন দোকান অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, পুরাতন সবার কার্ড নবায়ন করা হয়নি। কাজেই হিসেব করলে দোকানের তেমন তারতম্য হবে না, তবে আগের তুলনায় কিছুটা বাড়বে।
সৈকতের বালিয়াড়িতে দোকানপাট বসানোর সুযোগ নেই জানিয়ে বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য সচিব রায়হান উদ্দিন বলেন, বালিয়াড়ি থেকে সমস্ত স্থাপনায় সরিয়ে নেওয়া হবে এটা নিশ্চিত থাকেন। তাদেরকে কার্ড বরাদ্দ দেওয়ার পর জায়গা দেখিয়ে দেওয়ার আগেই তারা নিজেদের মর্জি মাফিক বালিয়াড়িতে বসে গেছে।
ট্যুরিষ্ট পুলিশের কক্সবাজারের ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, জেলা প্রশাসন কার্ড দিয়েছে লাবনী, সুগন্ধা, কলাতলী বীচ লিখে। যেটা কোন অবস্থাতেই তারা পারেনা। আর তাদের সেই অনুমোদন পরিবেশ মন্ত্রনালয় প্রজ্ঞাপন দিয়ে বাতিল করেছে।
তিনি বলেন, সৈকতের সৌন্দর্য রক্ষার্থে ও পরিবেশের ভারসম্যের স্বার্থে বালিয়াড়িতে কোন ধরনের স্থাপনা থাকবে না। জেলা প্রশাসন যদি কোন ব্যবস্থা না নেয় তবে পুলিশ উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে বালিয়াড়িকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে এনে পর্যটক বান্ধব পরিবেশ তৈরি করবে।