গতকাল বৃহস্পতিবার মুসলমানদের পবিত্র হজ্ব অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামীকাল শনিবার বাংলাদেশ, মিয়ানমারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পবিত্র ঈদুল আযহা ও কোরবান। কিন্তু প্রতিবেশী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিমদের সেই ধর্মীয় অধিকারটুকুও নেই। বরং উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের স্বজন হারানোর আর্তনাদে আকাশ ভারি হয়ে উঠছে। রাখাইনের উদ্ভুত পরিস্থিতিতে গতকাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে জড়ো হয়েছে হাজার হাজার আশ্রয় প্রার্থী রোহিঙ্গা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত উখিয়ার কুতুপালং বালুখালী রোহিঙ্গা শিবির ও সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে দেখা গেছে আশ্রয় নেয়া ও আশ্রয় প্রার্থী রোহিঙ্গাদের করুণ আর্তনাদ। সীমান্তের নানা এলাকায় আশ্রিত ও আশ্রয় প্রার্থী অনেক রোহিঙ্গা জানান ঈদের আনন্দ ও কোরবানি করার মত পরিবেশ তাদের নেই। তারপরও কেউ কেউ সাথে গরু, ছাগল নিয়ে এসেছে, তারা হয়ত কোরবান করতে পারে। একেত সর্বস্ব হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে আসা, তার উপর গতকাল সকাল থেকে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হওয়ায় সর্বত্র রোহিঙ্গাদের চরম ভোগান্তিতে পড়তে দেখা গেছে। অনেকে এক কাপড়ে কোন রকমে জান নিয়ে পালিয়ে এসেছে। অনেক পরিবারের থাকা ও খাওয়ার কোন ব্যবস্থা হয়নি এখনো। রান্না করে খাবে সেই ব্যবস্থাও অনেকের নেই। আশ্রয় নেয়া ও আশ্রয় প্রার্থীদের অধিকাংশ নারী, শিশু ও বৃদ্ধ হওয়ায় তারা পড়েছে নানা বিপাকে। পূর্ব থেকে যাদের আত্মীয়–স্বজন বা পরিচিত, প্রতিবেশী এখানে রয়েছে তাদেরকে সাথে নিয়ে সাময়িক আশ্রয় দিচ্ছে। আবার অনেকের পরিচিত থাকলেও কেউ খবর নিচ্ছে না বলে জানা গেছে। বালুখালী বি–১ ব্লকে পূর্বের আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা মো. ইকবাল (৩৪) জানান, বুধবার সন্ধ্যায় রাখাইনের ফকিরাবাজার এলাকা থেকে তার ফুফু জরিনা খাতুন (৫০) ও তার তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে এখানে এসেছে। তাদেরকে আমার ঘরে থাকতে দিয়েছি। দেশে ফুফাত ভাই ও অন্যান্যরা এখনো রয়ে গেছে। জানি না তাদের কি অবস্থা হয়েছে। বালুখালী শিবিরে প্রবেশ পথে রাখাইনের কুমির খালী থেকে আসা আয়েশা খাতুন (৩২) জানালেন, স্বামী ছৈয়দুল আমিন কোথায় গেছে, আদৌ বেঁচে আছে কিনা জানি না। চার ছেলে মেয়ের মধ্যে ১২ বছরের ছেলে ইব্রাহিমকে আসার সময় খোঁজে না পাওয়ায় আনা যায়নি। জানেন না ছেলেটি কোথায় কি ভাবে আছে। কুতুপালং অনিবন্ধিত শিবিরের প্রবেশ মুখে আমতলায় মিয়ানমারের রাখাইনের বলি বাজার থেকে আসা দিল মোহাম্মদ (৫০) জানালেন, দেশে আর্মি ও মগদের নির্যাতনের করুণ কাহিনী। তিনি জানান তার তিন ছেলে চার মেয়ের মধ্যে দুই ছেলে ও তিন মেয়ে বিবাহিত। অবিবাহিত কিশোরী নুর বাহার ও দুই পুত্র বধূ ও চার নাতিকে নিয়ে হোয়াইক্যং লাম্বাবিল সীমান্ত দিয়ে নাফ নদী পেরিয়ে গতকাল ভোরে পৌঁছে এখানে আসতে আসতে দুপুর হয়ে গেছে। দিল মোহাম্মদের স্ত্রী ফয়েজা খাতুন ও দুই পুত্রবধূ ছেলে ও স্বামী হারানোর বেদনায় নির্বাক। শুধুই কাঁদছে। কুতুপালং নিবন্ধিত শিবিরের সি–ব্লকে নুরুল বশরের ঘরে দেখা গেছে নতুন আশ্রয় নেয়া ৫ জনকে। এদের মধ্যে নুরুল বশরের ভাবি ছমুদা খাতুন (৩২) ও চার ছেলে মেয়ে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তাদের বাপ কোথায় আছে আদৌ তাদের কাছে আসতে পারবে কিনা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ছমুদা খাতুনও স্বামী, সংসারের সব কিছু হারিয়ে নির্বাক। আসলেই এসব সর্বস্ব হারানো রোহিঙ্গাদের মাঝে কোন ধরনের স্বস্তি বা আনন্দ থাকার কথা নয়। এসব রোহিঙ্গাদের অধিকাংশ নারি ও শিশু। তারা জানে না তাদের স্বামী, পিতা, পুত্র ও স্বজনরা দেশে আদৌ বেঁচে আছে কিনা। বেঁচে থাকলে হয়ত একদিন দেখা মিলবে। কিন্তু তাদের আশংকা ও উদ্বেগ যদি বেঁচে না থাকে তাহলে তাদের কিভাবে দাফন কাফন হয়েছে বা জানাজা হয়েছে কি–না। কোথায় কবরস্থ করা হয়েছে তাও তারা জানে না। এত নিকট আত্মীয় স্বজন, পিতা পুত্র বা ছেলে বা ভাইদের কবর পর্যন্ত কি তারা দেখতে পাবে না। কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবির ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নুর জানালেন এ অবস্থায় যাদের সারাদিন মিলে এক বেলা খাবারও জুটছে না, তাদের জন্য ঈদের আনন্দ বলতে কিছুই অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না।