
আফ্রিকা মহাদেশের ক্ষুদ্র দেশগুলোর মধ্যে গাম্বিয়া অন্যতম। পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিমপ্রধান এই দেশটিই আইনমন্ত্রী আবু বকর তাম্বাদোউ রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ এনে জাতিসংঘে সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস বা আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযোগটিতে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস সামরিক অভিযান চালানোর মাধ্যমে ১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ লঙ্ঘন করেছে মিয়ানমার। তবে দেশটির নেত্রী ও শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি বারবার তা অস্বীকার করেছেন।
গত বছর মে মাসে ওআইসি এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের পরেই ঢাকায় অনুষ্ঠিত সংস্থাটির বার্ষিক সভায় প্রথম আবু বকর তাম্বাদোউ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করার বিষয়টি উপস্থাপন করেন। এরপর চলতি বছর জুনে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত ওআইসির সম্মেলনে রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে আইসিজে-এ তুলে ধরার প্রস্তাব করেন তিনি। নভেম্বর মাসের ১১ তারিখে আবু বকর তাম্বাদোউ গত নভেম্বর মাসে হেগের আদালতে অভিযোগটি করেন।
কিন্তু আফ্রিকার ছোট্ট দেশটির ওই মন্ত্রী কেন মামলা করতে গেলেন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে? অভিযোগটি করার পরপরই নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে সংবাদ সম্মেলন করে আবু বকর তাম্বাদোউ বলেছিলেন, এই অভিযোগের একটাই উদ্দেশ্য, নিজের জনগণের সঙ্গে মিয়ানমার যে আচরণ করেছে সেটির জন্য তাদেরই দায়ী করা। আমাদের চোখের সামনে গণহত্যা ঘটে যাওয়ার পরেও আমরা কিছুই করছি না, এটা আমাদের প্রজন্মের জন্য লজ্জাজনক।
এদিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বরাতে নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় যে ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল তা নিয়ে টানা এক দশক কাজ করেছেন আবু বকর তাম্বাদোউ। ২০০৩ সাল থেকে সরেজমিনে কাজ করতে গিয়ে আইনশাস্ত্র পাস করা আবু বকরের মনে গভীর দাগ কেটেছিল রুয়ান্ডার সেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। মাত্র তিন মাসের মধ্যে লক্ষাধিক মানুষ হত্যার নিশানা তাকে বিহ্বল করেছিল। ওই ঘটনাই তাকে রোহিঙ্গা গণহত্যার বিষয়ে মামলা করার অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমার ইস্যুতে গাম্বিয়া বা আবু বকর যে কাজটি করেছেন তিন বছর আগেও তাদের পক্ষে সেটি সম্ভব ছিল না। ২০১৬ সালে দেশটিতে টানা ২২ বছরের স্বৈরশাসনের অবসানেই এই সুযোগ এসেছে।
আবু বকর বলেন, ওই ২২ বছর আসলে আমাদের কণ্ঠরোধ করা ছিল। নিজের বা অন্যের অধিকারের জন্য কীভাবে কথা বলতে হয় তা আমরা ভুলে ছিলাম। আমরা জানি নিজেদের কষ্টের কথা বিশ্বকে জানাতে না পারার যাতনা কত ভয়াবহ হয়।
ব্যবসায়ী বাবার ছেলে আবু বকর ব্রিটিশ একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরেই জড়িয়ে পড়েন স্বৈরশাসক বিরোধী আন্দোলনে। নিয়মিত যোগ দিতেন সরকারবিরোধী বিক্ষোভে। পরে আন্দোলন-সংগ্রামে নিহত ও মামলার শিকার ব্যক্তিদের আইনি সহায়তা দেওয়া শুরু করেন তিনি। যাহুয়া সরকার তার ক্ষতি করতে পরে এমন আশঙ্কায় বন্ধুরা তাকে বারবার থামাতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মানাধিকারের প্রশ্নে অবিচল আবু বকর থামেননি।
২০০৩ সালে তিনি চাকরি নেন জাতিসংঘের তৈরি রুয়ান্ডার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। ওই ট্রাইব্যুনালে কাজ করার সময়ই তিনি রুয়ান্ডা গণহত্যায় জড়িত কয়েকজনকে চিহ্নিত করেন। এর মধ্যে ২০১১ সালে রুয়ান্ডার তৎকালীন সেনাপ্রধান অগাস্টিন বিজিমাংগুর ৩০ বছরের সাজাও হয়। এদিকে ২০১৬ সালে গাম্বিয়ার স্বৈরশাসকের পতনের পর নতুন মন্ত্রিসভায় ডাক পরে তার। ২০১৭ সালে দায়িত্ব নেন আইন মন্ত্রণালয়ের।
গাম্বিয়ার রাজধানী বানজুলে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে আবু বকর বলেছেন, গণহত্যার ভয়াবহতা কেমন হতে পারে তা আমি নিজের চোখে দেখেছি। রুয়ান্ডায় দেখেছি, মিয়ানমারে দেখলাম। গণহত্যার ঘটনা পৃথিবীর করুণতম গল্পকেও হার মানায়।
গত সপ্তাহে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে আবু বকর জানান, হেগে মামলাটির প্রথম শুনাতিতে উপস্থিত থেকে তিনি সু চির বিরুদ্ধেও অভিযোগ তুলবেন। কারণ জাতিসংঘ রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনাকে জাতিগত নিধন ও গণহত্যার শামিল বললেও সু চি বারবার তা অস্বীকার করেছেন। তিনি বিচারকের কাছে মিয়ানমারকে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করার দাবিও জানাবেন। তিনি বলেন, ইসলামিক ঐক্য হয়তো মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগটি উত্থাপনে সহায়তা করেছে। তবে মূল বিষয় ছিল মানবতা।
২০১৭ সালে রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। জাতিসংঘের তদন্তকারী দল বলেছে, গণহত্যার উদ্দেশ্য নিয়েই রোহিঙ্গাদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে।
পাঠকের মতামত