দেশের বাইরে থেকে আমদানি করলে বাজারে দেশীয় পশুর (গরু, মহিষ, ছাগল) দাম কমে যাবে—এই যুক্তি দেখিয়ে গত বছর ঈদুল আজহার আগে কক্সবাজারের শাহপরীর দ্বীপের করিডর দিয়ে মিয়ানমার থেকে পশু আমদানি বন্ধ করে দেয় সরকার। সাড়ে আট মাস পেরিয়ে গেলেও নিষেধাজ্ঞা আর তুলে নেওয়া হয়নি। ফলে বিপাকে পড়েছেন প্রায় অর্ধশত বাংলাদেশি ব্যবসায়ী। মিয়ানমারের আকিয়াবে প্রায় ৫০ হাজার পশু কিনে রাখলেও নিষেধাজ্ঞার কারণে সেগুলো টেকনাফে আনতে পারছেন না তাঁরা।
শাহপরীর দ্বীপ করিডর পশু আমদানিকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবু সৈয়দ প্রথম আলোকে বলেন, আটকে পড়া পশুর বিপরীতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ প্রায় ২০০ কোটি টাকা। বিনিয়োগের টাকা তুলে আনতে না পেরে দুশ্চিন্তায় আছেন তাঁরা।
ব্যবসায়ীদের দাবি, বর্তমানে টেকনাফসহ কক্সবাজার অঞ্চলে মাংসের চাহিদা বেড়েছে। উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় সাড়ে ৭ লাখ বাসিন্দার পাশাপাশি ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে সাড়ে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মাংসের চাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় মাংসের দামও বেড়ে গেছে।
পশু ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম বলেন, গত বছর কোরবানির ঈদের আগে দেশীয় খামারিদের কথা বিবেচনা করে এই করিডর দিয়ে পশু আমদানি বন্ধ করে দেয় জেলা প্রশাসন। সেই কোরবানি সাড়ে আট মাস আগে শেষ হলেও এখনো করিডর খুলে দেওয়া হয়নি। আমদানি বন্ধ থাকায় সরকার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। আমদানি বন্ধের প্রভাব পড়েছে জেলার প্রতিটি হাটবাজারে। বর্তমানে জেলার বিভিন্ন হাটবাজারে গরু ও মহিষের প্রতি কেজি মাংস বিক্রি হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৮০০ টাকায়, যা সাড়ে ৮ মাস আগে ছিল ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা। তিনি বলেন, সামনে পবিত্র রমজান মাস, এরপর কোরবানি। এ সময়ের মধ্যেও যদি মিয়ানমারে কিনে রাখা পশুগুলো আনা না যায়, তাহলে ব্যবসায়ীদের পথে বসতে হবে।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমারের গরু-মহিষ মোটাতাজা। দামেও তুলনামূলক সস্তা। কোরবানির মৌসুমে করিডর দিয়ে আমদানি করা পশুগুলো সরবরাহ হয় কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। সর্বশেষ ২০২১ সালের জুনে করিডর দিয়ে আমদানি হয়েছিল ২৫ হাজার ৮৬৮টি গরু ও ৪ হাজার ২৫৮টি মহিষ। পশু আমদানির বিপরীতে সরকারের রাজস্ব আদায় হয়েছিল ১ কোটি ৫০ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। শুল্ক বিভাগের তথ্যমতে, সাড়ে ৮ মাস আমদানি বন্ধ থাকায় সরকার অন্তত ১০ কোটি টাকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
করিডরে খাঁ খাঁ অবস্থা
গতকাল সোমবার দুপুরে করিডরে গিয়ে দেখা যায়, বিশাল মাঠটি খালি পড়ে আছে। করিডরে সামনে (নাফ নদীতে) লম্বা জেটিটিও ফাঁকা। আগে এই জেটি দিয়ে আমদানি হওয়া পশু খালাস হতো। মিয়ানমার থেকে পশুবোঝাই ট্রলারগুলো এই জেটিতে ভিড়ত। ব্যবসায়ীরা করিডর থেকে সস্তায় পশু কিনে টেকনাফ, উখিয়া, রামু, কক্সবাজার সদর, চকরিয়া, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম মহানগরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করতেন। অনেকে জবাই করে মিয়ানমারের পশু বিক্রি করতেন হাটবাজারে। এখন সবই বন্ধ।
গত বছরের ৪ জুলাই জেলা চোরাচালানবিরোধী টাস্কফোর্স কমিটির এ ভার্চ্যুয়াল বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে করিডরটি দিয়ে মিয়ানমারের পশু আমদানি বন্ধ করেন জেলা প্রশাসক। দক্ষিণ চট্টগ্রামে এটি ছাড়া পশু আমদানির দ্বিতীয় কোনো করিডর নেই।
পশু ব্যবসায়ী মোহাম্মদ কাশেম বলেন, স্থানীয় অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ীর অগ্রিম কেনা ছোট-বড় প্রায় ৫০ হাজার পশু মিয়ানমারে আটকে আছে। পশুগুলো করিডরে আনা না গেলে বিনিয়োগের টাকা উশুল করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাঁর নিজের অন্তত সাত হাজার পশু মিয়ানমারে আটকা পড়েছে। একইভাবে করিডরের ৪২ ব্যবসায়ীর আরও ৩৫ হাজারের মতো পশু আটকা আছে মিয়ানমারে। এর মধ্যে ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ মনিনের ৫ হাজার, শহিদুল ইসলামের ৭ হাজার, কামরুল ইসলামের ৩ হাজার, আবু সৈয়দের ১০ হাজার, মোহাম্মদ শরীফের ৫ হাজার, মোহাম্মদ আলমগীরের ৭ হাজার পশু আটকে আছে বলে জানান তিনি।
ব্যবসায়ীরা জানান, বৈধপথে করিডর দিয়ে পশু আমদানি বন্ধ থাকায় অনেকে সীমান্ত দিয়ে চোরাইপথে পশু আনছেন। এতে সরকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
চোরাইপথে পশু আনা নিরুৎসাহিত করতে ২০০৩ সালের ২৫ মে থেকে শাহপরীর দ্বীপ করিডর চালু করে সরকার। প্রতিটি গরু ও মহিষের জন্য ৫০০ টাকা ও প্রতিটি ছাগলের জন্য ২০০ টাকা রাজস্ব আদায় হয়। প্রতিষ্ঠার ১৮ বছরে ৩৬ কোটি ৮০ লাখ ৬৯ হাজার ৪০০ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে এ করিডরে।
টেকনাফ স্থলবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা শাহীন আক্তার বলেন, করিডর বন্ধ থাকায় সরকার প্রতি মাসে কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে। দেশের মাংসের চাহিদা পূরণ ও চলমান সংকট নিরসনে পশু আমদানি আবার চালু করা যেতে পারে।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পারভেজ চৌধুরী বলেন, সরকারের নির্দেশনায় করিডরে মিয়ানমারের পশু আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। চালুর ব্যাপারে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। প্রথম আলো