রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে এ অবস্থাকে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। বলছেন, এভাবে আওয়ামী লীগার হওয়ার এ প্রবণতা নজিরবিহীন। অতীতে কখনোই এরকমটা দেখা যায়নি। আসলে এখন চলছে ব্যক্তিস্বার্থ ও সম্পদ রক্ষায় ফায়দাতন্ত্রের রাজনীতি। এটি প্রকৃত অবস্থা নয়, দল ক্ষমতায় না থাকলে এরা ফের সটকে পড়বে। এছাড়া এ হাইব্রিড আওয়ামী লীগাররা দলটির জন্য এক সময় বোঝা বা ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে দল কখনও দুঃসময়ে পড়লে এদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাদের মতে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এখন বড় সুবিধায় আছে। তাই তৃণমূল থেকে প্রশাসনের সর্বত্র আওয়ামী লীগ বনে যাওয়ার জন্য অতি উৎসাহীদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু এটি আসলে বাস্তব চিত্র নয়। এজন্য দলের নীতিনির্ধারকদের এখন থেকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে। জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, দেশে মূলত ফায়দাতন্ত্রের রাজনীতি চলছে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন সেই দলকে ঘিরে একশ্রেণীর চাটুকার এবং সুবিধাভোগী শ্রেণীর আÍপ্রকাশ ঘটে। মূলত এ চাটুকার এবং সুবিধাভোগীরা অবৈধ উপায়ে নানারকম অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিতে বারবার ভোল পাল্টায়। ক্ষমতাসীন দলের ছাতার নিচে আশ্রয় নেয়।
তিনি আরও বলেন, এখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। তাই সবাই যে কোনো মূল্যে গায়ে আওয়ামী লীগের লেবাস লাগাতে ব্যস্ত। কিন্তু এটি প্রকৃত চিত্র নয়। এরা ব্যক্তিস্বার্থে আওয়ামী লীগের একটা পদ পেতে চান। চান ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিদের কাছের লোক হতে। কারণ, এতে তাদের ফায়দা ভালো হবে। আয়-উন্নতি হবে। অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হবে। অপরাধ করে পার পাওয়া যাবে।
এক প্রশ্নের উত্তরে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আসলে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অত্যন্ত দুর্বল। তারা এক ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল। আর এ এক ব্যক্তি যখন ক্ষমতায় থাকেন, তখন তার হাতে থাকে সব ক্ষমতা। তিনিই হন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। সেই ক্ষমতার ছিটেফোঁটা পাওয়ার জন্য সমাজের সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠী সক্রিয় হয়ে ওঠে। মূলত তারা বসন্তের কোকিল হিসেবে আÍপ্রকাশ করে। এরা কিন্তু দুঃসময়ে থাকে না।’
তিনি বলেন, এর আগে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনও একই চিত্র ছিল।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘সব সরকারের সময়ই কমবেশি এক শ্রেণীর সুবিধাভোগীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। তবে এবার এ সুবিধাভোগীর সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। কি আমলা, কি শিক্ষক, কি আইনজীবী, কি সাংবাদিক- সবাই এখন আওয়ামী লীগার। এত আওয়ামী লীগার অতীতে দেশে দেখা যায়নি। আর র্যাব-পুলিশের কথাতো বলার অপেক্ষা রাখে না। তারা কে কত বড় আওয়ামী লীগার তা প্রমাণের জন্য হেন কাজ নেই যে করছেন না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশেষ করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজশিক্ষকরা এখন রাজনীতির সঙ্গে অতিমাত্রায় জড়িয়ে পড়েছেন। তারা এখন সবাই আওয়ামী লীগার। বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে অতি উৎসাহী বা নব্য আওয়ামী লীগারের আস্ফালনে দীর্ঘদিনের ত্যাগী আওয়ামী লীগপন্থী কিংবা যোগ্য এবং মেধাবী শিক্ষকরা এখন কোণঠাসা। একই অবস্থা চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও। তাদের মধ্যেও সর্বত্র এখন আওয়ামী লীগারের ছড়াছড়ি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজে এখন আর অন্যপন্থী চিকিৎসক খুব বেশি চোখে পড়ে না। চিকিৎসকরা সবাই আওয়ামী ঘরানার সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতা ও সমর্থক।’ তার মতে, ‘দল বেকায়দায় পড়লে এ সুবিধাভোগী শ্রেণী কেটে পড়বে। দুঃসময়ে দলের পাশে দাঁড়াবে না। কিন্তু সুযোগ-সুবিধা যা নেয়ার নিয়ে যাবে।’
লেখক-কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের শিক্ষিত সমাজের সুবিধাবাদী শ্রেণী এখন আওয়ামী লীগার পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেন না। প্রকাশ্যেই তারা ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন। এর আগে আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে ছিল। এমনকি ওয়ান-ইলেভেনে যখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী গ্রেফতার হন, তখনও এসব পেশাজীবী শ্রেণীকে সভা-সমাবেশ কিংবা মানববন্ধন করতে দেখা যায়নি।’ তিনি মনে করেন, ‘কোনো কিছুরই অতিমাত্রা ভালো নয়। এখন তারা রাস্তাঘাট দখল করে নিজেদের আওয়ামী লীগার দাবি করে শোডাউন দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকদের এ বিষয়টি নিয়ে ভাববার সময় এসেছে।’ সুত্র : যুগান্তর