কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা অধ্যুষিত কুতুপালং বাজারে দীর্ঘদিন ধরে চলা চোরাই ও কপি মোবাইল ব্যবসা নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর নতুন করে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বিশেষ করে বাজারের আলোচিত দোকান এ এম টেলিকম, যাকে স্থানীয়রা চোরাই মোবাইল সিন্ডিকেটের অন্যতম “মাস্টারমাইন্ড” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, সংবাদ প্রকাশের পরই প্রতিবাদ জানিয়ে বিষয়টিকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে।
তবে সচেতন মহল বলছে, প্রতিবাদ জানানো অপরাধ ঢাকার পুরনো কৌশল। বরং এটা প্রমাণ করে—সংবাদ প্রকাশে সিন্ডিকেটের সদস্যরা চাপে পড়েছে এবং নিজেদের দায় এড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
দীর্ঘদিনের সিন্ডিকেট আধিপত্য
সরেজমিন অনুসন্ধান ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কুতুপালং বাজারে চোরাই মোবাইল বিক্রির সাথে জড়িত রয়েছে রোহিঙ্গাদের একটি সংঘবদ্ধ চক্র। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কপি ও চুরি হওয়া মোবাইল চট্টগ্রামের হেফাজ নামের এক সরবরাহকারীর মাধ্যমে এসব রোহিঙ্গা ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে যায়।
চোরাই মোবাইল বিক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে—এ এম টেলিকম, আতিক টেলিকম, রোহিঙ্গা হাবিবের দোকান, রোহিঙ্গা ইলিয়াস, মায়ের দোয়া টেলিকম, জাবেদ, রোহিঙ্গা আলম, সাইফুল, নুর মোহাম্মদসহ একাধিক দোকান। এসব দোকানে নতুন ও পুরনো মোবাইলের পাশাপাশি সহজেই পাওয়া যায় চোরাই ও বর্ডার ক্রস কপি মোবাইল।
বাজারের নারিকেল বাগান মার্কেট ও আশপাশের দোকানগুলোতে প্রকাশ্যে সাজিয়ে রাখা হয় এসব ফোন। মোবাইল মেরামতের দোকানকে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করলেও, প্রকৃতপক্ষে সেখানে চলে অবৈধ বেচাকেনা।
অভিযোগ রয়েছে—স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতা নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয়দের নামে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করে তা রোহিঙ্গাদের ভাড়া দিয়েছেন। ফলে বৈধ কাগজপত্র দেখিয়ে এসব দোকানে অবৈধ বাণিজ্য চালানো সম্ভব হচ্ছে।
[caption id="attachment_170428" align="aligncenter" width="640"] কপি ও চোরাই মোবাইল বিক্রেতা[/caption]
সংবাদ প্রকাশের পর প্রতিক্রিয়া
সম্প্রতি সংবাদ প্রকাশের পর বাজারে আতঙ্ক বিরাজ করছে। একই সঙ্গে চোরাই ব্যবসায়ীরা নিজেদের রক্ষা করতে নানা কৌশল নিচ্ছে। স্থানীয়দের অভিযোগ—কিছু দলীয় কর্মী ও রোহিঙ্গারা ফেসবুকের বিভিন্ন কমেন্ট বক্সে অশ্লীল মন্তব্য ও কটূক্তি করছে, যাতে করে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া যায়।
এছাড়া সামনে কুতুপালং বাজার ব্যবসায়ী সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে—অনেক ব্যবসায়ী নেতা ভোট পাওয়ার আশায় চোরাই ও কপি মোবাইল বিক্রেতাদের পক্ষ নিয়েছে। ফলে সিন্ডিকেট আরও উৎসাহিত হয়ে প্রকাশ্যে এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রশাসনের সহযোগিতার আশ্বাস
কুতুপালং বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী বলেন,
“আমরা বাজারকে চোরাইপণ্যমুক্ত রাখতে সর্বদা প্রশাসনকে সহযোগিতা করেছি। বিভিন্ন সময়ে পুলিশের অভিযানে আমাদের সহায়তায় চোরাই মোবাইল উদ্ধার হয়েছে। সংবাদ প্রকাশের পর আমরা আবারও চাই, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ অভিযান চালাক।”
সচেতন মহলের মতামত
স্থানীয় সচেতন মহল মনে করছে, সংবাদ প্রকাশের পরও এখনও বাজারে অবৈধ ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। নির্দিষ্ট কয়েকটি দোকানে প্রকাশ্যে চোরাই মোবাইল বিক্রি চলছে। তারা বলছে—“প্রতিবাদ জানিয়ে অপরাধ ঢাকার চেষ্টা আসলে পুরনো কৌশল। বাস্তবতা হলো—কুতুপালং বাজারে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যবসা চালাচ্ছে। এটা বন্ধে দ্রুত বিশেষ অভিযান জরুরি।”
জাবেদের প্রতিবাদ
সংবাদ প্রকাশের পর এ এম টেলিকমের মালিক জাবেদ প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন,
“আমার দোকানে কোনো চোরাই মোবাইল বিক্রি হয় না। আমি বৈধ ব্যবসা করি। আমাকে ষড়যন্ত্র করে জড়ানো হয়েছে।”
তবে স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতি ও ভুক্তভোগীরা বলছেন, জাবেদের এই প্রতিবাদ আসলে দায় এড়ানোর কৌশল মাত্র। তারা দাবি করেন, একাধিকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে তার দোকান থেকে চোরাই মোবাইল উদ্ধার হয়েছে।
জানা যায়, প্রতি বছর বিটিআরসি’র অনুমোদন নিয়ে বৈধভাবে ২ কোটি ৭৬ লাখ হ্যান্ডসেট আসে। আর বাজারে থাকা সেটের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ আসে অবৈধভাবে। এতে সরকার প্রতি বছর এক হাজার থেকে বারোশ’ কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।
“কুতুপালং বাজারে চলমান চোরাই মোবাইল ব্যবসা শুধু স্থানীয় অর্থনীতিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং সরকারের রাজস্ব হারানোর বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চোরাই ও কপি সিন্ডিকেটকে আইনের আওতায় এনে এ ব্যবসা বন্ধ করা এখন সময়ের দাবি।”