সূর্য যখন কক্সবাজারের দিগন্ত ছুঁয়ে ওঠে, মহেশখালীর বিস্তীর্ণ লবণ মাঠগুলো তখন এক শুভ্র আভা নিয়ে জেগে ওঠে। এই মাঠগুলোই দেশের লবণের চাহিদার সিংহভাগ পূরণ করে। প্রতি বছর এই সময়ে লবণ চাষের জন্য মাঠ তৈরির ব্যস্ততায় চাষিদের মুখরিত থাকার কথা, কিন্তু এবার যেন সেই ব্যস্ততার সুর কিছুটা ম্লান, কিছুটা বিষাদের।
ধলঘাটায় লবণ মাঠ প্রস্তুত করছেন জহির আহমেদ। তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে, কিন্তু চোখেমুখে আনন্দের চেয়ে বেশি ফুটে উঠেছে দুশ্চিন্তার ছাপ। গত বছর যে লোকসানের ভার নিয়ে তিনি মাঠ ছেড়েছিলেন, সেই বোঝা কমেনি আজও। ‘গত বছর লবণের দাম ছিল পানির চেয়েও সস্তা-দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন জহির। মাঠে লবণ জমে ছিল পাহাড়ের মতো, কিন্তু কেনার লোক ছিল না। ধার করে লবণ মাঠ করেছিলাম, সেই ধার শোধ করতে পারিনি। এবারও ভয় পাচ্ছি, যদি আবারও একই অবস্থা হয়?’
মহেশখালীতে প্রায় সকল এলাকার উপকূলে চোখে পড়ে লবণ মাঠ তৈরির কাজ। অথচ, স্থানীয় চাষি ও লবণ মাঠ মালিকদের সঙ্গে কথা বললে বোঝা যায়, তাদের মনে নেই উৎসবের আমেজ। গত বছর লবণের বাজার এতটাই অস্বাভাবিক ছিল যে, উৎপাদন খরচ পর্যন্ত ওঠাতে পারেননি অনেকে। মাঠেই লবণ ফেলে রাখতে বাধ্য হয়েছেন বহু চাষি।
গত বছরের দরপতনের কারণে চাষিদের ওপর নেমে আসে ঋণের বোঝা। স্থানীয় অর্থনীতিতে এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। সাধারণ চাষিরা, যারা সাধারণত ঋণ নিয়ে লবণ চাষ শুরু করেন, তারা গড়ে ১ লাখ থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। তাদের কাছে এই অর্থ বিশাল বোঝা, যা পরিশোধ করতে গিয়ে তারা আরও ঋণগ্রস্ত হচ্ছেন।
অন্যদিকে, বড় বড় চাষিদের লোকসানের পরিমাণ আরও ব্যাপক। তাদের ক্ষেত্রে এই ক্ষতির অঙ্ক ১০ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত পৌঁছেছে। লবণের মাঠ লিজ দেওয়া বা ভাড়ায় খাটানো মাঠ মালিকরাও কম ক্ষতিগ্রস্ত হননি। তারা গড়ে ৫ লাখ থেকে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
বড় মহেশখালীর একজন প্রবীণ চাষী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘গত বছর লবণের দাম না পেয়ে পথে বসেছি। সংসার চালানো দায়। নতুন করে কাজ শুরু করার মতো সাহস আর পুঁজি কোনোটাই নেই।’
নভেম্বর মাস থেকেই পুরোদমে লবণ উৎপাদন শুরু করার সময়। কিন্তু চাষিরা এবার দ্বিধায় ভুগছেন। তাদের প্রধান উদ্বেগ হলো, এবারও যদি লবণের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত না হয়, তবে তাদের পথে বসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
চাষি সমিতির নেতৃবৃন্দ মনে করেন, দেশীয় উৎপাদন মৌসুম চলাকালীন লবণের অতিরিক্ত আমদানির সিদ্ধান্তই মূলত বাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলে। তাদের দাবি, দেশের অভ্যন্তরে লবণের সরবরাহ পরিস্থিতি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে এবং চাষিদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে যেন আমদানি বন্ধ করা হয়। এ ছাড়া, ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের জন্য সরকারিভাবে সহজ শর্তে ঋণ অথবা বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করার দাবিও জানিয়েছেন তারা, যা নতুন মৌসুমে পুঁজি বিনিয়োগে সহায়ক হবে।
মহেশখালী কুতুবদিয়ার সাবেক এমপি আলমগীর মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ ফরিদ বলেন, ‘মহেশখালীর লবণ শিল্প কেবল এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা নয়, এটি দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর একটি প্রধান উৎস। এই শিল্পের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং হাজার হাজার চাষিকে আর্থিক বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সময়োপযোগী হস্তক্ষেপ এখন অত্যন্ত জরুরি। গত বছরের লোকসানের ভার নিয়ে নতুন করে মাঠে নামা এই চাষিরা এখন কেবল আশা করে আছেন একটি ন্যায্য বাজারের।’
বড় মহেশখালী কৃষি ব্যাংক কর্মকর্তা শাওন বলেন, ‘লবণের দাম কম হওয়ার ফলে গত বছর ব্যাংকের লেনদেন ও ঋণ আদায় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। চাষি ও মালিকরা এসএমই লোনের মাধ্যমে লবণ মাঠে বিনিয়োগ করে। এতে ব্যাংকের ঋণ আদায়ে বেশ প্রভাব পড়েছে। স্বাভাবিক লেনদেনেও ভাটা পড়েছে।