
কক্সবাজারের ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্প এলাকা থেকে রোহিঙ্গাদের একাংশ সরিয়ে বঙ্গোপসাগরের দ্বীপ ভাসানচরে নেয় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। দ্বীপ বাসযোগ্য করতে নেওয়া হয় দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকার প্রকল্প। পরিকল্পনা ছিল প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে সেখানে স্থানান্তর করার।
২০২০ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গা স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে শুরু হয় কার্যক্রম। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে বিগত সরকারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে। গত ১৪ মাসে একজন রোহিঙ্গাকেও সেখানে নেওয়া হয়নি। আপাতত আর কোনো রোহিঙ্গা সেখানে নেওয়া হবে না বলেই জানা যায়।
আমরা চাই রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাক। যদি তাদের ভাসানচরে রেখে দিই, তাহলে প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে।- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের শরণার্থী বিষয়ক সেলের প্রধান মো. নাজমুল আবেদীন
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ৩৭ হাজার ৭৩১ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নেওয়া হয়েছে। তবে এদের মধ্যে প্রায় সাত হাজার রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে সেখান থেকে পালিয়ে গেছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের শরণার্থী বিষয়ক সেলের প্রধান মো. নাজমুল আবেদীন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমানে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর সম্পূর্ণ বন্ধ। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর কোনো রোহিঙ্গাকে সেখানে নেওয়া হবে না। একই সঙ্গে রোহিঙ্গারাও কক্সবাজার ছেড়ে ওই দ্বীপে যেতে আগ্রহী নয়।’
আপাতত রোহিঙ্গাদের পাঠানো হচ্ছে না। তবে পরবর্তীসময়ে পাঠানো হবে কি না সেটা টাইম টু টাইম সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপার।- প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার
স্থানান্তর না করার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমরা চাই রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাক। যদি তাদের ভাসানচরে রেখে দিই, তাহলে প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে।’
নাজমুল আবেদীন বলেন, ‘যারা ইতোমধ্যে ভাসানচরে গেছেন, তাদের জন্য চলমান প্রকল্পগুলো অব্যাহত থাকবে যাতে তারা প্রয়োজনীয় সব সুবিধা পান। দ্বীপ হওয়ায় যোগাযোগব্যবস্থা কিছুটা জটিল—এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার পাঠাতেও কষ্ট হয়। তারপরও সেখানে থাকা রোহিঙ্গাদের সব রকম সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা চলছে।’
সরকার বলেছিল রেশন, দোকান, গবাদিপশু বা চাষের জমি দেবে। কিন্তু এককালীন জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা আর সামান্য রেশন ছাড়া কিছুই পাইনি। জরুরি চিকিৎসাও মেলে না।– রোহিঙ্গা নারী নূর কলিমা
প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আপাতত রোহিঙ্গাদের পাঠানো হচ্ছে না। তবে পরবর্তীসময়ে পাঠানো হবে কি না সেটা টাইম টু টাইম সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপার।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমার বিষয়ক অনুবিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক অংশীদাররা ভাসানচর প্রকল্পকে সমর্থন করেননি। একটি দ্বীপে শরণার্থীদের সীমাবদ্ধ করে রাখার বিষয়টি নিয়ে তাদের উদ্বেগ ছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এমন সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি।’
আমরা এখানে ভালো আছি। দ্বীপ হলেও বাড়িঘর, বাজার—সব আধুনিকভাবে নির্মিত। সবচেয়ে বড় কথা, এখানে আরসা বা আরএসও’র মতো সংগঠনের হুমকি, চাঁদাবাজি, অপহরণ নেই।-ভাসানচর বাজার কমিটির সভাপতি নূর মোস্তফা
তিনি আরও বলেন, ‘আগের সরকার নীতিগতভাবে একগুঁয়ে ছিল—তারা মনে করেছিল এই প্রকল্পের মাধ্যমে ভিন্ন কিছু করে দেখাতে পারবে। কিন্তু বর্তমান সরকার আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতিসংঘ ব্যবস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। আগের সরকারের সঙ্গে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল, তা আর রাখতে চায় না।’
তার ভাষায়, ‘বর্তমান সরকারের মতে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেই ভুল সংশোধন করে সঠিক সিদ্ধান্তে ফিরেছে। এখন নতুন করে কাউকে নিতে গেলে বাড়িঘর তৈরি ও অবকাঠামোতে বড় বিনিয়োগ লাগবে। তাই আপাতত নতুন স্থানান্তরের কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে যারা ইতোমধ্যে সেখানে গেছে, তাদের ফেরানোরও কোনো চিন্তা নেই। সরকার তাদের জীবনমান উন্নয়নে মনোযোগী এবং জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাসহ (ইউএনএইচসিআর) বিভিন্ন সংস্থা সেখানে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।’

ভাসানচরের ৮৩ নম্বর ক্লাস্টারে থাকেন রোহিঙ্গা নারী আমিনা খাতুন। দীর্ঘদিন ধরে মাসিকজনিত অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ভুগছেন তিনি। সরকারি ২০ শয্যার হাসপাতালে বারবার চিকিৎসা নিয়েও সুস্থ হতে পারেননি।
৯৩ নম্বর ক্লাস্টারে দুই সন্তান ও স্বামীসহ থাকেন নূর কলিমা (২৪)। জন্ডিসে ভুগছেন তিনি। হাসপাতালে গেলে তাকে এক পাতা প্যারাসিটামল দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। নূর কলিমা বলেন, ‘যে রোগেই যাই, শুধু প্যারাসিটামল দেয়। অন্য কোনো ওষুধ তাদের কাছে নেই।’

দুই বছর আগে সরকারের আহ্বানে ভাসানচরে যান নূর কলিমা ও তার স্বামী হারুণ শাহ (২৩)। হাসান শরীফ নামে এক রোহিঙ্গা ২০২০ সালে স্ত্রী ও সাত সন্তান নিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন।
নূর কলিমা বলেন, ‘সরকার বলেছিল রেশন, দোকান, গবাদিপশু বা চাষের জমি দেবে। কিন্তু এককালীন জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা আর সামান্য রেশন ছাড়া কিছুই পাইনি। জরুরি চিকিৎসাও মেলে না।’
হাসান শরীফ বলেন, ‘অনেকে সাগরে মাছ ধরে। কখনো ভালো মাছও পায়, কিন্তু বিক্রির জায়গা নেই। স্থানীয়দের কাছে কম দামে বিক্রি করতে হয়। তাই মাছ ধরার আগ্রহও কমে গেছে।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘দ্বীপের পানি লবণাক্ত। প্রথম দিকে খাওয়া যেত না, এখন একটু অভ্যস্ত হয়েছি।’
ভাসানচরের বাজার কমিটির সভাপতি ও কাপড় ব্যবসায়ী নূর মোস্তফা বলেন, ‘আমরা এখানে ভালো আছি। দ্বীপ হলেও বাড়িঘর, বাজার—সব আধুনিকভাবে নির্মিত। সবচেয়ে বড় কথা, এখানে আরসা বা আরএসও’র মতো সংগঠনের হুমকি, চাঁদাবাজি, অপহরণ নেই। কক্সবাজারের ক্যাম্পে এসবের কারণে সাধারণ রোহিঙ্গাদের জীবন অতিষ্ঠ ছিল। অন্তত এখানে সেই যন্ত্রণা নেই।’

ভাসানচরে কাজ করা একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখনো সেখানে লজিস্টিক ও অবকাঠামোগত কিছু সমস্যা রয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে সরকারের ফান্ড কমতে শুরু করে। এমনকি রাস্তার বাতি নষ্ট হলেও মেরামতের দায়িত্ব নিতে হয় নৌবাহিনীকে। যুক্তরাষ্ট্র ভাসানচরের জন্য কোনো অর্থায়ন করে না, আর অধিকাংশ দেশই স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে—ভাসানচরের জন্য কোনো অর্থ পাঠানো যাবে না।’
ভাসানচর ক্যাম্প নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত। সেখানে পৌঁছাতে হয় চট্টগ্রাম হয়ে সমুদ্রপথে। বঙ্গোপসাগরের উপকূল থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে হাতিয়া উপজেলার কাছে দ্বীপটি অবস্থিত। প্রায় ৪০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার ১২০টি গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করেছিল।
প্রকল্পের ঘরগুলো চার ফুট উঁচু কংক্রিটের ব্লকে তৈরি এবং পুরো এলাকা ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বন্যা সুরক্ষা বাঁধের ভেতরে। সেখানে রয়েছে ১২০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, যা স্কুল, মেডিকেল সেন্টার ও কমিউনিটি সেন্টার হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। সুত্র, জাগো নিউজ