প্রকাশিত: ২০/১১/২০২১ ৮:২২ এএম

২৫ আগস্ট ২০১৭ সালের পর থেকে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। মানবতার জননী বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের দুর্দশা সচক্ষে দেখার জন্য ঘটনার অব্যবহিত পরেই ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করে নিপীড়িত এই জনগোষ্ঠীর প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের অবস্থানকে মানবিক এবং সহনীয় করার জন্য কাজ করতে আগ্রহী কয়েক শ বিদেশি সংস্থাকে ক্যাম্পগুলোতে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। এই তাত্ক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বাংলাদেশ সফলতার সঙ্গে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।

আর গত চোর বছর ধরে বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশ অনেকটা এককভাবেই মোকাবিলা করছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট। সরকারের দুই দফা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর এখনো চলমান করোনা মহামারিতে আটকে আছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার আলোচনা।কিন্তু গত বুধবার জাতিসংঘে সর্বসম্মতিক্রমে রোহিঙ্গা প্রস্তাব পাস হয়েছে। মূলত ‘আসিয়ানের’ অনড় মনোভাবের কারণেই জাতিসংঘে মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা সম্পর্কিত প্রস্তাব পাস হয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশের কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা।

আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করছেন, তাদের কূটনৈতিক দক্ষতায় রোহিঙ্গা ই্যসু জটিলতা শুরু হওয়ার পর এই প্রথম জাতিসংঘে গত বুধবার সর্বসম্মতিক্রমে রোহিঙ্গা প্রস্তাব পাস হয়েছে। প্রস্তাবটি যৌথভাবে উত্থাপন করে ওআইসি এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। সবমিলিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর চাপ বেড়েছে। একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে মিয়ানমারকে। কারণ মিয়ানমারের পরিবেশ স্বাভাবিক না হলে এই অঞ্চল নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এর মাধ্যমে পুরো বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি প্রতিশ্রুতি পূরণ হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এখনই শুরু হচ্ছে না। তবে প্রত্যাবাসনের একটি ক্ষেত্র তৈরি হলো। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশ কীভাবে ফায়দা তুলবে সেটিই বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলেন, ২০১৭ সাল থেকে জাতিসংঘে রোহিঙ্গা বিষয়ক সব রেজুলেশনে বেলারুশ, চীন, রাশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওসসহ বেশ কয়েকটি দেশ সরাসরি নেতিবাচক ভোট দিলেও এবার তারা নীরব থেকেছে। বারবারই রোহিঙ্গাদের অধিকারের প্রশ্নে বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে রাশিয়া ও চীন। তাদের মিত্ররাও হেঁটেছে একই পথে। কিন্তু এবার উল্টোটি হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে দেশ দুটোর অবস্থান নিয়ে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রস্তাবে সায় দিয়ে মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে একহাত নিয়েছে চীন ও রাশিয়া।

তাদের মতে, আপাতদৃষ্টিতে খুব খুশি হওয়ার কিছু না হলেও চীন-রাশিয়ার এমন অবস্থানের রাজনৈতিক প্রভাব অবশ্যই আছে। পাশাপাশি দৃশ্যপট পরিবর্তনের জন্য তারা ‘আসিয়ান’কেও ধন্যবাদ দিতে চান। কারণ ‘আসিয়ান’ বেঁকে বসায় চীন-রাশিয়া অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। প্রসঙ্গত, আসিয়ান সম্মেলনে মিয়ানমার অংশই নিতে পারেনি।

জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস হওয়ার ফলে মিয়ানমার ক্রমশ একঘরে হয়ে পড়ছে। মূলত আসিয়ানের কারণেই মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে হয়ে যাওয়া আসিয়ান সম্মেলনে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার অংশ নিতে পারেনি। এরকম পরিস্থিতিতে চলতি নভেম্বরে চীনের সঙ্গে আসিয়ানের একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এতে আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ব্রুনাই ও সিঙ্গাপুর কড়া ভাষায় চীনকে জানিয়েছে, মিয়ানমার ওই বৈঠকে যোগ দিলে আসিয়ানের সদস্যদেশগুলো অংশ নেবে না।

মিয়ানমারকে ছাড়াই চীনকে বৈঠকে আসতে হবে। মূলত, এরপর থেকেই চীন মিয়ানমারের সঙ্গ ছাড়তে শুরু করে। কারণ আসিয়ানকে খেপিয়ে চীন কোনো কাজ করবে না। ঠিক এ কারণে জাতিসংঘে মিয়ানমারের পক্ষাবলম্বন করেনি চীন-রাশিয়া। এতে মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরি শুরু হয়। এখন এই চাপকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশকে ফায়দা তুলতে হবে বলে জানান এই কূটনীতিক।

সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক মোহাম্মদ জমির বলেন, জাতিসংঘে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। তবে নিরাপত্তা পরিষদে পাস না হওয়া পর্যন্ত লাভ হবে না। এটা ঠিক মিয়ানমারের ওপর একটি চাপ তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, চীন-রাশিয়া যা করার করেছে। জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস হওয়ার সময় ভারত কী করেছিল সেটা দেখা প্রয়োজন বলে জানান তিনি। কারণ কপ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট মিয়ানমার নিয়ে বক্তৃতা দিলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে কিছু বলেননি। তবে আসিয়ানের ভূমিকা সন্তোষজনক। কাজেই সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেই বাংলাদেশকে কাজ করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, মিয়ানমার ভেবেছিল রোহিঙ্গা ও তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কিছু বলবে না। কিন্তু জাতিসংঘে পাস হওয়া প্রস্তাবের পরে যে চাপ তৈরি হয়েছে তা নিয়ে মিয়ানমার কী প্রতিক্রিয়া দেয় সেটি এখন দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস হওয়ার সময় কেউ বাধা দেয়নি। এই প্রস্তাব পাস করাতে চীন-রাশিয়ার মতো জাপানও ভালো ভূমিকা নিয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে এটি একটি বড় পরিবর্তন ধরে নিয়ে বাংলাদেশকে এখন কাজ করতে হবে বলে পরামর্শ দেন এই অধ্যাপক।

জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা বলেন, জাতিসংঘে এবারই প্রথমবারের মতো সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হলো রোহিঙ্গা রেজুলেশন, যা এ সংকটের সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় প্রতিশ্রæতিরই প্রতিফলন। আশা করা যায়, এবারের রেজুলেশনটি নিজভূমি মিয়ানমারে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেয়ার প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে, যা দীর্ঘস্থায়ী এ সমস্যার টেকসই সমাধানে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এবারের রেজুলেশনটিতে ১০৭টি দেশ সহপৃষ্ঠপোষকতা করছে, যে সংখ্যা ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ওআইসি ছাড়াও রেজুলেশনটিতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দেশ সমর্থন জুগিয়েছে এবং সহপৃষ্ঠপোষকতা করেছে। সর্বসম্মতিক্রমে পাস হওয়া এবারের রোহিঙ্গা রেজুলেশনের বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে রাষ্ট্রদূত ফাতিমা বলেন, একটি শক্তিশালী ম্যান্ডেট নিয়ে এবারের রেজুলেশন গ্রহণ করা হলো, যা রোহিঙ্গাদের মনে নতুন আশার সঞ্চার করবে, যেজন্য তারা পথ চেয়ে বসে আছে।

ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, জাতিসংঘের থার্ড কমিটিতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন জোট ও গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহত যোগাযোগের ফলে এই সম্মতি আদায় করা সম্ভব হয়েছে। এবারের রেজুলেশনে গত চার বছরের সব উপাদানের পাশাপাশি চারটি নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে, যেগুলো নিয়ে অনেক দেশ এবং জাতিসংঘ আমলারা বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশি কূটনীতিকরা তাদের বোঝাতে সক্ষম হন এবং পরবর্তী সময়ে সব সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়।

নতুন বিষয়গুলো হলো- ভাসানচর সংক্রান্ত একটি প্যারা, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে প্রত্যাবাসন চুক্তির সরাসরি রেফারেন্স দেয়া, জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূতের কার্যক্রম (ওয়ার্ক প্ল্যান) সবাইকে জানানো এবং ইউএনডিপি ও ইউএনএইচসিআর মিয়ানমারে কী কাজ করছে সেটির বিষয়ে রিপোর্ট দেয়া। একজন কূটনীতিক বলেন, রেজুলেশনটি গ্রহণের জন্য সবপর্যায় থেকে চেষ্টা ছিল এবং অবশেষে এটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

গত জুলাইয়ে মিয়ানমারবিষয়ক একটি রেজুলেশন জাতিসংঘে প্রস্তাব করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং যা চেয়েছিল সেটি না থাকায় ওই রেজুলেশনে বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থাকে, যা ভালো চোখে দেখেনি ইইউসহ অনেকে। এ কারণে এই রেজুলেশনে ইইউকে পাশে পাওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। পরবর্তী সময়ে ইইউ বাংলাদেশকে সমর্থন দেয়ার পাশাপাশি এটি কো-স্পন্সর করতে রাজি হয়। আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল প্রথম থেকেই যে কোনো ধরনের রোহিঙ্গা রেজুলেশনে বেলারুশ, চীন, রাশিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়াসহ আরো কয়েকটি দেশ নেতিবাচক ভোট দিয়েছে। এবার তাদের বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়, যেন তারা ভোট আহ্বান না করে এবং বুধবার জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে রেজুলেশনটি ভোটে দেয়ার সময়ে তারা সবাই নীরব ছিল।

সাধারণ অধিবেশনের প্রেসিডেন্ট জিবুতির স্থায়ী প্রতিনিধি যখন এটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে বলে ঘোষণা দেয় তখন বেলারুশের প্রতিনিধি বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে ‘থাম্বস আপ’ প্রদর্শন করে অর্থাৎ ঢাকা যা চেয়েছিল সেটি তারা পেয়ে গেছে। তৃতীয় বড় চ্যালেঞ্জ ছিল জাতিসংঘের আমলাতন্ত্র। এবারের রোহিঙ্গা রেজুলেশনে জাতিসংঘের আমলাদের কার্যক্রমকে একটি দায়বদ্ধতার আওতায় আনা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এটির বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ ছিল।

বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ভাসানচর প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়, এক লাখ রোহিঙ্গাকে সেখানে সাময়িক স্থানান্তরের জন্য। রোহিঙ্গা স্থানান্তরের বিষয়ে অনেক দেশ ও সংস্থার প্রাথমিক বিরোধিতা থাকলেও পরবর্তী সময়ে ওই দ্বীপে কাজ করতে সম্মত হয় জাতিসংঘ। এ নিয়ে জাতিসংঘের সঙ্গে সরকারের একটি সমঝোতা স্মারকও সই হয়েছে। এ বিষয়কে স্বাগত জানিয়ে একটি প্যারা সংযুক্ত হয়েছে রেজুলেশনটিতে।

এ বিষয়ে একজন কূটনীতিক বলেন, আমরা এই রেজুলেশন নিয়ে আলোচনা অনেক আগে শুরু করেছি এবং এ বিষয়ে তুরস্কসহ কয়েকটি দেশ আমাদের সহায়তা করেছে। এ বিষয়টি আরো সহজ হয়েছে যখন জাতিসংঘ ভাসানচরে কাজ করতে সম্মত হয়।

এর আগের রেজুলেশনগুলোতে প্রত্যাবাসনের কথা উল্লেখ থাকলেও ২০১৭ সালে দুই দেশের মধ্যে এ সংক্রান্ত চুক্তির বিষয়টি উল্লেখ করা হতো না। এবারে ওই চুক্তির রেফারেন্স দিয়ে বলা হয়েছে মিয়ানমার এটি সই করেছে এবং ওই দেশে যেই সরকারই থাকুক, এটি মানতে তারা বাধ্য।

এ বিষয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক দেশই প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী নয়। তাদের যুক্তি হচ্ছে ওই দেশে এখন সামরিক সরকার আছে এবং রোহিঙ্গারা সেখানে নিরাপদ নয়। বাংলাদেশ এর পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেছে, এটি দুই দেশের মধ্যে চুক্তি এবং যেই ক্ষমতায় থাকুক, এটি সবার জন্য বলবৎ।

জাতিসংঘ মহাসচিবের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন। কিন্তু তিনি কাজগুলো কখন ও কীভাবে করছেন এ বিষয়ে কোনো ওয়ার্ক প্ল্যান দেয়া হতো না। গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশ এটিকে রেজুলেশনে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছিল এবং এবারে সফল হয়েছে। এর মাধ্যমে বিশেষ দূতকে তার কর্মপরিকল্পনা সাধারণ পরিষদ অর্থাৎ সব সদস্য রাষ্ট্রকে অবহিত করতে হবে। যদি এটি না করা হয় তবে সামনের বছরের রেজুলেশনে এর নেতিবাচক প্রতিফলন থাকবে।

এ বিষয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, ওয়ার্ক প্ল্যানের বিষয়ে জাতিসংঘ আমলাদের আপত্তি ছিল। তাদের যুক্তি হচ্ছে বিশেষ দূত ওয়ার্ক প্ল্যান করে কাজ করতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশকে সহায়তা করে ইইউ। ইউরোপের জোটটি যুক্তি দেয় যে ওয়ার্ক প্ল্যান থাকলে বিশেষ দূতের কাজ করতে আরো সুবিধা হবে, কারণ এর ফলে দায়বদ্ধতা তৈরি হবে। রাখাইনে কাজ করার জন্য জাতিসংঘের দুটি সংস্থা ইউএনডিপি ও ইউএনএইচসিআর চুক্তি করেছে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে। এ বিষয়ে একটি প্যারা সংযুক্ত হয়েছে, যেখানে বলা আছে ওই চুক্তিটি যেন নবায়ন করা হয় এবং তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে রিপোর্ট প্রদান করা হয়।
এ বিষয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, এ বিষয়টিও জাতিসংঘের আমলাতন্ত্র ভালো চোখে দেখেনি। তারা এর আগে এ ধরনের কোনো রিপোর্ট দেয়নি, তবে এবারের রেজুলেশনে জাতিসংঘ মহাসচিবকে বলা হয়েছে তার বার্ষিক রিপোর্টে এ বিষয়ে যেন একটি প্রতিবেদন থাকে।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর কয়েক মাসের মধ্যে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে বাংলাদেশে ছিল আরও চার লাখ রোহিঙ্গা। আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই প্রত্যাবাসন আজও শুরু হয়নি। ২০১৯-এ দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রাখাইন রাজ্যের পরিবেশ নিয়ে শঙ্কার কথা তুলে ধরে ফিরতে রাজি হয়নি রোহিঙ্গারা। প্রত্যাবাসনের পক্ষে সব দেশ বিভিন্ন সময়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিলেও এক্ষেত্রে কার্যকর কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রম্নপের (জেডবিস্নউজি) শেষ বৈঠকটি হয়েছিল ২০১৯ সালের মে মাসে। গত বছরের শুরুতে ঢাকায় জেডবিস্নউজির বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। করোনাভাইরাসের কারণে সেই বৈঠক না হওয়ায় দুই দেশের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনাই হচ্ছে না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় এক ধরনের অচলাবস্থার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সম্প্রতি চীনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু করে। বাংলাদেশে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ঢলের পর থেকেই তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় চীন নেপথ্যে ভূমিকা রাখছে। আর ২০১৮ সাল থেকে দেশটি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের আলোচনায় সরাসরি যুক্ত রয়েছে। সর্বশেষ বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং চীনের মধ্যে গত ৪ ফেব্রম্নয়ারির নির্ধারিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠক স্থগিত হয়েছে। মিয়ানমারে সেনাশাসন শুরুর প্রেক্ষাপটে এ আলোচনাও আর এগোয়নি। অবশ্য চীনের উদ্যোগে এর আগে কয়েক দফার বৈঠক হলেও কার্যত প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার কিছুই করেনি।

এদিকে গত ৩১ মে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার, ইউএনএইচসিআরের দু’জন কর্মকর্তার ভাসানচর সফরের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য দেননি। গত ১৬ জুন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত ক্রিস্টিন এস বার্গনারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠককালে প্রত্যাবাসন বিষয়ে জাতিসংঘে স্পষ্ট একটি রোডম্যাপ তৈরির বিষয়টি নজরে আনা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাত্র দু’দিনের ব্যবধানে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে মিয়ানমার বিষয়ক গৃহীত রেজুলেশনে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়।

পাঠকের মতামত