লাফিয়ে বাড়ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা। কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফজুড়ে ৩৩টি ক্যাম্পে ১৩ লাখের বেশি শরণার্থী অবস্থান করছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট-পরবর্তী ৩ মাসে মিয়ানমারে সেনা নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। গত ৮ বছরে প্রায় ৪ লাখ জনসংখ্যা বেড়েছে ক্যাম্পজুড়ে। তথ্য বলছে, দুঃখ-কষ্টে জীবন চললেও সন্তান জন্ম দিতে পিছপা হচ্ছেন না রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পগুলোতে ২৪ ঘণ্টায় ১৩০-১৩৫ জন অর্থাৎ ঘণ্টায় প্রায় ৬ জন শিশুর জন্ম হচ্ছে, বছরে প্রায় ৫০ হাজার। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীতে জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনো বালাই নেই।
কক্সবাজার জেলা পরিষদ সূত্র বলছে, ক্যাম্পগুলোতে ব্র্যাক, ইউনিসেফ, সেভ দ্য চিলড্রেন, ওয়ার্ল্ড ভিশন, এসিএফ, এমএসএফ হল্যান্ডসহ ৭০টির বেশি এনজিও স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কাজ করছে। অধিকাংশ এনজিও জন্মনিয়ন্ত্রণ, বাল্যবিবাহ বন্ধেও কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণ কিছুতেই কার্যকর করা যাচ্ছে না। তথ্যানুসারে, এমনও মা-বাবা রয়েছেন, যাদের ১৯-২০টি সন্তান। বহু পুরুষের একাধিক স্ত্রী। বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস আজ (১১ জুন)। প্রতিবছরই ক্যালেন্ডার ধরে দিনটি আসে, চলেও যায়। দুনিয়াজুড়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যকর করার বিষয়ে নানা আঙ্গিকে আলোচনা হয়। তারপর যেমন চলার, চলে তেমনই।
Advertisement
জানা যায়, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রায় অর্ধলক্ষ নারী গর্ভবতী অবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। পরে প্রতিবছরই গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ হাজার নারী সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। মাঠ পর্যায়ে কাজ করা এনজিওকর্মীদের অনেকের ভাষ্য, শরণার্থীদের মাথাপিছু খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হয়। এর ফলে শরণার্থীদের মধ্যে সন্তান জন্ম দেওয়ার এক প্রকার প্রতিযোগিতা চলছে। সন্তান হওয়া মানেই-পরিবারে একটি ‘মাথা’ বেড়ে যাওয়া। এমন বিষয়গুলো নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছে প্রশাসনসহ এনজিও সংস্থাগুলোও।
এদিকে তথ্য বলছে, একদিকে জন্মগত সংখ্যা বাড়ছে, অন্যদিকে নতুন অনুপ্রবেশও বাড়ছে। গত বছর বাংলাদেশে ৭০ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে প্রবেশ করেছে যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এমন হিসাব সরকারের পক্ষ থেকেই জানানো হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রমতে, ক্যাম্পগুলোতে জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে শিশু জন্মও। কোনো প্রচারেও শরণার্থীদের মধ্যে কোনো প্রভাব পড়ছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি এনজিও কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, শরণার্থীদের জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে কথা বলতেই বকাঝকা শুনতে হয়। কখনো মারতে তেড়ে আসেন। রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের অধিকাংশই মনে করেন জন্মনিয়ন্ত্রণ মানেই ‘পাপকাজ’। বাল্যবিবাহ অহরহ হচ্ছে। প্রথম বছর থেকেই বাচ্চা নেওয়া শুরু করে। কক্সবাজার পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সূত্রমতে, রোহিঙ্গারা যখন বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসে, তখন প্রথম তিন মাসে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল ৩৪ হাজার ৪৮০ জন গর্ভবতী নারীকে। যে হারে শরণার্থী বাড়ছে তাতে কক্সবাজারসহ সারা দেশেই এর ভয়াবহ প্রভাব পড়বে। বনজঙ্গল উজাড় করে যেমন তারা হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করছে, তেমনি গণহারে শিশু জন্ম দিয়ে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের এক মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলছে বাংলাদেশকে। এমন পরিস্থিতিতে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো যুক্ত হচ্ছে মারাত্মক সংক্রামক সব রোগ। বেসরকারি এনজিও সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের গবেষণায় উঠে এসেছে-রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে প্রতিদিন ১৩০-১৩৫ জন শিশু জন্ম গ্রহণ করছে।
এই সংস্থার শিশু সুরক্ষা ও শিশু অধিকারবিষয়ক পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, শরণার্থীরা অনিয়ন্ত্রিতভাবে সন্তান জন্ম দিচ্ছে। তাছাড়া বাসিন্দারা খুব কৌশলে-‘মাথাপিছু’ গণনায় নিজেরা এগিয়ে থাকতে এক একটি পরিবার গত ৮ বছরে ৬ থেকে ৭টি সন্তান পর্যন্ত নিয়েছেন। কারণ তাদের খাদ্যসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে-‘মাথাপিছু’ গণনা করে। সেভ দ্য চিলড্রেন শিশু সুরক্ষাসহ জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়গুলো নিয়েও প্রতিনিয়ত পরামর্শ-নির্দেশনা দিচ্ছে। কিন্তু যেভাবে তা কার্যকর করার, তা করা হচ্ছে না। অপর একটি এনজিও সংস্থা বলছে, যে হারে শিশুর সংখ্যা বাড়ছে সেভাবে অনুপ্রবেশও অব্যাহত রয়েছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বছরে লক্ষাধিক শিশু জন্ম নেবে ক্যাম্পগুলোতে। অর্থাৎ আগামী ১০ বছরে ক্যাম্পগুলোতে জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২০ লাখ। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ্উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে ক্যাম্পগুলোতে কার্যক্রম চালানো সব এনজিও সংস্থাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এদের কার্যক্রমের বিষয়গুলো নজরে আনা হয়েছে। বর্তমানে ক্যাম্পগুলোতে ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রয়েছে। হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর ৩৫ হাজারের বেশি শিশু জন্ম নিচ্ছে ক্যাম্পগুলোতে। বেসরকারি হিসাবে জন্মের হার আরও বেশি। সূত্র যুগান্তর