ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ১০/০৫/২০২৩ ৯:১৬ এএম , আপডেট: ১০/০৫/২০২৩ ৯:১৮ এএম
উখিয়ার এমএসএফ হাসপাতালের পাশে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাঁটাতারের বেড়া কেটে নিজেদের মতো পথ তৈরি করা হয়েছে। রয়েছে এমন শতাধিক পথ। ৩ মে বিকালে তোলা।

বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় গত সাড়ে পাঁচ বছরে অন্তত ১৬৪ টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্য গত দুই বছরে এ সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি।

ক্যাম্পগুলোতে হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, গোলাগুলি অনেকটা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

কিন্তু এই সহিংসতার নেপথ্য কারণগুলো কী? কারা রয়েছে এর পেছনে?

দ্বিতীয় রমজানের দিনে তারাবির নামাজ শেষ করে যখন নিজের ঘরে ফিরছিলেন কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা মজিবর রহমান, অস্ত্র হাতে একজন ব্যক্তি এসে তাকে দুটি গুলি করে। পেটে এবং পায়ে গুলি লাগলে তিনি গুরুতর আহত হন।

‘’তারা এর আগে থেকেই আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছিল। কিন্তু কেন আমাকে মারতে চায়, তা বলে নাই। আমাকে যে গুলি করছে, সেও আমাদের ক্যাম্পের বাসিন্দা। সে আরসার সাথে থাকে শুনছি। এখন আর তাকে এখানে দেখি না,’’ বলছিলেন মজিবর রহমান।

কয়েক সপ্তাহ হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে ক্যাম্পে ফিরলেও তিনি কারও বিরুদ্ধে মামলা করেননি। কারণ তার আশঙ্কা, তাহলে আবার হামলাকারীরা এসে তার ওপর গুলি করতে পারে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় বাসিন্দাদের কথা থেকে মনে হয় তারা যেন এধরণের সহিংসতাকে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই ধরে নিয়েছেন।

এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখে মনোরা বেগমের ছেলে রুমনকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল একটা সশস্ত্র গোষ্ঠীর লোকজন। পাঁচদিন আটকে রাখার পর তাদের কথা মতো একটি নির্দিষ্ট স্থানে এক লাখ ২০ হাজার টাকার রেখে আসলে ছেলে বাড়িতে আসে।

তিনি বলেন, ক্যাম্পের লোকজনের কাছে চেয়ে চিন্তে, ধার করে, ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে তিনি টাকার জোগাড় করেন।

তাকে হুমকি দেয়া হয়েছে, এই কথা পুলিশ বা সাংবাদিকদের জানালে আবার এসে হামলা করে মেরে রেখে যাবে। তাই তিনিও মামলা করতে বা কারও কাছে অভিযোগ জানাতে যাননি।

মনোরা বেগম বলছিলেন, ‘’আমাদের ক্যাম্পের মধ্যেই থাকতে হবে। তাইলে ওদের সাথে ঝামেলা করে লাভ কি? সব জায়গায় ওদের লোক আছে। উল্টো আমার জীবন যাবে। তারচেয়ে ওদের সাথে তালমিল করে থাকাই ভালো।‘’

উভয় ঘটনার জন্য রোহিঙ্গা ক্যাম্প ভিত্তিক কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতি তারা অভিযোগ করেছেন।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় যে একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, সেটা যেন ‘ওপেন সিক্রেট’। কিন্তু কেউ এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোন কথা বলতে চান না। কারণ তাদের ভয়, কেউ ‘ফোকাস’ হয়ে গেলেই তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে।

কারণ যারাই এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেছে, এমনকি প্রশাসন-গোয়েন্দাকে তথ্য দিয়েছে বলে সন্দেহ হয়েছে, তারাই পরবর্তীতে এসব গোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।

আধিপত্য বিস্তার, ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ মূল কারণ
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় একের পর এক সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটে চলেছে, তার কারণ জানতে বিবিসি বাংলার কথা হয়েছে কক্সবাজারের পুলিশের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা, রোহিঙ্গা মাঝি ও সাধারণ রোহিঙ্গা, প্রশাসনের সদস্য, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাংবাদিকদের সাথে।

তারা সবাই একবাক্যে বলছেন, ক্যাম্পে সহিংসতার মূল কারণ হিসাবে ক্যাম্পের ভেতরে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারের এবং মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় নিরাপত্তার কাজ তদারকি করে পুলিশের যে আর্মড ব্যাটেলিয়ন, তার একটি, আর্মড ব্যাটেলিয়ন আটের কমান্ডার অতিরিক্ত উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক আমির জাফর বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘’ক্যাম্পের ভেতর অনেকগুলো গ্রুপ রয়েছে। তারা একে অন্যকে হটিয়ে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে, নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা করে। কারণ ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে থাকবে, মাদক ব্যবসা, পাচার, অপহরণ সব কিছু তারা করতে পারবে। এই কারণেই এখন যেসব সহিংসতার ঘটনা ঘটছে, আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করেই এগুলো বেশি ঘটছে।‘’

এই বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় বর্তমানে ১০টি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে হত্যাকাণ্ড ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।

রোহিঙ্গা সূত্রগুলো জানিয়েছে, এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) আর রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)। এর বাইরে নবী হোসেন গ্রুপ, মুন্না গ্রুপ, ডাকাত হাকিম গ্রুপ, ডাকাত সালেহ গ্রুপ, ইসলামিক মাহাস গ্রুপ রয়েছে। আরসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে আল-ইয়াকিন নামেও পরিচিত।

আরএসও আগে থেকেই কুতুপালং ক্যাম্পে সক্রিয় ছিল। ২০১৭ সালের পর থেকেই আরসা এবং অন্য সংগঠনগুলো আরও বেশি সক্রিয় আর শক্তিশালী হয়ে উঠেছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সূত্রগুলো বলছে, এসব গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি এসব নিয়েই এখন সবচেয়ে বেশি সহিংসতার ঘটনা ঘটছে।

আরসা এবং আরএসও আলাদাভাবে কাজ করলেও তাদের মধ্যে বিরোধ ছিল না। কিন্তু গত কয়েক বছরে এই দুটি সংগঠন পরস্পর মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। বিশেষ করে আরসার বিরুদ্ধে আরএসও গত দুই বছরে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

কর্মহীন, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের এই রোহিঙ্গাদের ঘিরে মাদক, পাচার, অপহরণসহ নানারকম অপরাধের সাম্রাজ্য তৈরি করেছে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। মাদক পাচার, অপহরণ নিয়ে কোন দ্বন্দ্বের তৈরি হলেই তারা একে অপরের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। নিজেদের প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে তারা বিভিন্ন ক্যাম্পে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করে রেখেছে। যখন তারা সেই প্রভাব আরও বিস্তারের চেষ্টা করে, তখন আরেকটি গ্রুপের সঙ্গে গোলাগুলি বা হত্যাকাণ্ড শুরু হয়ে যায়।

রোহিঙ্গা মাঝিরা বলছেন, ‘’ক্যাম্পের সব জায়গায় এসব দলের লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ক্যাম্পে কাজের সুযোগ সীমিত হওয়ায় টাকা পয়সা আর শক্তির দেখানোর লোভে অনেক রোহিঙ্গা তরুণ এসব গ্রুপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে।‘’

নিজেদের কৌশলও পরিবর্তন করেছে এসব সন্ত্রাসী দল। এখন আর আগের মতো তারা দল বেধে অস্ত্র হাতে প্রকাশ্যে ক্যাম্পের ভেতরে চলাফেরা করে না। কাউকে টার্গেট করা হলে সুবিধা মতো সময়ে এসে তারা হামলা করে।

কোন সশস্ত্র গ্রুপ একটি এলাকায় নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর আরেকটি গ্রুপ এসে পাল্টা হামলা করে সেই এলাকার দখল নেয়ার চেষ্টা করে। ফলে আরসা সদস্যদের লক্ষ্য করে হামলা করছে আরএসও, আবার আরএসও সদস্যদের ওপর পাল্টা হামলা চালাচ্ছে আরসা। এসব কারণে গত দুই বছরে ৪০টির বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একজন বাসিন্দা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর আধিপত্য নিয়ে দ্বন্দ্বে এর বেশ কয়েকবার ক্যাম্পে আগুন দেয়া হয়েছে। এক গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় আরেক গ্রুপ আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

আর্মড ব্যাটেলিয়ন ১৪ কমান্ডার সৈয়দ হারুন অর রশীদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘’রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাম্প্রতিক যেসব গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে, প্রায় তার সবই আরসা আর আরএসও সশস্ত্র দুটি গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে ঘটেছে। তবে ক্যাম্পের সার্বিক পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আছে।‘’

আগে আরসার লোকজন নাইক্ষংছড়ির শূন্য রেখায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই শক্ত ঘাটি তৈরি করেছিল। শূন্য রেখা থেকে রোহিঙ্গাদের সরিয়ে দেয়ার পর তারা অন্য ক্যাম্পগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে।

এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অর্থের মূল উৎস মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে মাদক পাচারের ব্যবসা। মিয়ানমারের ইয়াবা তৈরিকারীদের সঙ্গে এসব গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাদের কাছ থেকে সীমান্তের পাহাড়ি এলাকা, নদী থেকে ইয়াবা বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। পরে এই চক্রের কাছ থেকে সেটা বাংলাদেশি মাদক কারবারিদের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

এছাড়া মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে যেসব পণ্য পাচার হয়ে দেশে আসে, সেটাও নিয়ন্ত্রণ করে এসব সশস্ত্র গোষ্ঠী। সেই সঙ্গে রয়েছে ক্যাম্প থেকে মানব পাচার, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করার মতো অপরাধ। যে এলাকা যার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সেই এলাকার দোকান থেকে, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও এরা চাঁদা নেয়।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের হিসাবে, ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আড়াই হাজারের বেশি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা পাঁচ হাজারের বেশি। তাদের বিরুদ্ধে হত্যা, অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার, মাদক ব্যবসা, ডাকাতি, ধর্ষণ, অপহরণ, মানব পাচার ও পুলিশের ওপর হামলার মতো অভিযোগ রয়েছে।

ক্যাম্পে ক্যাম্পে সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাম্রাজ্য
ক্যাম্পের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা দাবী করলেও ক্যাম্পগুলো ঘুরে সেটি মনে হয়নি।

কক্সবাজারের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গাদাগাদি করে ১২ লাখের বেশি মানুষ বাস করে। এক ঘরের সাথেই আরেক ঘর লাগানো, তার ফাঁকে ফাঁকে সরু রাস্তা। একবার ঢুকে গেলে নতুন কারও জন্য পথ চিনে ফেরা মুশকিল।

ক্যাম্পের ভেতরে খুব বড় সড়ক নেই, পথঘাটগুলো এমন সরু যে, কোথাও কোথাও পাশাপাশি দুইজন যাওয়া যায় না। পাহাড়ি টিলাগুলোর গায়ে গায়ে ঘরবাড়ি আর পায়ে চলা পথ উঠে গেছে।

গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পের ভেতরে খুব বেশি দূর যাওয়াও সম্ভব নয়। ফলে এসব ক্যাম্পের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর চলাচল খুব বেশি নেই।

কিন্তু সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা ঠিকই রয়েছে। বিশেষ করে ক্যাম্পগুলোর ভেতরের দিকে, পাহাড়ি এলাকায় এসব গোষ্ঠীর তৎপরতা বেশি। বিশেষ করে রাতের বেলায় এসব ক্যাম্প অনেকটা এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও খুব বেশি সক্রিয় থাকে না। এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীর বেশিরভাগ কর্মকাণ্ড রাতের বেলাতেই চলে।

কয়েক বছর আগেও বেশিরভাগ হামলার ঘটনা রাতের বেলায় করা হতো। কিন্তু এখন প্রকাশ্যে দিনের বেলাতেও হামলার ঘটনা ঘটছে। মুখোশ পড়ে হামলা করায় এসব ঘটনায় মামলা হলে আসামি করা হয় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের।

আরমান নামের একজন রোহিঙ্গা বলছেন, হঠাৎ করে এসে ওরা হামলা করেই চলে যায়। কেউ চিনলেও তাদের নাম বলতে চায় না।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মোঃ মাহফুজুল ইসলাম যদিও বলছেন, ‘’অন্যসব মামলার মতো রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ঘটনাতেও তারা আসামী গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করা হয়, বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা হয়।‘’

কিন্তু ডাকাতি বা অপহরণ মামলা ছাড়া হত্যাকাণ্ডের কোন মামলায় বিচার কাজ শেষ হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি।

ক্যাম্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্যাম্পের ভেতর হত্যা, অপহরণ বা সহিংসতার অনেক ঘটনায় মামলাই হয়না। রোহিঙ্গারা ভয়ে থানা পুলিশ বা আদালতের কাছে যেতে চায় না। আবার পুলিশও সহজে ক্যাম্পের ভেতরে অভিযান চালাতে চায় না ।

একজন পুলিশের কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, ‘’রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর ওপর সারা বিশ্বের নজর থাকে। ফলে সেখানে একটা অভিযানে কিছু ঘটলে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়ে যেতে পারে। তাই এখানে অভিযানের ব্যাপারে আমরা একটু সতর্ক থাকতে চাই।‘’

পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, হত্যাকাণ্ড, মাদক বা পারিবারিক নির্যাতনের কোন মামলায় যদি আসামি গ্রেপ্তারও করা হয়, পরে আর সাক্ষীর অভাবে বিচার এগোয় না। কিছুদিন পরেই তারা জামিন বা খালাস হয়ে বেরিয়ে আসে।

মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের পর কড়াকড়ি প্রশাসনের
রোহিঙ্গাদের একজন শীর্ষ নেতা মহিবুল্লাহকে ২০২১ সালের ৩০শে অক্টোবর কয়েকজন ব্যক্তি এসে গুলি করে হত্যা করে। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস মিয়ানমারের নেতা মহিবুল্লাহ রোহিঙ্গা অধিকার এবং প্রত্যাবাসনের পক্ষে সোচ্চার ছিলেন।

ওই হত্যাকাণ্ডের পরেই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে দমনে বিশেষ মনোযোগ দিতে শুরু করে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ। ক্যাম্পের ভেতরে পুলিশের নজরদারি চৌকি বাড়ানো হয়েছে। মাদক ও অস্ত্রসহ গ্রেপ্তারের সংখ্যাও বেড়েছে। আর্মড ব্যাটেলিয়নের পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে নজরদারি ও অভিযান বাড়িয়েছে র‍্যাব ও পুলিশও।

এই বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক চুরি, ডাকাতি, খুন, গুম অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় কোনভাবেই করতে দেয়া হবে না। এসব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে।

কিন্তু রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরের তথ্যের জন্য প্রশাসন নির্ভর করে ক্যাম্প মাঝি, ব্লক মাঝিদের ওপরে। তাদের ওপর নির্দেশ দেয়া আছে, সশস্ত্র কাউকে দেখলেই যেন প্রশাসনকে খবর দেয়া হয়। কিন্তু অনেকেই এসব কর্মকাণ্ড দেখলে বা জানলেও চুপ করে থাকে। কারণ তাদের আশঙ্কা, সেটা হলে পরবর্তীতে তাদের ওপর হামলা আসবে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে দেয়া পুলিশের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৫শে অগাস্ট থেকে ২০২২ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৩২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা নেতা বা মাঝি।

একজন ব্লক মাঝি বলছিলেন,, ‘’সরকার আমাদের ক্যাম্পের দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছে। বিশেষ করে কারা ক্যাম্পে আসে যায়, রাতে কারা ঘোরাফেরা করে, সেই তথ্য জানাতে বলে। ওরা মনে করতেছে, আমরা ওদের কাজকর্মে বাধা তৈরি করছি। ‘’

‘’এই জন্য এখন মাঝিদের বেশি টার্গেট করা হচ্ছে। ওরা মনে করে, প্রশাসনকে সব খবর আমরাই দেই। এখন আমি খবর দেই আর না দেই, কোন ব্লকে বা ক্যাম্পে যদি কোন বাহিনীর কেউ ধরা পড়ে, কেউ মারা যায়, ওরা মনে করে, মাঝিরাই খবর দিয়েছে।‘’

গত এক বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় অন্তত ১৪ জন মাঝি বা সাব-মাঝি নিহত হয়েছে এরকম হামলায়।

ফলে রোহিঙ্গাদের ভেতরকার অপরাধীদের বিষয়ে তথ্য পেতেও বেগ পেতে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। রোহিঙ্গাদের অনেকেই নানা ধরনের ছোটবড় অপরাধের সাথে জড়িত থাকায়, নিয়ম ভঙ্গ করে ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে কাজ করায় তারও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সহজে যেতে চায় না। ক্যাম্পের ভেতরের অপরাধ দমন কঠিন হয়ে পড়ে।

এমনকি একজন রোহিঙ্গা মাঝির সঙ্গে কুতুপালং বাজারের একটি নিভৃত স্থানে বসে যখন আমার কথা হচ্ছিল, তিনি একটু পরপরেই আশেপাশে তাকাচ্ছিলেন যে, কেউ কথাগুলো শুনে ফেলছে কিনা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রোহিঙ্গা বলছিলেন, আরসা বা অন্য সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শক্ত অবস্থান থাকলেও আরএসও ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয়তা দেখা যায়। কারণ এদের দিয়ে আরসাকে দমন করানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে এই বক্তব্য নাকচ করে দিয়েছেন বাংলাদেশের কর্মকর্তারা।

২০১৭ সাল থেকে ২০২০ সালের জুলাই মাসে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যাকাণ্ডের আগে পর্যন্ত মাদক, সন্ত্রাস, অপহরণের অভিযোগ রয়েছে, এমন অনেক রোহিঙ্গা পুলিশ ও র‍্যাবের সাথে ‘এনকাউন্টারে’ নিহত হয়েছে বলে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় খবর হয়েছে।

২০১৮ সালের মে মাসে সারা দেশে যে মাদক বিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু করা হয়েছে, তাতে কক্সবাজারেই নিহত হয়েছিল ২৯৯ জন, যাদের মধ্যে ৭৯জন ছিল রোহিঙ্গা।

সহিংসতার প্রভাব আশেপাশের এলাকায়
রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ডের প্রভাব পড়ছে আশেপাশের এলাকাগুলোতেও।

রোহিঙ্গা গোষ্ঠীগুলোর এসব অপরাধের শিকার হচ্ছে টেকনাফ ও উখিয়ার অনেক সাধারণ মানুষও।

টেকনাফের সাংবাদিক আবদুর রহমান বলছিলেন, সেই এলাকায় বনে কাঠ কাটতে যাওয়া মানুষজনকে অপহরণ অনেক বেড়ে গেছে। পরে হাজার হাজার টাকা দিয়ে সেই কাঠুরিয়াদের ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে। ভয়ে তারা মামলা করতেও যাননি।

অর্থের লোভে অপহরণ, মানব পাচার এবং মাদক পাচারের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সাথে সাথে জড়িয়ে পড়ছে স্থানীয় অনেক মানুষ। বিশেষ করে মিয়ানমার থেকে মাদক আনার পরে প্রথমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে মজুদ করা হয়। পরে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় সেটা দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয় বলে গোয়েন্দা একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল আলম, ‘’যখন কয়েক লাখ মানুষ অধ্যুষিত একটা এলাকায় একের পর এক অপরাধের ঘটনা ঘটতে থাকে,তখন আশেপাশের এলাকাতেও তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। ২০১৭ সালের পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর আশেপাশের এলাকায় মামলা, অপহরণের ঘটনা, মাদকের মামলা অনেক বেড়েছে। অনেক সময় ক্যাম্পের উত্তেজনার প্রভাব এসব এলাকাতেও পড়ে। তবে আমরা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পরিস্থিতি শান্ত রাখার চেষ্টা করি”।

ফেরত যেতে চায় না রোহিঙ্গাদের কিছু গ্রুপ
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর একাধিক মাঝি এবং সাধারণ বাসিন্দারা বলেছেন, আরসা, নবী হোসেনের মতো কিছু গ্রুপ রয়েছে, যারা প্রত্যাবাসন চায় না। ফলে যারাই প্রত্যাবাসনের পক্ষে কথা বলেছেন বা বক্তব্য দিচ্ছেন, তাদের বিশেষভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে।
এই গ্রুপগুলো দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে মাদক এবং নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড গড়ে তুলেছে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হলে তাদের সেই প্রভাব আর থাকবে না, এই আশঙ্কায় প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে কয়েকটি গ্রুপ।

এমনকি প্রত্যাবাসনের আলোচনা শুরু হওয়ার পর সেটা ঠেকাতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কয়েকবার নাশকতামূলক আগুন দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত দুই বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় মোট ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৬৩টি আগুন নাশকতামূলক বা ইচ্ছে করে লাগানো হয়েছে।

রোহিঙ্গারা বলছেন, কেউ যদি প্রত্যাবাসনের পক্ষে কথা বলে, লোকজনকে বোঝানোর চেষ্টা করে, তারাই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হামলার শিকার হয়। রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহকে এই কারণে হত্যা করা হয়েছে বলে তারা মনে করেন। যেসব মাঝি বা সাব-মাঝি প্রত্যাবাসনের পক্ষে, এরকম কয়েকজন মাঝি বা সাব-মাঝির ওপরেও হামলা হয়েছে।

একজন মাঝি বলছিলেন, ‘’কেউ যদি রোহিঙ্গা ফেরতের পক্ষেও থাকে, সেটা কেউ বলতে চায় না। মিডিয়ায় কারও নাম বা ছবি ছাপা হলেও পরদিন এসে গুলি করে দেবে’’। সুত্র: বিবিসি নিউজ বাংলা

পাঠকের মতামত

রোহিঙ্গা শিবিরে ইফতার যে রকম

আব্দুল কুদ্দুস,প্রথমআলো রোববার বিকেল চারটা। কক্সবাজারের উখিয়ার প্রধান সড়ক থেকে বালুখালী আশ্রয়শিবিরে ঢোকার রাস্তায় দেখা ...

লাইসেন্সের কোন কাজ নেই, টাকা দিলে লাইসেন্স লাগে না!- উখিয়ার ব্যবসায়ী সাদ্দাম

বিএসটিআইয়ের অনুমোদন ছাড়াই কথিত লেভেল লাগিয়ে অবৈধভাবে ব্যাটারির পানি বিক্রি করেন উখিয়ার সাদ্দাম মটরসের স্বত্তাধিকারী ...