মাহাবুবুর রহমান.
নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরার কথা ভুলে গেছে রোহিঙ্গারা। বরং স্থায়ী ভাবে কিভাবে বাংলাদেশে থাকা যায় সেই চিন্তাই বেশি ব্যাস্ত থাকেন তারা। সে জন্য বিপুল টাকা পয়সা খরচ করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যে কোন মূল্যে তৈরি করছে জাতীয় পরিচয় পত্র,অনলাইন জন্ম নিবন্ধন এবং পাসপোর্ট। এছাড়া থাকা খাওয়া সহ অন্যান্য উপায়ে বিপুল টাকায় করতে পারায় কোন রোহিঙ্গাকে দেশে ফেরার জন্য রাজি করা যাচ্ছেনা বলে জানান খোদ রোহিঙ্গা নেতারা।
২০১৭ সালে পাশের দেশ মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে সহিংসতার জের ধরে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। প্রাণে বাঁচতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ঠাঁই হয়েছিল কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ে। নতুন ঢলে আসা ও পূর্বে কয়েক দফায় আসা রোহিঙ্গা মিলে উখিয়া-টেকনাফে এখন প্রায় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গার বসবাস।
রোহিঙ্গা আগমনের গত চার বছরে দুই দফা উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর। কিন্তু ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর ও ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর সব প্রস্তুতি শেষ করেও রোহিঙ্গাদের আপত্তির মুখে শেষ পর্যন্ত প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয়।
উখিয়া উপজেলা সুজনের সভাপতি নুর মোহাম্মদ সিকদার বলেন, ১৯৯২ সালে মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতায় রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন চালালে সে বছর আড়াই লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসে উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয়। ২০১২ সাল ও ২০১৬ সালেও বাংলাদেশে প্রায় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের আগে পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ লাখের বেশি। ২০১৭ সালের আগস্টে বাংলাদেশে ঢুকেছিল সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। সবমিলিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩ লাখের অধিক। সেখানে সাড়ে এগার লাখ রোহিঙ্গার বসবাস উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪ টি ক্যাম্পে। বাকিরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় অবৈধভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তবে ক্যাম্পের বাইরে থাকা রোহিঙ্গাদের বেশির ভাগই দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ভোটার তালিকায় নাম উঠিয়ে নিজেরা বাংলাদেশী নাগরিক পরিচয় দিচ্ছেন। এতে বাংলাদেশ তথা কক্সবাজারের ভবিষ্যত নিয়ে আমরা বেশ উদ্বিগ্ন।
উখিয়া ৮ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সাব মাঝি আবুল বশর জানান,এখন আর কেই দেশে (মিয়ানমারে) ফেরার কথা চিন্তা করেনা। কারন বাংলাদেশে সবাই ভাল আছে। এখানে থাকা খাওয়া থেকে শুরু করে সব কিছু বেশ ভাল। বরং বার্মা ফিরে যাওয়ার কথা বল্লে বিপদ আছে। তাই এসব কথা আর কেউ বলেনা। তিনি দাবী করেন,সব রোহিঙ্গা খারাপ না। তবে কিছু রোহিঙ্গার কারনে পুরু রোহিঙ্গার বদনাম হচ্ছে। কিছু রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করে। মাদক(ইয়াবা ) ব্যবসা করে,স্বর্ণ ব্যবসা করে,হন্ডি ব্যবসা করে। সে কারনে ক্যাম্পে প্রায় সময় খুনখারাবি হয়।
টেকনাফের শালবাগান রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নারী আরিফা জুরমান বলেন, মিয়ানমার ফিরে গেলে আমাদের কষ্টে দিনযাপন করতে হবে। সেখানে আমাদের আয় রোজগারের সুযোগ থাকবে না। এখানে আমরা ঘরে বসে খাবার, চিকিৎসা সবই পাচ্ছি। আমাদের এই আরাম আয়েশের জীবন ছেড়ে কেন আবার মিয়ানমার ফেরত পাঠানোর কথা উঠছে বুঝছি না। এই নারীর দাবী অনেক রোহিঙ্গা বর্তমানে টাকা পয়সা দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভোটার,এবং বাংলাদেশী জন্ম নিবন্ধন পেয়েছে। আবার অনেক মেয়েকে স্থানীয় বা পুরাতন রোহিঙ্গার সাথে ক্যাম্পের বাইরে বিয়ে দিয়েছে। তিনি জোর গলায় বলেন,টাকা দিলে সব কিছু হয়।
উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা যুবক আলী আহমদ বলেন, মিয়ানমার সরকার সহজে আমাদের মেনে নেবে না। তাই আমরা মিয়ানমার ফিরতে রাজি না। আর সেখানে যে কষ্ট পেয়েছি সেটা এখানে নাই। তাই এখান থেকে যাওয়ার কথা আপাতত চিন্তা করছি না।
উখিয়ার থাইংখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বয়োবৃদ্ধ রোহিঙ্গা আজম উল্লাহ বলেন, আমার জন্মস্থান মিয়ানমার, বাপ দাদার কবর সেখানে। শরণার্থী জীবন আর ভালো লাগছে না। কিন্তু কি করবো। বাংলাদেশে অন্তুত নিরাপদে ঘুমাতে পারছি। বর্মাতে শান্তিতে ঘুমাতেই পারি না। তাই সেখানে ফেরার কথা চিন্তা করছি না।
কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক হোসাইনুল ইসলাম বাহাদুর বলেন,পুরাতন রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৭০% রোহিঙ্গা কক্সবাজার সহ আশপাশের জেলা গুলোতে স্থানীয় বনে গেছে। অনেকে পাসপোর্ট করে বিদেশে চলে গেছে। আবার ২০১৭ সালের পরে আসার রোহিঙ্গাদের মধ্যেও অনেকে বিপুল টাকা খরচ করে বাংলাদেশী জাতিয় পরিচয় পত্র,জন্মনিবন্ধন পেয়েগেছে। এখন অনেকে চেস্টা করছে। কিন্তু আমরা হাতগুটিয়ে বসে আছি। এই অবস্থা চলতে থাকলে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয় জানায়, প্রত্যাবাসনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে মিয়ানমারের কাছে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত পাঁচ ধাপে মোট ৫ লাখ ৯৭ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে সে-বছরের শুরুতে একসঙ্গে ৪ লাখ ৯২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা দেওয়া হয়েছে। এসব তালিকা থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ১১ হাজার রোহিঙ্গাকে মিয়ানমার ফেরত নেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু তাও এখন পর্যন্ত ফেরত নেয়নি।